সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৪:৪৩ পূর্বাহ্ন

ধান-মাছ-সবজিতে পাল্টেছে সুনামগঞ্জের অর্থনীতি

নিজস্ব প্রতিবেদক: ধান, মাছ ও সবজির ফলনে চাঙ্গা হচ্ছে হাওরের জেলা সুনামগঞ্জের অর্থনীতি। চলতি বছর এ জেলা থেকে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার ধান, সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকার মাছ ও ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকার সবজি উৎপাদন হয়েছে। প্রতি বছর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে উৎপাদন বেশি হওয়ায় হাওরে এখন সচ্ছলতা ফিরেছে কৃষকদের।

জানা যায়, সুনামগঞ্জের ১২ উপজেলা ১৩৭টি ছোটবড় হাওর নিয়ে গড়ে উঠেছে ভাটি এলাকা। দেশের অন্য যেকোনো এলাকা থেকে এটা সম্পূর্ণরূপে ব্যতিক্রম। এখানকার জীবনযাত্রা, সংস্কৃতি, ভাষা, ভূ-প্রকৃতি কিংবা জলবায়ু সবকিছুই ব্যতিক্রম। বছরের প্রায় ছয় মাস গোটা হাওর এলাকা থাকে পানিতে নিমগ্ন। আর ছয় মাস শুকনো। ফলে এখানকার অর্থনীতিও গড়ে উঠেছে প্রকৃতির সঙ্গেই তাল মিলিয়ে।

প্রায় ৩ হাজার ৭৪৭ বর্গকিলোমিটার হাওর এলাকার ৮০ শতাংশ মানুষ সরাসরি কৃষির ওপর নির্ভরশীল। এখানকার কৃষি ও মৎস্য উৎপাদন ঘিরেই গড়ে উঠেছে মানুষের জীবনমান। শুকনো মৌসুমে হাওরের ধান, সবজিসহ সব ধরনের কৃষিপণ্য উৎপাদন করা হয়। আর বর্ষা মৌসুমে যখন হাওর এলাকা পানিতে টইটম্বুর থাকে তখন মাছ আহরণ ও উৎপাদন করেই এখাকার মানুষকে জীবিকা নির্বাহ করতে হয়। ফলে এই দুই পেশা ঘিরেই এখানকার মানুষের জীবন মান পরিবর্তন হয়েছে।

সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার করচার হাওরের কৃষক আব্দুল মতিন। এক সময় মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ধানের চারা রোপণ থেকে ধান মাড়াই পর্যন্ত অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হতো। খরচও হতো বেশি। বর্তমানে কৃষিতে লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। এখন মাঠে মাঠে ট্রাক্টর ও সেচপাম্প। যোগ হয়েছে ধানের চারা রোপণ, ধান কাটা ও মাড়াই যন্ত্র। এতে কমেছে কঠোর পরিশ্রম, সময় ও খরচ। বেড়েছে কাঙ্ক্ষিত ফসলের উৎপাদন।

কৃষক মতিন মিয়া জানান, ধান উৎপাদন করে সাফল্যের মুখ দেখছি। আগে ধান উৎপাদন করে তেমন লাভ হতো না। এখন ধান উৎপাদন করে অনেক লাভবান হন হাওরের কৃষকরা।

গত বছর সুনামগঞ্জে ১৩ লাখ ৮ হাজার মেট্রিক টন বোরো ধান উৎপাদন হয়, যা থেকে চাল উৎপাদন হয় ৮ লাখ ৭২ হাজার ১৪৯ মেট্রিক টন। যার বাজার মূল্য ৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। চলতি মৌসুমে সুনামগঞ্জে ১৩ লাখ ৬০ হাজার মেট্রিক টন ধান উৎপাদন হয়েছে, যা থেকে ৯ লাখ ২৭ হাজার মেট্রিক টন চাল উৎপাদন হয়েছে। এর বাজারমূল্য ৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকা।

পাশাপাশি গত বছর সুনামগঞ্জে ২ লাখ ৯৮ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন আমন ধান উৎপাদন হয়; যেখান থেকে চাল উৎপাদন হয়েছে ১ লাখ ৯৯ হাজার মেট্রিক টন। যার বাজার মূল্য ছিল ৮০০ কোটি টাকা। তবে চলতি মৌসুমে সুনামগঞ্জে ৩ লাখ ১০ হাজার মেট্রিক টন আমন ধানের উৎপাদন হয়েছে। যেখান থেকে ২ লাখ ৭ হাজার মেট্রিক চাল উৎপাদন হয়। যার বাজার মূল্যে ৮৩০ কোটি টাকা।

এদিকে হাওর অধ্যুষিত জেলা হওয়ায় সুনামগঞ্জে দিন দিন মাছের উৎপাদন বাড়ছে। এই জেলায় প্রায় ২৫ হাজার ১৭৩টি পুকুর রয়েছে। এর মধ্যে মৎস্য অধিদপ্তরের অধীনে ২০টি ও ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীনে ১৫৩টি। বাকি ২৫ হাজার পুকুরে ব্যক্তিমালিকানায় মাছচাষ করা হয়। এছাড়া জেলায় ছোটবড় প্রায় এক হাজার বিল রয়েছে, যা থেকে ২০০ প্রজাতির মাছ উৎপাদন হয় এবং সেই মাছ সুনামগঞ্জের চাহিদা মিটিয়ে ১৬০টির বেশি দেশে রপ্তানি করা হয়।

গত বছর ভাটির এই জেলা থেকে ১ লাখ ৭ হাজার ৫৪১ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদন করা হয়, যার বাজারমূল্য ছিল ৫ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু গত ১৬ জুনের ভয়াবহ বন্যায় সুনামগঞ্জের সব মাছ ভেসে যায়। ফলে নিঃস্ব হয়ে পড়েন জেলার ১৭ হাজার মাছচাষি। এরপরও মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুদে টাকা নিয়ে চলতি বছর আবারো মাছচাষ করেছেন চাষিরা। যেখান থেকে ১ লাখ ৯ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদন হয়েছে, যার বাজারমূল্য সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা।

মাছচাষিরা বলছেন, বর্তমানে মাছচাষ করে তারা অনেক লাভবান। তবে যে বছর বন্যা হয় সে বছর তাদের লোকসান গুনতে হয়।

মাছচাষি হেলাল মিয়া বলেন, প্রতিবছর বন্যায় আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সরকারের কাছ থেকে কোনো সহযোগিতা পাই না। তারপরও মাছচাষ করে অনেক লাভবান। যে বছর বন্যা হয় সে বছরই আমাদের ক্ষতির মুখে পড়তে হয়।

সুনামগঞ্জ জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. শামসুল করিম বলেন, সুনামগঞ্জ হাওর এলাকা হওয়ায় এখানে দিন দিন মাছের উৎপাদন বাড়ছে। তবে মাছচাষিরা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হলে তাদের আর্থিক সহযোগিতা এমনকি এই জেলায় আরও মাছ উৎপাদন বাড়াতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।

ধান ও মাছের পর এই জেলার উত্তর পাড়ে ব্যাপক সবজির উৎপাদন বেড়েছে। এসব সবজি সুনামগঞ্জের চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে রপ্তানি হচ্ছে।

সুনামগঞ্জের সবজি চাষি সজিব মিয়া। এ বছর ২০ একর জমিতে বিভিন্ন ধরনের সবজির চাষ করেছেন। সেই সবজির বাম্পার ফলনে জীবন বদলে গেছে তার। এরইমধ্যে তিনি ২০ লাখ টাকার সবজি বাজারে বিক্রি করেছেন।

সবজিচাষি সজিব বলেন, অন্য বছরের চেয়ে এবছর সবজির বাম্পার ফলন হয়েছে এবং বাজারে অনেক দাম পেয়েছি।

শুধু সজিব মিয়া নন, আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় চলতি বছর সুনামগঞ্জে সবজির বাম্পার ফলন ও ভালো দাম পাওয়ায় হাসি ফুটেছে চাষিদের মুখে। সেইসঙ্গে এসব সবজি সুনামগঞ্জের চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় রপ্তানি হচ্ছে।

গত বছর সুনামগঞ্জে ২ লাখ ৮৫ হাজার মেট্রিক টন বিভিন্ন ধরনের সবজির উৎপাদন হয়। যার বাজার মূল্য ছিল ৯৫০ কোটি টাকা। চলতি বছর সুনামগঞ্জে ৩ লাখ মেট্রিক টন সবজির উৎপাদন হয়েছে। যার বাজার মূল্য ১৩শ কোটি টাকা। ফলে দিন দিন এই ভাটির জেলায় সবজি উৎপাদনও বাড়ছে।

সবজিচাষিরা বলেন, সুনামগঞ্জে প্রতি বছর সবজি উৎপাদন বেড়েই চলছে। তবে কৃষি বিভাগ যদি মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের সহযোগিতা করে তাহলে এ জেলায় আরও সবজি উৎপাদন সম্ভব।

সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বিমল চন্দ্র সোম বলেন, হাওরে দিন দিন ধান ও সবজির উৎপাদন বাড়ছে। এতে কৃষকরা অনেক লাভবান হচ্ছেন এবং হাওরের অর্থনীতি বদলে যাচ্ছে।

সার্বিক বিষয়ে জেলা প্রশাসক দিদারে আলম মোহাম্মদ মাকসুদ চৌধুরী বলেন, সুনামগঞ্জের অর্থনীতি চাঙ্গা করার জন্য আমরা কাজ করে যাচ্ছি। যেহেতু এটি হাওরপ্রধান এলাকা সেজন্য হাওরের ধান, মাছ ও সবজি উৎপাদন বাড়াতে আমরা মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের সহযোগিতা করছি।

 

নিউজটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © gtbnews24.com
Web Site Designed, Developed & Hosted By ALL IT BD 01722461335