মঙ্গলবার, ২৮ মার্চ ২০২৩, ১২:৩২ অপরাহ্ন
নিজস্ব প্রতিবেদক: অদম্য এক মেধাবীর নাম ‘তামান্না নুরা’। জন্ম থেকে দুটি হাত ও একটি পা নেই। মাত্র একটি পা’কে সম্বল করে সব পাবলিক পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছেন। এখন তিনি যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (যবিপ্রবি) ইংরেজি বিভাগে স্নাতক (সম্মান) শ্রেণিতে পড়াশোনা করছেন। সংগ্রামী এই তরুণী মেধা ও সংগ্রাম দিয়েই দেশব্যাপী পরিচিতি পেয়েছেন। তাকে ফোন করে উৎসাহ জুগিয়েছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা।
নিজের স্বপ্ন, সংগ্রাম আর দৃঢ়তার গল্প অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে উদ্যোগও নিয়েছেন তামান্না। জীবন থেকে লিখেছেন অনুপ্রেরণামূলক গ্রন্থ ‘ইচ্ছার আলো’। এ মাসেই বইটি প্রকাশের কথা রয়েছে।
তামান্না বলেন, আমার জন্ম থেকে বেড়ে ওঠা প্রতিটি দিনই সংগ্রামের। আমার বাবা, মাসহ পরিবারের সবাই এই সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত। আমার স্বপ্ন, সংগ্রাম, জীবন নিয়ে লেখার চেষ্টা করেছি। আমার জীবন থেকে নেওয়া অনুপ্রেরণা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য ‘ইচ্ছার আলো’ নামে একটি গ্রন্থ রচনার চেষ্টা করেছি। ইনশাআল্লাহ, চলতি মাসেই বইটি প্রকাশ পাবে।
তিনি বলেন, আমি যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে মাইক্রোবায়োলজি বিষয়ে ভর্তি হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মাইক্রোবায়োলজি গবেষণাধর্মী সাবজেক্ট। অণুজীব নিয়ে ল্যাবে কাজ করতে হয়। সেজন্য সুরক্ষা ব্যবস্থা নিতে হয়। আমার জন্য সেটি অনেক কঠিন। বিষয়টি যবিপ্রবি উপাচার্য স্যার আমাকে বুঝিয়েছেন। পাশাপাশি আমিও বিষয়টি উপলব্ধি করেছি। এ কারণে বাস্তবতা মেনে ইংরেজিতে ভর্তি হয়েছি। প্রথমদিকে এটি নিয়ে মন খারাপ হলেও এখন আর সেটি নেই। ইংরেজি সাহিত্য উপভোগ করছি। এটি নিয়ে অনেক গবেষণা ও কাজ করার সুযোগ রয়েছে। আশা করছি, এখানেও এগিয়ে যাওয়ার এবং নতুন কিছু করার সুযোগ পাবো।
অদম্য মেধাবী তামান্নার বাড়ি যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার বাঁকড়া ইউনিয়নের আলীপুর গ্রামে। পুরো নাম তামান্না আক্তার নুরা। তামান্নার বাবার নাম রওশন আলী। মায়ের নাম খাদিজা পারভীন শিল্পী। বাবা স্থানীয় ছোট পোদাউলিয়া দাখিল মাদরাসার (নন-এমপিও) শিক্ষক। মা গৃহিণী। তিন সন্তানের মধ্যে তামান্না সবার বড়। ছোট বোন মুমতাহিনা রশ্মি সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। ভাই মুহিবুল্লা তাজ দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে।
প্রতিবন্ধকতা জয় করে ২০২১ সালের এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ অর্জন করেন তামান্না। ঝিকরগাছা উপজেলার বাঁকড়া ডিগ্রি কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে তিনি উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ নেন। এর আগে তামান্না ২০১৯ সালে যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার বাঁকড়া জনাব আলী খান মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেও একই ফল অর্জন করেছিলেন। জিপিএ-৫ পেয়েছেন পিইসি ও জেএসসি পরীক্ষায়ও।
তামান্নার জন্ম থেকে সংগ্রামের ইতিহাস তুলে ধরে পরিবারের সদস্যরা জানান, ২০০৩ সালের ১২ ডিসেম্বর যশোরের ফাতেমা হাসপাতালে খাদিজা পারভিন শিল্পী একটি কন্যাসন্তান জন্ম দেন। যার দুটি হাত ও একটি পা নেই। এই সন্তান তামান্না নুরাকে বুকে চেপে বাড়ি ফেরেন বাবা-মা। এরপর থেকে অনেক প্রতিকূলতা মোকাবিলা করতে হয় তাদের।
অভাবের সংসার। তারপরও বেড়ে ওঠা শিশুটির চাহনি, মেধা মা শিল্পীর মনে সাহস জোগান দিয়েছিল। মায়ের কাছে প্রথমে অক্ষর জ্ঞান নিতে থাকে তামান্না। বাসা থেকে দূরবর্তী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি করা সহজ ছিল না। বাসা সংলগ্ন শিশু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আজমাইন এডাস স্কুলে তাকে নার্সারিতে ভর্তি করা হয়। মা স্কুলের ক্লাসে বাচ্চাকে বসিয়ে দিয়ে ক্লাসের বাইরে অবস্থান করতেন। প্রখর মেধাবী তামান্না একবার শুনলে পড়া আয়ত্ত করে মুখস্থ বলতে পারত। এরপর অক্ষর লেখা শুরু করে পায়ের আঙুলের ফাঁকে চক ধরে। তারপর কলম দিয়ে লেখা আয়ত্ব করে সে। বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টানো, আঙুলের ফাঁকে চিরুনি, চামচ দিয়ে খাওয়া, চুল আঁচড়ানো সহজে আয়ত্ব করে তামান্না।
ধীরে ধীরে নিজের ব্যবহৃত হুইল চেয়ারটি এক পা দিয়ে চালানোর দক্ষতা অর্জন করে। নিজ বিদ্যালয়ে কেজি, প্রথম শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণিতে ফলাফলে মেধা তালিকার পাশাপাশি এডাস বৃত্তি পরীক্ষায় প্রতিবার সে বৃত্তি পায়। লেখাপড়ার ধারাবাহিকতায় ২০১৩ সালে আজমাইন এডাস স্কুল থেকে পিইসি ও ২০১৬ সালে বাঁকড়া জে কে মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে জেএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে কৃতিত্বের সাক্ষর রেখে জিপিএ-৫ পেয়েছিল। এরপর ২০১৯ সালে এসএসসি পরীক্ষায় এবং ২০২১ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ পান তামান্না।
তামান্নার বাবা রওশন আলী বলেন, অনেক স্বপ্ন নিয়ে তামান্না সংগ্রাম করে চলেছে। একটি একটি করে সে স্কুল-কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। তার মা তাকে হুইল চেয়ারে করে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে যায়। তামান্নার জন্য গ্রামের বাড়ি ছেড়ে যবিপ্রবির সামনে একটি বাসা ভাড়া নিয়েছে। ছোট দুই ছেলেমেয়েকে বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল অ্যান্ড কলেজে ভর্তি করেছে। বাসা ভাড়া, সন্তানদের লেখাপড়া, থাকা খাওয়া নিয়ে তাকে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করতে হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, নন-এমপিও স্কুলে বেতন নেই। মাদরাসা এবং বাঁকড়ায় তিন-চারটি ব্যাচে ছাত্রছাত্রী পড়াই। টিউশনির টাকায় কোনোমতে চলতে হচ্ছে। তারপরও মেয়ের সংগ্রামের দিকে তাকিয়ে সব কষ্ট সয়ে এগিয়ে যাচ্ছি।