বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১০:১৬ অপরাহ্ন

সংকট কাটেনি নিম্নমানের প্রযুক্তি পণ্যে ঝুঁকছেন ক্রেতারা

নিজস্ব প্রতিবেদক: মহামারি করোনার পর থেকে ল্যাপটপ, কম্পিউটারের দাম দিন দিন বাড়ছে। গত বছরের বাজেটে প্রযুক্তি পণ্যের ওপর ভ্যাট ও ইউরোপে যুদ্ধের কারণে পণ্যের দাম চলে গেছে ক্রেতার নাগালের বাইরে। সাধারণ কনফিগারেশনের ল্যাপটপ ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকার নিচে মিলছে না। অন্যদিকে মনিটর, সিপিউর দামও আকাশচুম্বি। রয়েছে প্রসেসর, প্রিন্টার, র‌্যাম ও অ্যাকসেসরিজ সংকট।

অন্যদিকে দাম বাড়ায় পাড়া-মহল্লার কম্পিউটার দোকানে নন চ্যানেলে আনা প্রযুক্তি পণ্যের বিক্রি বেড়েছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি ও এলসি জটিলতায় এক বছরের ব্যবধানে প্রযুক্তি পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি পেয়েছে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ। তাদের বেচাকেনাও কমেছে। ক্রেতারা বাধ্য হয়ে নিম্নমানের লাগেজ পার্টির পণ্য কিনছেন। প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে প্রযুক্তি পণ্যের উচ্চমূল্য বড় বাধা বলে জানান খাত সংশ্লিষ্টরা।

অন্যদিকে ক্রেতারা বলছেন, গত দুই বছরে প্রযুক্তি পণ্যের দাম ক্রেতাদের নাগালের বাইরে চলে গেছে। মোটামুটি ভালো কনফিগারেশনের ল্যাপটপ মিলছে না ৫০ হাজার টাকার নিচে। অন্যদিকে পিসি বিল্ড বা পূর্ণাঙ্গ পিসি পেতে খরচ করতে হচ্ছে ৩০ হাজার টাকার বেশি। আবার প্রযুক্তি পণ্য সারাতেও খরচ বাড়ছে। যুদ্ধের প্রভাব স্বীকার করে তারা বলছেন, সরকারকে এখাতে ভর্তুকি দিতে হবে। কিংবা দেশীয় ইলেকট্রনিক প্রতিষ্ঠানগুলোর পণ্যের মান ভালো করতে এগিয়ে আসতে হবে।

বিসিএস কম্পিউটার সিটিতে বন্ধুদের সঙ্গে গেমিং পিসি কিনতে এসেছেন কলেজপড়ুয়া সাজেদুল ইসলাম।  তিনি বলেন, অন্য দেশে ল্যাপটপ ও পিসির দাম কম। সেখানে ভ্যাট, ট্যাক্সও কম। বাংলাদেশের গ্রে মার্কেটে (নন চ্যানেল) আবার দাম কম। কিন্তু সেখানে পণ্য নিম্নমানের। রিফারবিশড, সার্ভিসিং ভালো নয়।

তিনি বলেন, আগে যেখানে ৮০ হাজার টাকায় একটা গেমিং ল্যাপটপ কেনা যেতো সেটা এখন ১ লাখ ২০ হাজার টাকার ওপরে। আমাদের এখানে দাম অনেক বেশি। এ জন্য অনেকেই এখন বিদেশ থেকে ল্যাপটপ আনছেন। দামও কম পড়ে ল্যাপটপ ব্যাগসহ অনেক কিছু বিনামূল্যে পাওয়া যায়।

বাজারে ইনটেল ও এমডি প্রসেসরের সংকট আছে। ল্যাপটপ, মনিটর, মাদার বোর্ডসহ অন্য অ্যাকসেসরিজের সংকট আছে। তবে সেটা সাময়িক। কিন্তু দাম দিন দিন বাড়ছে। এবং এটা আরও বাড়বে। প্রযুক্তি পণ্যের বাজার সম্পর্কে জানতে চাইলে  এমনটাই জানান বিসিএস কম্পিউটার সিটির ফাসট্র্যাক সলিউশনের বিজনেস কো-অর্ডিনেটর মুনিম রহমান।

তিনি বলেন, প্রযুক্তি পণ্যের দাম বাড়ছে এটা নতুন কোনো কথা নয়। সারাবিশ্বের মতো বাংলাদেশেও বাড়ছে। কিন্তু এখানে ভ্যাট, ট্যাক্স দিয়ে সেটা মূল্য আকাশচুম্বি হয়ে গেছে। বাজারে নতুন নতুন পণ্য আসছে। গতকাল যে পণ্য বাজারে ছিল আজ তার বদলে অন্য পণ্য এসেছে। কম দামেরও কিছু নতুন পণ্য আসে। কিন্তু যেহেতু এলসি করতে এখন অনেক ঝামেলা, ডলার সংকট আমরা এখন নতুন পণ্য কম আনতে পারছি।

চলতি বছরের শুরুতে প্রযুক্তি পণ্যের বিক্রি বাট্টাও ভালো হয়নি। এমনকি গত বছরের ডিসেম্বরে বিসিএস কম্পিউটার সিটিতে প্রযুক্তি পণ্যের মেলা জমেনি বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। গত ৭ ডিসেম্বর শুরু হওয়া মেলা চলে ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। মেলায় সাধারণ সময়ের মতোই বিক্রি হয়েছে। মেলার উদ্বোধন অনুষ্ঠানে ডাক টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারকে প্রযুক্তি খাতের চলমান অস্থিরতা সম্পর্কে অবহিত করা হলে, তিনি সেটা দেখবেন বলে ব্যবসায়ীদের আশ্বস্ত করেন।

বাজার ঘুরে দেখা যায়, এইচপি ব্র্যান্ডের এম ২২ এফ ২২ ইঞ্চি মনিটরের দাম গত বছর ছিল ১২ হাজার টাকা, বর্তমানে তা ১৭ হাজার টাকা। ইন্টেল কোর আই৫, ১১ জেনারেশনের প্রসেসরের দাম ছিল ১৬ হাজার টাকা, বর্তমান দাম ২০ হাজার ৮৩০ টাকা। ইনটেল ১১ জেনারেশনের প্রসেসর, ৫১২ জিবি এসএসডি, ১৫.৬ ইঞ্চি ফুল এইচডি ডিসপ্লেসমৃদ্ধ এইচপির প্রোবুক ৪৫০ জি৮ মডেলের ল্যাপটপের দাম ছিল ৭৫ হাজার টাকা। সেটির বর্তমান দাম ৯২ হাজার ৫০০ টাকা। একই ভাবে সব পণ্যের দাম ২০ থেকে ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।

বিক্রেতাদের একজন বলেন, ভ্যাট-এআইটিসসহ আরও ১৫ শতাংশ যোগ হয়েছে গত বাজেটে। তার আগে ছিল ১৫ শতাংশের মতো। ভ্যাট দেয় ক্রেতা এটা ঠিক, তবে দাম যখন বেশি হয় এই মন্দার সময় ক্রেতা কিনতে পারেন না।

বিসিএস কম্পিউটার সিটির সভাপতি এ এল মজহার ইমাম চৌধুরী জানান, দেশে ৫ থেকে ১০ শতাংশ লোক কম্পিউটার কেনার সামর্থ্য রাখে। প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে প্রযুক্তি পণ্যের বাড়তি দাম বড় বাধা। আমাদের বিক্রি কিছুটা কম হলেও, ব্যবসা চালিয়ে যেতে হবে।

বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট ও সাইবার কমিউনিকেশনের মালিক নাজমুল আলম ভুইয়া  বলেন, ডলারের দাম স্থিতিশীল নয়। এলসি করতে সমস্যা হচ্ছে। বিদেশি কোম্পানিগুলো এলসি রিসিভ করে পণ্য পাঠাতে দু-তিন মাস দেরি করছে। এর মধ্যে দেখা যাচ্ছে পণ্যের দাম কিছুটা বেড়ে যায়। ভ্যাট, এআইটির বাড়তি বোঝা আছেই। সব মিলে বলা যায় প্রযুক্তি পণ্যে সুখবর নেই।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগামী বাজেটে প্রযুক্তি পণ্যের ওপর ভ্যাট না কমালে প্রযুক্তি পণ্য কেবল উচ্চবিত্তের পণ্য হয়ে যাবে। কেননা চীনে নতুন করে করোনা সংক্রমণ ও তাইওয়ানে যুদ্ধের ডামাডোল বাজছে।

বিক্রি বাড়ছে নন চ্যানেল পণ্যের, আছে ঝুঁকি

বৈধপথে আনা প্রযুক্তি পণ্যের দাম আকাশচুম্বি হওয়ায় বিদেশ থেকে আনা টানা পণ্য, রিফারবিশড ও সেকেন্ড হ্যান্ড প্রযুক্তি পণ্যের বিক্রি বেড়েছে বলে ব্যবসায়ীরা দাবি করেন।

বিসিএস কম্পিউটর সিটির ব্যবসায়ী আশরাফুল বলেন, মানুষ কম দামে পণ্য চায়। এখন পাড়া-মহল্লাসহ বিভিন্ন মার্কেটে নন চ্যানেলে আনা প্রযুক্তি পণ্যের বিক্রি বেড়ে গেছে। ধরেন আসুস ভিভোবুক ১৫ যেটা এখন ৫০ হাজার থেকে ৫২ হাজার টাকা চলছে, সেটা নন চ্যানেলের দোকানে ৩৮ থেকে ৪০ হাজার টাকা। দাম কম হলেও ক্রেতারা প্রতারিত হচ্ছেন, কেননা তারা নতুন পণ্য পাচ্ছেন না। আবার নষ্ট হলে সার্ভিসিংটা ভালো পাচ্ছেন না।

আগারগাঁওয়ের কম্পিউটার সিটির টেক ভ্যালির সিনিয়র সেলস এক্সিকিউটিভ আবদুল্লাহ আমির ফাহাদ  বলেন, এখন আর সারা বছর ধরে ল্যাপটপ কিংবা কম্পিউটারের প্রয়োজন হয় না। জুম ক্লাস স্মার্ট ফোনেই হয়। ছোট উদ্যোক্তারা বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো এখন ল্যাপটপ, কম্পিউটার কিনছে। কিন্তু তারা ঝুঁকছে নন চ্যানেল পণ্যে। এর বাজার আগেও ছিল, তবে সম্প্রতি জনপ্রিয় হয়েছে। এতে নিরাপত্তা ঝুঁকি যেমন আছে। তেমনি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে দ্রুত।

তিনি বলেন, সাধারণ মানুষ প্রযুক্তি পণ্য খুব কম চেনে। তাদের রিফাব্রিষড (নষ্ট পণ্য ঠিক করে বিক্রি করা) পণ্য ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বলছে এগুলো দুবাই, ইউকে থেকে আনা। দাম কিছুটা কম। কারওটা টিকছে কিছুদিন, কারওটা টিকছে না। নষ্ট হলে তারাই সার্ভিসিং করছে। এটা আসলে তারা ক্রেতাদের সঙ্গে প্রতারণা করছে।

 

নিউজটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © gtbnews24.com
Web Site Designed, Developed & Hosted By ALL IT BD 01722461335