শনিবার, ০২ ডিসেম্বর ২০২৩, ০২:১৪ পূর্বাহ্ন
নিজস্ব প্রতিবেদক: জামালপুর জেলায় বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে রয়েছে চরাঞ্চল। এসব চরে জন্মে ভুট্টা, কাঁচামরিচসহ বিভিন্ন প্রকার অর্থকরী ফসল। কিন্তু দুর্গম যোগাযোগ ব্যবস্থা এখানকার প্রধান অন্তরায়। কৃষক ফসল উৎপাদন করেও অনেক সময় ন্যায্যমূল্য বঞ্চিত হন যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে। দেশের অর্থনীতিতে সুবাতাস আনতে পারে চরের ফসলের ঐশ্বর্য। অথচ সড়ক যোগাযোগের দুর্গমতাই দুর্বিষহ করে তুলেছে জামালপুরের এই চরজীবন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, জামালপুরের সাত উপজেলায় মোট চরের আয়তন ৪৭ হাজার ৮৯৩ হেক্টর। এর মধ্যে জামালপুর সদরে ৮ হাজার ৫১ হেক্টর, সরিষাবাড়িতে ৮ হাজার ৩৩০ হেক্টর, মেলান্দহে ৬ হাজার ১৫০ হেক্টর, ইসলামপুরে ৮ হাজার ২৫০ হেক্টর, দেওয়ানগঞ্জে ৭ হাজার ৩৫০ হেক্টর, মাদারগঞ্জে ৫ হাজার ১০০ ও বকশীগঞ্জে ৪ হাজার ২৬২ হেক্টর চরাঞ্চল রয়েছে।
উপজেলা সদর থেকে অনেকটা পথ গিয়ে এরপর যমুনা কিংবা এর শাখা নদী পেরিয়ে যেতে হয় চরগুলোতে। কোনো কোনো চরে এখনো সেভাবে রাস্তাঘাটও তৈরি হয়নি। বালুচরে হাঁটাপথ কিংবা বাহন বলতে মোটরসাইকেল কিংবা ঘোড়ার গাড়ি। কোথাও রাস্তা থাকলেও তা ভেঙেচুরে প্রায় চলাচলের অনুপযোগী।
হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে সহজে হাসপাতালে যাওয়ারও উপায় নেই চরের মানুষের। চরে ফলানো ফসলের নির্বিঘ্ন বাজারজাতকরণেও প্রতিবন্ধকতা যোগাযোগ দুর্গমতা। তাই উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত ও চরের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে যোগাযোগ ব্যবস্থার দিকে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন চরবাসী।
সরিষাবাড়ী উপজেলা শহর থেকে গাড়িতে ঘণ্টাখানেক গেলেই যমুনার শাখা নদী। এরপর ট্রলারে নদী পাড়ি দিতে লাগে আধাঘণ্টার মতো। ট্রলার যেভাবে নামিয়ে দেয় সেখান থেকে বসতি আরও দূর। ধু-ধু বালুচর পেরিয়ে সেখানে যেতে হয়। এ পথে যাতায়াতের মাধ্যম মোটরসাইকেল ও ঘোড়ার গাড়ি। এছাড়া হাঁটা ছাড়া উপায় নেই। মোটরসাইকেলে ২০ মিনিটের মতো গেলেই নলসন্ধ্যা গ্রাম। সরিষাবাড়ীর পিংনা ইউনিয়নের এ গ্রামে ৭ হাজারের মতো মানুষের বাস।
এ চরে প্রচুর পরিমাণে মরিচ, ভুট্টা ও সবজি হয়। কিন্তু যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না হওয়ায় অন্যান্য চরের বাসিন্দাদের মতো কঠিন এ চরের মানুষের জীবন।
দেওয়ানগঞ্জের মন্ডলের বাজার থেকে খোলাবাড়ির দূরত্ব প্রায় তিন কিলোমিটার। খোলাবাড়ি চর এলাকা। এ তিন কিলোমিটার সড়কটি স্থানীয়দের কাছে দুঃস্বপ্নের মতো। বর্ষাকালে এ সড়ক ঘেঁষে চলা ব্রহ্মপুত্রের শাখা নদীর সঙ্গে যমুনার স্রোত মেশায় সড়কের অনেকটা অংশ ধুয়ে গেছে। মন্ডলের বাজার থেকে একটু এগোলেই সড়কের এ ভাঙা অংশ। কোনো যানবাহন এ অংশটুকু পার হতে পারে না। শুকনো মৌসুমে মানুষকে হেঁটে পার হতে হয়। এক হাঁটু ধুলায় ডুবে থাকে। অগত্যা মালবাহী কোনো যানবাহন নিতে হলে দীর্ঘ সময় ধরে ঠেলেঠুলে নানান কায়দা-কসরত করে তবেই এ জায়গা পার করতে হয়।
বর্ষা মৌসুমে এ অংশটুকু পার হতে হয় নৌকায় ঝুঁকি নিয়ে। অনেক সময় নৌকাও পাওয়া যায় না। খোলাবাড়ির যমুনা নদী পর্যন্ত বাকি পথও একেবারে ভাঙাচোরা। কোথাও কোথাও পিচের চিহ্নও নেই, কিছু নুড়্পিাথর পড়ে রয়েছে।
মন্ডলের বাজারের কাছে ভাঙা অংশে দেখা গেছে, চর থেকে ইউক্যালিপ্টাস গাছ কেটে গুঁড়ি আনা হয়েছে দুটি ইঞ্জিনের ভ্যানগাড়িতে। কিন্তু দীর্ঘ সময়ে তারা ওই স্থানটি পার হতে পারেনি। একটি ভ্যানগাড়ি গাছের গুঁড়িসহ ধুলায় আটকে যেতে দেখা যায়।
মন্ডলের বাজারের কাছে এ রাস্তায় কথা হয় মো. আলীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘বর্ষাকালে এ রাস্তাটা নিয়ে আমাদের দুর্ভোগের সীমা থাকে না। নৌকা ছাড়া এ পথটুকু পার হওয়া যায় না। অনেক সময় পারাপারে নৌকাও পাওয়া যায় না। কেউ হঠাৎ অসুস্থ হলে তো মরণ ছাড়া উপায় নাই।’
এ রাস্তায় অটোরিকশা চালান আনোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, ‘মন্ডলের বাজারের কাছে ভাঙার পর আর আমরা যাইতে পারি না। যেটুকু রাস্তা আছে সেখানেও ভাঙার শেষ নেই। বহুদিন রাস্তাটা এভাবে পড়ে আছে দেখার কেউ নেই।’
চিকাজানী ইউনিয়নের খোলাবাড়ির পাশে চর মুগরীর বাসিন্দা শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘এ চরে অনেক ভুট্টা হয়। মরিচও হয়। ভুট্টা ও মরিচের ফলন অনেক বেড়েছে। এ দুই ফসলের চাহিদা থাকায় দামও পাওয়া যায়, ক্ষেত থেকেই ফসল বিক্রি হয়ে যায়। কিন্তু রাস্তাটা (মন্ডলের বাজার-খোলাবাড়ি সড়ক) ভালো থাকলে আমরা দ্বিগুণ দাম পেতাম।’
খোলাবাড়ী বাজারের চর ফসল বিপণন কেন্দ্রের সমন্বয়ক মো. সোনা মিয়া বলেন, ‘বর্ষাকালে আমাদের দুর্ভোগটা বেশি হয়। রাস্তার ভাঙা অংশটি নৌকা দিয়ে পার হতে হয়। অনেক সময় দেখা যায় জরুরি রোগী হাসপাতালে নিতে হবে কিন্তু নৌকা নেই। সন্ধ্যার পরই নৌকা চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু তখন জরুরি দরকার হলে কিছু করার থাকে না। অনেক সময় ট্রেনের যাত্রী ওখানে এসে আটকে থাকে।’
তিনি বলেন, ‘এখন অটো চললেও ভাঙা অংশ পর্যন্ত যাওয়া যায়। ভাঙার এক হাঁটু ধুলা পার হয়ে ওই পাশে গিয়ে আবার অটো নিতে হয়।’
সোনা মিয়া আরও বলেন, ‘আগে এ রাস্তায় বড় গাড়ি ঢুকতো। এখন কোনো মালের গাড়ি ঢুকতে পারে না। তিন বছরে ধরে এ রাস্তা এমন হয়ে আছে। এখানে হাজার হাজার একর জমিতে ভুট্টা হয়, মরিচ হয়, বাদাম হয়। এটা কৃষিপ্রধান এলাকা। দেখা গেছে, ঢাকা যাইতে যে টাকা খরচ হয়, এ ভাঙা পার হয়ে মন্ডলের বাজার যাইতে সেই খরচ হয়। এ রাস্তাটা ভালো থাকলে কৃষক তার ফসলের আরও ভালো দাম পাইতো।
হাজার হাজার মানুষের চালাচলের রাস্তাটি দ্রুত মেরামত করতে সরকারের কাছে অনুরোধও জানান তিনি।
চিকাজানী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আশরাফুল ইসলাম আক্কাস বলেন, ‘মন্ডলের বাজার থেকে খোলাবাড়ির রাস্তাটি সংস্কারের জন্য আমরা এলজিইডির (স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর) সঙ্গে কথা বলছি। এরই মধ্যে মন্ডলের বাজারের সড়কের কাজ শুরু হয়েছে।’
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের জামালপুর আঞ্চলিক কার্যালয়ের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. মঞ্জুরুল কাদির বলেন, ‘চরাঞ্চলে ভালো ফসল হলেও এখানে বাজারজাতকরণ একটি বড় সমস্যা। কারণ দুর্গম যোগাযোগ ব্যবস্থা। কোনো কোনো চর থেকে বাজারে আসতে হলে দু-তিন ঘণ্টা নৌকায় চড়ে ভাঙা রাস্তা পেরিয়ে যেতে হয়। তাই এটি কৃষকের ন্যায্যমূল্য পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক।’
তিনি বলেন, ‘এক্সট্রিম চরে সরকারি যে সাহায্য-সহযোগিতা আছে সেটাও পৌঁছায় না। দেওয়ানগঞ্জ, ইসলামপুর ও সরিষাবাড়ীতে অনেক দুর্গম চর রয়েছে।’
সুইজারল্যান্ড ও বাংলাদেশ সরকারের যৌথ অর্থায়নে ‘মেকিং মার্কেটস ওয়ার্ক ফর দ্য চরস (এমফোরসি) প্রকল্পের জামালপুরের ইন্টারভেনশন স্পেশালিস্ট মো. শামসুল আলম বলেন, ‘জামালপুরের চরাঞ্চলের দুর্গম যোগাযোগ ব্যবস্থা একটি চ্যালেঞ্জ। বিভিন্ন ট্রেনিংয়ের ক্ষেত্রে অনেক সময় কোনো চরে আমাদের কর্মীদের থেকে যেতে হয়, পরদিনের ট্রেনিংটা করানোর জন্য। কোথাও কোথাও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আমরা বিশেষ নৌকা দিয়ে নিয়ে যাই। সরিষাবাড়ী ও ইসলামপুরের চরের যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই খারাপ।’