শনিবার, ০২ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:৫৪ পূর্বাহ্ন

গাইবান্ধা-৫ আসনের উপ-নির্বাচন লাঙল-নৌকার ‘প্রেস্টিজ ইস্যু’

নিজস্ব প্রতিবেদক: গাইবান্ধা-৫ (সাঘাটা-ফুলছড়ি) আসনে গত ১২ অক্টোবরের উপ-নির্বাচনকে কেন্দ্র করে হাট-বাজার ও চায়ের দোকানগুলোতে যেভাবে আলোচনার ঝড় উঠেছিল, কিন্তু বাতিল হয়ে যাওয়া ওই নির্বাচনের দ্বিতীয় দফায় ভোটগ্রহণের আগে তার বিপরীত চিত্র দেখা যাচ্ছে। বুধবার (৪ জানুয়ারি) এ আসনের উপ-নির্বাচনে ফের ভোগগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে।

সে হিসাবে উত্তাপে নির্বাচনী এলাকা সরগরম হয়ে ওঠার কথা থাকলেও তা একেবারেই উত্তাপহীন। এবার ভোটকেন্দ্রে ভোটার আনাটাই চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রার্থীদের।

গত ১২ অক্টোবরের নির্বাচনে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার ফলে ভোট বন্ধ করে দেওয়ার বিষয়টি ভোটারদের মন খারাপের প্রধান কারণ বলে জানান একাধিক ভোটার। তারপরও আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টির সমর্থকরা দিনরাত সভা-সমাবেশ, উঠান বৈঠক, ভোটারদের দ্বারে দ্বারে গিয়ে ভোট প্রার্থনা করেছেন। প্রচার-প্রচারণা শেষে এখন চলছে ভোটের চুলচেরা হিসেব-নিকেষ। এ দুই দলের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা এ নির্বাচনকে ‘প্রেস্টিজ ইস্যু’ হিসেবে দেখছেন।

গাইবান্ধা-৫ আসনের উপ-নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী মাহমুদ হাসান রিপন, জাতীয় পার্টির এ এইচ এম গোলাম শহীদ রঞ্জু, বিকল্পধারা বাংলাদেশের জাহাঙ্গীর আলম, স্বতন্ত্র সৈয়দ মাহবুবুর রহমান প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তবে অপর স্বতন্ত্র প্রার্থী (আপেল মার্কা) নাহিদুজ্জামান নিশাত উপ-নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন না বলে সংবাদ সম্মেলনে জানিয়ে ভোটের মাঠ থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন।

নির্বাচনকে ‘প্রেস্টিজ ইস্যু’ ও ‘অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই’ হিসেবে দেখছেন আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির নেতাকর্মী-সমর্থকরা। এবারই প্রথম এ আসনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোটের মাধ্যমে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হতে যাচ্ছে। নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর বিজয় নিশ্চিত করতে সব নির্বাচনী কৌশল নিয়ে ভোটের মাঠে সক্রিয় রয়েছেন বড় দুই দলের নেতাকর্মীরা।

ভোটারদের দৃষ্টিতে এখন পর্যন্ত মাঠের লড়াইয়ে এগিয়ে রয়েছে লাঙল ও নৌকা। তবে পিছিয়ে নেই বিকল্পধারা ও স্বতন্ত্র প্রার্থীও। এ এলাকা একসময় লাঙ্গলের ঘাঁটি বলে পরিচিত ছিল। তবে সেই চিত্র এখন পাল্টে গেছে। সাধারণ মানুষের একটি বড় অংশ লাঙ্গলের পক্ষে থাকলেও সচেতন নাগরিকদের ভোটের হিসাব-নিকাশ উল্টো। তারা চাইছেন এলাকার উন্নয়ন। আর সাধারণ মানুষের আবেগে রয়েছে ‘এরশাদপ্রীতি’। এসব কারণেই এ উপ-নির্বাচনে নৌকার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী এখন লাঙল।

ফুলছড়ি উপজেলার ছালুয়া গ্রামের আবদুল সোবহান (৬৫) বলেন, আমাদের দরকার ফজলে রাব্বী মিয়ার মতো একজন মানুষ। এবার আরেকজন ফজলে রাব্বী বানাতে হবে। তাই ভেবে-চিন্তে দিতে হবে ভোট।

ফুলছড়ির গণমাধ্যমকর্মী শাহ আলম যাদু বলেন, এ উপ-নির্বাচনে পাঁচজন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এর মধ্যে তিনজনই অতিথি পাখি। তাদের মধ্যে একজন ভোট করবেন না ঘোষণা দিয়েছেন। অন্য দুই প্রার্থীকে কেবল ভোটের সময় দেখা যায় ফুলছড়ি-সাঘাটা উপজেলায়। তবে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে নৌকা আর লাঙ্গলের মধ্যে।

তিনি আরও বলেন, যারা দীর্ঘসময় ধরে এলাকার উন্নয়নে কাজ করছেন, তাদেরকেই ভোট দেওয়া উচিত ভোটারদের।

নির্বাচন বিষয়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মাহমুদ হাসান রিপন বলেন, উপ-নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে। নৌকা উন্নয়নের প্রতীক। এ প্রতীকে ভোট দিলে দেশের উন্নয়ন হয়। ভোটাররা নৌকায় ভোট দিতে ভুল করবেন না। আমি নির্বাচিত হলে গাইবান্ধার বালাসি থেকে জামালপুরের বাহাদুরাবাদ পর্যন্ত টানেল নির্মাণ ও ভাঙনরোধে স্থায়ী ব্যবস্থার উদ্যোগ নেবো।

জাতীয় পার্টি মনোনীত প্রার্থী গোলাম শহীদ রঞ্জু বলেন, ১২ অক্টোবর নির্বাচনটি বাতিল হওয়ার মধ্য দিয়ে জনগণের অধিকার আবার ফিরে এসেছে। ভোটে যদি জালিয়াতি-কারচুপি না হয় অবশ্যই প্রয়াত রাষ্ট্রপতি এরশাদের লাঙল প্রতীককে ভোটাররা বিজয়ী করবেন বলে আমার বিশ্বাস।

সাঘাটা ও ফুলছড়ি দুই উপজেলার ১৭টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত গাইবান্ধা-৫ আসন। বুধবার (৪ জানুযারি) ইভিএমে ১৪৫টি কেন্দ্রের ৯৫২টি বুথে ভোটগ্রহণ করা হবে। সাঘাটা উপজেলার ২ লাখ ২৫ হাজার ৭০ জন এবং ফুলছড়ি উপজেলার ১ লাখ ১৪ হাজার ৬৭৬ জনসহ মোট ৩ লাখ ৩৯ হাজার ৭৪৩ জন ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন।

এই আসনে স্বাধীনতার পর থেকে ১১টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্যে পাঁচবার জাতীয় পার্টি, চারবার আওয়ামী লীগ ও দুইবার বিএনপি জয়লাভ করেছে। ১৯৭৩ সালে প্রথম নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ওয়ালিউর রহমান রেজা, ১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় নির্বাচনে বিএনপির রোস্তম আলী মোল্লা, ১৯৯৬ সালের (১৫ ফেব্রুয়ারি) ষষ্ঠ নির্বাচনে বিএনপির মতিউর রহমান এবং ২০০১ সালের অষ্টম নির্বাচনে বেগম রওশন এরশাদ জয়লাভ করেন।

অপরদিকে, এই আসনে ১১টি নির্বাচনের মধ্যে সাতবারই জয়লাভ করেছেন প্রয়াত ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়া। তিনি ১৯৮৬ সালের তৃতীয়, ১৯৮৮ সালের চতুর্থ, ১৯৯১ সালের পঞ্চম, ১৯৯৬ সালের সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির মনোনয়নে গাইবান্ধা-৫ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৮৯ সালে তিনি আইন প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেন। ২০০৮ সালের নবম, ২০১৪ সালের দশম ও ২০১৯ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে সংসদে যান। পঞ্চম ও সপ্তম সংসদে তিনি বিরোধীদলীয় হুইপ ছিলেন। দশম সংসদে ডেপুটি স্পিকারের চেয়ারে বসেন ফজলে রাব্বী মিয়া। একাদশ সংসদেও টানা দ্বিতীয় মেয়াদে ডেপুটি স্পিকারের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন।

গাইবান্ধা জেলা প্রশাসক মো. অলিউর রহমান বলেন, দুই উপজেলার ১৭টি ইউনিয়ন নিয়ে গাইবান্ধা-৫ আসন। নির্বাচনের দিন প্রতি ইউনিয়নে একজন করে মোট ১৭ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও দুজন জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট দায়িত্ব পালন করবেন। পাশাপাশি কয়েক প্লাটুন বিজিবি ও অস্ত্রধারী আনসার সদস্য থাকবেন।

নির্বাচন কমিশনার রাশেদা সুলতানা বলেন, সব পক্ষকে নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করতে হবে। যাতে ভোটারদের মাঝে আস্থা তৈরি হয় এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করা সম্ভব হয়। নির্বাচনে দায়িত্বরত কেউ অবহেলা ও পক্ষপাতিত্বমূলক আচরণ করলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

গাইবান্ধা-৫ আসনের সংসদ সদস্য ও ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী ২৩ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। নির্বাচন কমিশন আসনটি শূন্য ঘোষণার পর ১২ অক্টোবর উপ-নির্বাচনের দিন ধার্য হয়। ভোটে অনিয়মের অভিযোগে তা বাতিল করা হয়। গত ১৪ নভেম্বর ওই অনিয়মের প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়। তদন্তে ১২৫ জন প্রিজাইডিং অফিসার ও পাঁচ কেন্দ্রের পাঁচজন পুলিশ উপ-পরিদর্শকের বিরুদ্ধে দায়িত্ব অবহেলার প্রমাণ পাওয়ার কথা জানান সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল। তদন্ত শেষে গত ৬ নভেম্বর আগারগাঁও নির্বাচন ভবনে নির্বাচন কমিশন সচিব জাহাঙ্গীর আলম আগামী ৪ জানুয়ারি গাইবান্ধা-৫ আসনের উপ-নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেন।

 

নিউজটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © gtbnews24.com
Web Site Designed, Developed & Hosted By ALL IT BD 01722461335