শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৮:৩৩ পূর্বাহ্ন

খালেদা জিয়ার নির্বাচনী আসন কোণঠাসা এমপি শিরীন আখতার, বিএনপির কান্ডারি মজনু

নিজস্ব প্রতিবেদক: ফুলগাজী, পরশুরাম ও ছাগলনাইয়া উপজেলা নিয়ে গঠিত ফেনী-১ আসনে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বসতভিটা। এখান থেকে টানা চারবার নির্বাচিত হন তিনি। ২০১৪ সালে মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে এখানে নির্বাচিত হন সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ-ইনু) সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার। পরপর দুবারের এমপি তিনি। দুই দফায় এমপি থেকেও আওয়ামী লীগ নেতাদের চাপে অনেকটা কোণঠাসা এই নেত্রী। আওয়ামী লীগ থেকে এবার মনোনয়নপ্রত্যাশী অনেক। বিএনপিতে খালেদা জিয়া নির্বাচন করতে না পারলে মনোনয়ন চাইবেন ঢাকা দক্ষিণ যুবদলের সভাপতি রফিকুল আলম মজনু।

খালেদা জিয়ার আসন হওয়ায় বিএনপির শক্ত ঘাঁটি এটি। তার ভাই সাঈদ ইস্কান্দার এখানকার দল গোছানোর কাজটি করেছেন দীর্ঘদিন। বর্তমানে ফেনী-১ আসনে বিএনপির সমন্বয়ক রফিকুল আলম মজনু। ঢাকা দক্ষিণ যুবদলের সভাপতি তিনি। কেন্দ্র ও স্থানীয় নেতারা তার ওপরই আস্থা রাখতে চান। মনোনয়নপ্রত্যাশী কম থাকায় সুবিধাজনক অবস্থানে আছে বিএনপি। তবে দলের সাংগঠনিক কার্যক্রম অগোছালো। ফেনী জেলা ও উপজেলায় বিএনপির বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের পূর্ণাঙ্গ কমিটি না থাকায় সাংগঠনিক কার্যক্রম চাঙা হচ্ছে না।

মনোনয়নের বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির রফিকুল আলম মজনু  বলেন, ‘আমি ওখানে কাজ করি, নির্বাচন করবো না কেন? এই আসন আমার দায়িত্বে দেওয়া হয়েছে। ম্যাডাম (খালেদা জিয়া) নির্বাচন করতে পারলে করবেন, নইলে আমি করবো। দল থেকে এটাই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বিগত চার বছর ধরে সেখানে সাংগঠনিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি।’

আওয়ামী লীগে মনোনয়নপ্রত্যাশী অনেক
আওয়ামী লীগ নেতারা মনে করেন, বিএনপির এ শক্ত ঘাঁটিতে টিকে থাকতে হলে জোটের শরিক নয়, দল থেকেই প্রার্থী দেওয়া উচিত। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসন থেকে মনোনয়নপ্রত্যাশী ছাগলনাইয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা চেয়ারম্যান মেজবাউল হায়দার চৌধুরী সোহেল এবং পরশুরাম উপজেলার চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন মজুমদার। আলোচনায় আছেন ফেনী জেলা আওয়ামী লীগের অন্যতম সদস্য ব্যবসায়ী শেখ আবদুল্লাহ।

মেজবাউল হায়দার  বলেন, আগেও আমি মনোনয়ন চেয়েছি। গতবার ক্ষুদ্র স্বার্থ ছেড়ে বৃহৎ স্বার্থের দিকে লক্ষ্য রেখে শিরীন আখতারকে সমর্থন দিতে বাধ্য হয়েছি। তাকে সংসদ সদস্য করে কোনো সুফল আমরা পাইনি। নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে। বিগত দুবার তাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। এটা খালেদা জিয়ার এলাকা। এখানে আওয়ামী লীগের প্রার্থী প্রয়োজন। আমাদের মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ানোর জন্য দলীয় প্রার্থী এখানে প্রয়োজন ছিল। সেখানে জোটের কারণে প্রধানমন্ত্রী তাকে মনোনয়ন দিয়েছেন।

১৯৯০, ১৯৯৬, ২০০১ ও সবশেষ ২০০৮ সালে আসনটি থেকে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। দীর্ঘ ২৪ বছর (১৯৯০-২০১৪) আওয়ামী লীগের কোনো প্রার্থী জয় পাননি এ আসন থেকে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নেওয়ায় জাসদের সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার নৌকা প্রতীকে নির্বাচিত হন। ২০১৮ সালেও নির্বাচিত হন তিনি।

তবে দলটির নেতাকর্মীরা মনে করেন এই আসন থেকে ফলাফল বের করতে হলে দিতে হবে স্থানীয়, জনপ্রিয় ও ক্যারিশম্যাটিক কাউকে। এক্ষেত্রে তাদের পছন্দ শেখ হাসিনার সাবেক প্রটোকল অফিসার আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিম।

জানা যায়, এক যুগেরও বেশি সময় ধরে ফেনী আওয়ামী লীগের অঘোষিত নিয়ন্ত্রক আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা আলাউদ্দিন নাসিম। পর্দার অন্তরালে থেকে জেলা আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ-সংগঠনকে নিয়ন্ত্রণ করছেন তিনি। নেতাকর্মীরা তাকে চাইলেও তিনি সব সময় পর্দার অন্তরালে থাকতে পছন্দ করেন।

নিজে মনোনয়নপ্রত্যাশী হলেও পরশুরাম উপজেলার চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন মজুমদার চান ফেনী-১ আসনে আলাউদ্দিন আহমেদ নাসিমকে।  তিনি বলেন, তৃণমূলের কর্মী হিসেবে আমার কিছু চাওয়া-পাওয়া আছে। আমি পরশুরাম উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। প্রার্থী যদি বাছাই করা হয়, মাঠের প্রার্থী যদি দেওয়া হয় তাহলে এখানে আওয়ামী লীগ পাস করবে। এখানে প্রার্থীর ইমেজ গুরুত্বপূর্ণ।

তিনি আরও বলেন, এখানে নাসিম ভাইকে দেওয়া হলেও আমরা তার পক্ষে কাজ করবো। উনি আওয়ামী লীগের জন্য অনেক কিছু করেছেন। ওনার সুপারিশে অনেকেই মন্ত্রী, এমপি হয়েছেন। উনি এখানে এমপি হলে আমার কোনো দুঃখ নেই। নাসিম ভাই দলমত নির্বিশেষ ভালো ভোট পাবেন।

কান্ডারি ঠিক রেখে এগোতো চায় বিএনপি
স্থানীয়রা বলছেন, খালেদা জিয়ার এলাকা হলেও মাঠে অনুপস্থিত বিএনপি। তবে দলটি সম্প্রতি নিজেদের অবস্থান জানান দিতে চায়। আসনের একাধিক স্থানে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে বিক্ষোভ, মিছিল করেছে দলটি। মামলা ও হামলা অব্যাহত থাকায় বিপাকে নেতারা। অসুস্থতা কিংবা আইনি জটিলতা বা কোনো কারণে খালেদা জিয়া এই আসন থেকে নির্বাচন করতে না পারলে মজনুকে বেছে নেবেন তারা।

রফিকুল আলম মজনু বলেন, কোনো কর্মসূচি হলেই হামলার শিকার হচ্ছি। পুলিশ তাদের (আওয়ামী লীগের) পক্ষে কাজ করছে। নেতাকর্মীদের ওপর নির্যাতন, মিথ্যা মামলা অব্যাহত আছে। এখানকার সংসদ সদস্য এসবের সঙ্গে জড়িত নন। আওয়ামী লীগের লোকজনই করে। প্রায় চার বছর হতে চললো ফেনী জেলায় বিএনপির ছাত্রসংগঠন ছাত্রদলের নতুন কমিটি হয়নি। একইভাবে এ আসনের বিএনপির অনেক অঙ্গ সংগঠনের পূর্ণাঙ্গ কমিটি করা বাকি।

জানতে চাইলে জেলা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক মোরশেদ আলম মিলন  বলেন, কোনো পোস্টার লাগাতে দেয় না, আমরা যা লাগাই সঙ্গে সঙ্গে ছিঁড়ে ফেলে। আমরা প্রতিদিনই কোর্টে হাজিরা দিয়ে যাচ্ছি। মজনু ভাইকে এই এলাকার সমন্বয়কের দায়িত্ব দেওয়ায় উনি এখানে কাজ করছেন। দলীয় হাইকমান্ড তাকে এখানে কাজ করার দায়িত্ব দিয়েছে। এখন মাঠে কেউ নেই। নির্বাচনের সময় নতুন কেউ আসতেও পারেন।

সাংগঠনিক কার্যক্রম প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমাদের কমিটিগুলো পুনর্বিন্যাস হচ্ছে। জেলা কমিটি পূর্ণাঙ্গ করেছি। অন্যান্য কমিটি নিয়ে কাজ করছি। অঙ্গ সংগঠনগুলোর মধ্যে অধিকাংশই হয়ে গেছে। কিছু কমিটি পূর্ণাঙ্গ করা বাকি।

এমপি শিরীনের সব মনোযোগ ছাগলনাইয়ায়
পরশুরাম উপজেলা রোডে কথা হয় স্থানীয় ব্যবসায়ী আবদুল্লাহর সঙ্গে। তিনি বলেন, সংসদ সদস্য আমাদের এখানে আসেন। সবশেষ দুর্গাপূজায় এসেছিলেন। তবে বেশিক্ষণ থাকেননি। ছাগলনাইয়ায় তার নিজের এলাকায় প্রচুর কাজ করেছেন, এখানে কিছু করেননি। শেখ হাসিনার চাওয়ায় তিনি এখানকার সংসদ সদস্য হয়েছেন। কিন্তু পুরো আওয়ামী লীগ তার বিরুদ্ধে।

আগামীতে ভোটে অংশ নেওয়া ও এলাকার মানুষের দাবি-দাওয়া নিয়ে জানতে চাইলে শিরীন আখতার  বলেন, ‘প্রার্থী তো আছিই, এখন তো শুনতে হবে। এগুলো এখন আমি বলতে পারছি না।’

বর্তমান এমপির কার্যক্রম প্রসঙ্গে বিএনপির রফিকুল আলম মজনু বলেন, এই আসনে অনেক সমস্যা আছে। এখানকার বেশিরভাগ লোক বেকার, গরিব। কলকারখানা না থাকায় কর্মসংস্থান হচ্ছে না। রাস্তা-ঘাটের অবস্থাও অনেক খারাপ, ভালো কোনো হাসপাতাল নেই।

আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়নপ্রত্যাশী মেজবাউল হায়দার বলেন, এই এলাকায় কোনো শিল্প-কারখানা হয়নি। সুপেয় পানির ব্যবস্থা নেই। সীমান্ত নিকটবর্তী হওয়ায় মাদকের সমস্যা আছে।

প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা মান-অভিমান ও ক্ষোভের কথা অনেকবার প্রধানমন্ত্রীকে বলেছি। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এবার আওয়ামী লীগ থেকে এই আসনে প্রার্থী দেবেন। আবার শিরীন আখতারও বলেছেন এটাই শেষবার। উনি আর এমপি ইলেকশন করবেন না। যদি তাকে নির্বাচিত করে দেই তাহলে উনি পরবর্তীসময়ে আর ভোট করবেন না। এখন যদি উনি এটা ভুলে যান, তাহলে তো আর কিছু করার নেই।

বিএনপি নেতাকর্মীদের হামলার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেন, ‘ওরা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছে। আমরা ওদের মিছিল মিটিং করতে দেই না, এটা ঠিক নয়। আগে তারা ঐক্যবদ্ধ ছিল, এখন তারা পড়ে গেছে। রাজনীতি করার জন্য সামনে এগিয়ে আসে না। আমরা তাদের কিছু বলি না।’

নিউজটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © gtbnews24.com
Web Site Designed, Developed & Hosted By ALL IT BD 01722461335