বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ০২:১৫ পূর্বাহ্ন

অনলাইন জুয়ায় আসক্ত ভাতিজা, নিষেধ করায় স্কুলশিক্ষিকা রুনাকে খুন

নিজস্ব প্রতিবেদক: কুষ্টিয়া জিলা স্কুলের সিনিয়র শিক্ষিকা রোকশানা খানম রুনা (৫২) হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন করেছে পুলিশ। তিনি নিজ ভাতিজা নওরোজ কবির নিশাতের (২০) হাতে খুন হয়েছেন।

বিষয়টি নিশ্চিত করে কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার মো. খাইরুল আলম বলেন, মূলত নিশাত একজন মাদকাসক্ত। এরই সঙ্গে সে আইপিএলসহ বিভিন্ন অনলাইন জুয়ায় আসক্ত। নিশাতের উশৃঙ্খল জীবনযাপনে বিরক্ত হয়ে বকাঝকা করলে ফুফুকে খুনের পরিকল্পনা করে সে।

সোমবার বেলা ১১টার দিকে কুষ্টিয়া শহরের হাউজিং ডি ব্লকের ২৮৫ নম্বর বাসার শয়নকক্ষ থেকে রোকশানা খানম রুনার মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। তিনি কুষ্টিয়া জিলা স্কুলের ইংরেজি বিষয়ের সিনিয়র শিক্ষিকা ছিলেন। তার স্বামী খন্দকার মোস্তাফিজুর রহমান যশোরের চৌগাছা এলজিইডির কমিউনিটি অরগানাইজার পদে চাকরি করেন। সপ্তাহান্তে তিনি কুষ্টিয়ায় আসতেন। ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে হাউজিং ডি ব্লকে নিজের নামে ছয়তলা ওই বাড়িটি নির্মাণ করেছিলেন রোকশানা খানম।

কুষ্টিয়া সাইবার ক্রাইম ইউনিটের ইনচার্জ মো. আনিসুল ইসলাম জানান, নিজের কোনো সন্তান না থাকায় ছোটবেলা থেকেই পরম আদর-স্নেহে কোলেপিঠে করে দুই ভাতিজা নিশাত এবং নির্ঝরকে বড় করেন ফুফু রোকশানা খানম। তবে ছোট হওয়ায় ভাতিজা নির্ঝরের চেয়ে নিশাতকেই বেশি আদর করতেন তিনি।

বড় ভাইয়ের মৃত্যুর কারণে তার দুই ছেলে এবং ভাবিকে সব সময় আগলে রাখতেন রোকশানা। নিজ বাড়ির চতুর্থ তলার একটি ফ্ল্যাটে বিনা ভাড়ায় তাদের থাকতে দিয়েছিলেন। আদরের ভাতিজা নিশাতকে কিছুদিন আগে ১ লাখ ৯০ হাজার টাকা দিয়ে একটি বাইকও কিনে দেন। নিশাত গত বছর এইচএসসি পাস করেন। কিন্তু কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ না পাওয়ায় এবছর পুনরায় ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।

রোকশানা খানম ভাতিজা নিশাতকে তার নিজের টাকা দিয়ে ছয় তলা ওই বাড়ির নিচে একটি মুদিদোকানও করে দিয়েছিলেন। কিন্তু এরই মধ্যে নিশাত গাঁজাসহ বিভিন্ন মাদকের নেশায় জড়িয়ে পড়েন। একই সঙ্গে আইপিএলসহ বিভিন্ন অনলাইন জুয়া খেলায় আসক্ত হয়ে যান। অনলাইন জুয়া খেলায় হেরে গিয়ে দেনা পরিশোধের জন্য ফুফুর দেওয়া মোটরসাইকেলটি গতমাসে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকায় বিক্রি করে দেন। এছাড়া ছয় তলা ওই বাড়ির সব ফ্ল্যাটের ভাড়াও তিনি আদায় করতেন।

নিশাতের এই উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপন নিয়ে চরম বিরক্ত ছিলেন স্কুল শিক্ষিকা রোকশানা খানম। এ নিয়ে প্রায়ই তিনি ভাতিজা নিশাতকে বকাঝকা করতেন। সর্বশেষ হত্যাকাণ্ডের আগের দিনও এসব বিষয় নিয়ে নিশাতকে বকাঝকা করেন ফুফু রোকশানা। এ নিয়ে ফুফুর প্রতি ক্ষোভ জন্মে মাদকাসক্ত নিশাতের। এ কারণে সে ফুফুকে ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পিতভাবে হত্যা করার ছক তৈরি করেন।

ঘটনার দিন স্কুলের কাজে যশোরে গিয়েছিলেন রোকশানা খানম। ছয় তলার ছাদে রোকশানা ছাগল, কবুতর, খোরগোশসহ পশু-পাখি পালতেন। যশোর থেকে ফিরে রাত প্রায় ১১টার দিকে আরেক ভাতিজা নিশাতের বড় ভাই নির্ঝরকে সঙ্গে নিয়ে ছাদে পশু-পাখি দেখতে যান। দোতলায় ফিরে এসে রোকশানা নিচে কলাপসিবল গেটে তালা লাগাতে যান। এই সুযোগে ভাতিজা নওরোজ কবির নিশাত ফুফুর রোকশানার ফ্ল্যাটের স্টোররুমে লুকিয়ে পড়েন। রাত আনুমানিক ১২টার দিকে রোকশানা ঘুমানোর জন্য বিছানায় যান। নিশাত অপেক্ষা করতে থাকে ফুফু কখন ঘুমাবেন। ফুফু ঘুমিয়ে পড়লে একপর্যায়ে রাত ১টা থেকে ১টা ২০ মিনিটের মধ্যে স্টোররুমে থাকা শীল দিয়ে ঘুমন্ত অবস্থায় ফুফু রোকশানা খানমের মাথায় পর পর দুটি আঘাত করে মৃত্যু নিশ্চিত করেন।

দুর্বৃত্তরা এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে এসব আলামত সৃষ্টির জন্য জন্য পরিকল্পিতভাবে তিনি প্রতিটি ঘরের আসবাবপত্র, কাপড় চোপড়, ড্রয়ার সব কিছু মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখেন। পরে বারান্দার দরজায় দা দিয়ে কোপ মারেন। একপর্যায়ে তিনি বরান্দার গ্রিলের ফাঁক গলিয়ে নিচে নেমে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত শীলটি লিফটের মধ্যে রেখে দেন। হত্যাকাণ্ডের পর রাত ২টা ৪৫ মিনিটের দিকে নিশাত ওই বাড়িতে ভাড়া থাকা লিজান ও শাকিল নামে দুই যুবককে ডেকে তুলে শাকিলের ফ্ল্যাটে গিয়ে তিনজন মিলে গাঁজা সেবন করেন। ঘরে ফিরে রাত ২টা ৫৮ মিনিটে শাকিলকে ফোন করে জিজ্ঞাসা করেন কোনো শব্দ পেয়েছে কী না? শাকিল কোনো শব্দ শোনেননি বলে জানালে তিনি নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়েন।

সোমবার সকাল সাড়ে ৮টার দিকে নিশাত ঘুম থেকে উঠে প্রতিদিনের মতো বাড়ির নিচে মুদিদোকান খুলে বেঁচাবিক্রি শুরু করেন। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে তিনি পাশের নিশান মোড়ে নাস্তা খেতে যান। নাস্তা সেরে এসে সকাল ১০টার দিকে তিনি ফুফুর দরজা ধাক্কাতে থাকেন। ফুফু দরজা না খোলায় অন্য ফ্লাটে থাকা ভাড়াটিয়াদের জানান, ফুফু দরজা খুলছে না। বিষয়টি তিনি মোবাইলফোনে যশোরে থাকা ফুফুর স্বামী খন্দকার মোস্তাফিজুর রহমানকে জানান। পরবর্তীতে তার মোবাইলফোন থেকে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ ফোন করে বিষয়টি জানালে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে স্থানীয়দের সহযোগিতায় দরজা ভেঙে স্কুল শিক্ষিকা রোকশানা খানম রুনার রক্তাক্ত মরদেহ উদ্ধার করে।

কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার মো. খাইরুল ইসলাম বলেন, অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় পূর্বপরিকল্পিতভাবে নওরোজ কবির নিশাত একাই এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। নিশাতের দেওয়া স্বীকারোক্তি অনুযায়ী সোমবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে ওই বাড়ির লিফটের ঘর থেকে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত শীলটি পুলিশ উদ্ধার করেছে।

নিউজটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © gtbnews24.com
Web Site Designed, Developed & Hosted By ALL IT BD 01722461335