বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৬:৩৯ অপরাহ্ন

ভাঙছে বাঁধ, নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত

জিটিবি নিউজঃ বৃষ্টি কমে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের আপার মেঘনা অববাহিকার প্রধান নদীগুলোর পানি হ্রাস পাওয়ায় কিছু এলাকায় বন্যা পরিস্থিতির সামান্য উন্নতি হয়েছে। তবে এখনো অব্যাহতভাবে বাড়ছে গঙ্গা-পদ্মা, যমুনা, করতোয়া, কুশিয়ারাসহ অধিকাংশ নদ-নদীর পানি। ফলে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অধিকাংশ জেলার বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। অনেক স্থানে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়েছে নতুন নতুন এলাকা। নদী অববাহিকার নিঞ্চলগুলোয় ঘরের ভিতরে কোথাও হাঁটুপানি, কোথাও কোমরপানি। চুলা ডুবে যাওয়ায় বন্ধ রান্না। গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে বন্যার পানিতে ডুবে মৃত্যু হয়েছে সাত বছর বয়সী শিশুর। অন্যদিকে জামালপুরে মৃত্যু হয়েছে এক মুক্তিযোদ্ধার। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে অন্তত ১৫ লাখ মানুষ।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্যমতে, গতকাল সকালেও ১০১টি পর্যবেক্ষণাধীন পানি সমতল স্টেশনের ৫৫টিতে পানি বৃদ্ধি পায়। ১৪টি নদ-নদীর পানি ২২টি পয়েন্টে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। পাউবোর গতকাল সকালের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ব্রহ্মপুত্র নদের পানি সমতল স্থিতিশীল রয়েছে যা আগামী দুই দিনে হ্রাস পেতে শুরু করতে পারে। অন্যদিকে যমুনা নদীর পানি সমতল বৃদ্ধি পাচ্ছে যা আগামী দুই দিনে স্থিতিশীল হয়ে যেতে পারে। গঙ্গা-পদ্মা নদীসমূহের পানি সমতল বৃদ্ধি পাচ্ছে যা আগামী দুই দিন অব্যাহত থাকতে পারে। কুশিয়ারা  ছাড়া আপার মেঘনার প্রধান নদীগুলোর পানি হ্রাস পাচ্ছে যা ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পরে। এ ছাড়া আজকের মধ্যে সিলেট, সুনামগঞ্জ ও কুড়িগ্রামে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। স্থিতিশীল থাকবে গাইবান্ধা, বগুড়া, জামালপুর, নাটোর ও নওগাঁ জেলার বন্যা পরিস্থিতি। আজকে আরও অবনতি হতে পারে সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, রাজবাড়ী ও ঢাকা জেলার নি¤œাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি।

বাংলাদেশ প্রতিদিনের বিভিন্ন জেলার সংবাদকর্মীরা জানিয়েছেন সেখানকার বন্যা পরিস্থিতি। জামালপুর : যমুনাসহ শাখা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় জামালপুরের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। গতকাল বিকালে বাহাদুরাবাদঘাট পয়েন্টে যমুনার পানি বিপৎসীমার ১২৯ সেন্টিমিটার এবং জগন্নাথগঞ্জঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমার ৪০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে জেলার প্রায় ৬ লাখ মানুষ। এদিকে দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার সুগারমিল ভাটিপাড়া এলাকায় বন্যার পানিতে ডুবে নুরুল ইসলাম হিরু নামের একজন বীরমুক্তিযোদ্ধার মৃত্যু হয়েছে। রাস্তা পার হওয়ার সময় পানির স্রোতে ভেসে যান তিনি। পরে মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, ঝিনাইসহ শাখা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় নতুন করে জামালপুর সদর, সরিষাবাড়ী, মেলান্দহ ও বকশীগঞ্জের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। গাইবান্ধা : প্রধান নদ-নদীর পানি বৃদ্ধির ফলে গাইবান্ধা-সাঘাটা সড়কের উল্লাভরতখালি এলাকায় বিভিন্ন স্থানে বাঁধের ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এই সড়কের ১০টি পয়েন্ট ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। বালুর বস্তা ফেলে পানি ঠেকানোর চেষ্টা করছেন স্থানীয়রা। গাইবান্ধা জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা এ কে এম ইদ্রিস আলী জানান, জেলা সদর, সাঘাটা, ফুলছড়ি ও সুন্দরগঞ্জ উপজেলার ২৬ ইউনিয়নের ৬০ গ্রামের এক লাখ ৪৬ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। এর মধ্যে এক লাখ ২২ হাজার ৩২০ জন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। নওগাঁ : জেলার মান্দায় আত্রাই নদীর ডান তীরে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের চার স্থান ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। জোতবাজার-আত্রাই সড়কের মাত্র ৬ কিলোমিটারের মধ্যে ভেঙে যাওয়া স্থানগুলো দিয়ে হু হু করে পানি ঢুকছে। এতে অর্ধশতাধিক গ্রামের লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। দুর্গত এলাকার বানভাসি মানুষ আশ্রয় নিতে শুরু করেছে বিভিন্ন সড়ক ও উঁচু স্থানে। জানা গেছে, আত্রাই নদীর পানি অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়ায় ৮টি বেড়িবাঁধ ভেঙে যায়। এরপর পানির প্রবল চাপ এসে পড়ে মূল বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে। এ অবস্থায় বুধবার সন্ধ্যায় জোতবাজার-আত্রাই রাস্তার দাসপাড়া নামক স্থানে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে যায়। এরপর একে একে অন্যান্য স্থানে ভাঙন শুরু হয়।

রাজশাহী : নওগাঁর মান্দা উপজেলার শিবনদীর টেংরা নামক স্থানে এলাকার কিছু মানুষ নিজেদের স্বার্থে বাঁধ কেটে দেওয়ায় রাজশাহীর বাগমারায় ৭টি ইউনিয়ন বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। পানিতে ডুবে নষ্ট হয়েছে কয়েক লাখ একর আবাদি জমির ফসল। এ ছাড়াও বন্যায় ভেসে গেছে শতাধিক পুকুরের মাছ। সোনাডাঙ্গা ও কাছারি কোয়ালীপাড়া ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে মানুষের শোয়ার ঘরেও পানি ঢুকে পড়েছে। কিছু কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পানির নিচে তলিয়ে গেছে। এলাকার লোকজন বাড়িঘর ছেড়ে গরু, ছাগল নিয়ে বিভিন্ন বাঁধে আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করছে। বন্যাকবলিত এলাকার পাউবোর বাঁধগুলো দুর্বল হওয়ায় মানুষ সেখানে আশ্রয় নিতে ভয় পাচ্ছে।

টাঙ্গাইল : টাঙ্গাইলে বন্যা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি হয়েছে। জেলার ভূঞাপুর, টাঙ্গাইল সদর, গোপালপুর, কালিহাতী ও নাগরপুর উপজেলার শতাধিক গ্রামের দেড় লক্ষধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। গতকাল টাঙ্গাইলে যমুনা নদীর পানি জোকারচর পয়েন্টে ৫৬ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ৮৮ সেন্টিমিটার, এলাসিন পয়েন্টে ধলেশ^রীর পানি ১২২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। পানির তীব্র স্রোতে লোকালয়ে প্রবেশ করছে। জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন অফিস সূত্র জানিয়েছে, ভূঞাপুর, নাগরপুর, দেলদুয়ার, গোপালপুর, কালিহাতী ও সদর উপজেলার ২৬টি ইউনিয়ন এবং ভূঞাপুর পৌরসভার একাংশ ইতিমধ্যে বন্যাকবলিত হয়েছে। এসব এলাকার লোকজন মানবেতর জীবনযাপন করছে। বন্যায় তলিয়ে গেছে জমির আউস ধান, পাট, তিল ও সবজি। ভেসে গেছে পুকুরের মাছ। গাইবান্ধা : জেলার সুন্দরগঞ্জের বেলকা ইউনিয়নের রামডাকুয়ারচর গ্রামে বন্যার পানিতে ডুবে আবদুল্লাহ (৭) নামে এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। গতকাল দুপুরে বন্ধুদের সঙ্গে খেলার সময় সবার অগোচরে শিশুটি বানের পানিতে ডুবে যায়। পনে স্থানীয়রা খোঁজাখুজি করে তার লাশ উদ্ধার করে। কুড়িগ্রাম : নদ-নদীর পানি কমতে শুরু করলেও কুড়িগ্রামে বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। প্রতিদিন নতুন নতুন অনেক এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। জেলার ৫৬টি ইউনিয়নের ৪৭৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়ে ৩ লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। প্রায় ৫০ হাজার মানুষ বাঁধ, রাস্তা ও আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে। বুধবার রাতে জেলার রৌমারী উপজেলায় শহর রক্ষাবাঁধ ভেঙে রৌমারী উপজেলা পরিষদসহ শহরে পানি ঢুকেছে।

ফলে সেখানে নতুন করে প্লাবিত হয়েছে আরও ১২টি গ্রাম। গত ২৪ ঘণ্টায় পানিতে ডুবে রাজিবপুরে এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে গত দুই দফা বন্যায় ১০ জন শিশু, এক যুবক ও দুই বৃদ্ধসহ ১৩ জন পানিতে ডুবে মারা গেল। টানা পানিতে বাস করে এবং বিশুদ্ধ পানির সংকটের কারণে দেখা দিয়েছে জ¦র, সর্দি ও ডায়রিয়াসহ নানা রোগব্যাধি। বগুড়া : সারিয়াকান্দিতে যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে বন্যা পরিস্থিতি মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। মথুরাপাড়া পয়েন্টে গত ২৪ ঘণ্টায় যমুনার পানি ১০ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ১২৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। সারিয়াকান্দি উপজেলার ১২৩টি গ্রাম প্লাবিত হয়ে কর্মহীন হয়ে পড়েছে মানুষ। সিরাজগঞ্জ : যমুনার পানি সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে ৯০ সেন্টিমিটার ও কাজিপুর পয়েন্টে ১১৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে সিরাজগঞ্জ জেলার ৬টি উপজেলার ৩৫টি ইউনিয়নের ২১৬টি গ্রাম তলিয়ে গেছে। প্রায় ৩৭ হাজার পরিবারের দুই লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। পানিবন্দী মানুষের মধ্যে তীব্র খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। চরাঞ্চলের হাজার হাজার পরিবার পানির মধ্যেই মানবেতর জীবনযাপন করছে।

নিউজটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © gtbnews24.com
Web Site Designed, Developed & Hosted By ALL IT BD 01722461335