রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১২:২৯ অপরাহ্ন

শ্রীশ্রী জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা ও মানবমুক্তি

দীপক কুমার সরকার

হিন্দু তথা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস অনুযায়ী শ্রীশ্রী জগন্নাথ দেব হলেন জগতের নাথ বা জগতের ঈশ্বর। ধর্মীয় মূল্যবোধ ও বিশ্বাস অনুসারে রথের দড়িতে টান দিলে জ্ঞানে বা অজ্ঞানে করা সমস্ত পাপ ধুয়ে মুছে যায়। এছাড়া রথের দড়িতে টান দিলে জীবনের সব দুঃখ কষ্ট থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। একশো যজ্ঞ করার সমান পূণ্য লাভ করা যায় রথের দড়িতে টান দিয়ে। আর এ বিশ্বাস থেকেই জগন্নাথ দেবের মূর্তি নিয়ে রথযাত্রার আয়োজন করে থাকেন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা।
সনাতন ধর্মাবলম্বী তথা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব হচ্ছে শ্রীশ্রী জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা উৎসব। প্রতি বছর আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে আয়োজিত হয় এ উৎসব। সে মতে এবার ২০ জুন মঙ্গলবার রথযাত্রা ও আগামী ২৮ জুন বুধবার উল্টো রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হবে। রথযাত্রা উৎসবে সুসজ্জিত রথটানা, হরিনাম সংকীর্ত্তন, বিশ্বশান্তি কামনায় অগ্নিহোত্র যজ্ঞ, মহাপ্রসাদ বিতরণ, আলোচনা সভা, পদাবলী কীর্তন ও গীতা পাঠের মাধ্যমে পালিত হয়। রথযাত্রা উপলক্ষে বিভিন্ন স্থানে মেলার আয়োজন করা হয়। মূলত এ উৎসবের কেন্দ্র স্থল হচ্ছে ভারতের উড়িষ্যা বা ওডিশা রাজ্যের পূরীতে অবস্থিত জগন্নাথ দেবের প্রধান মন্দির। ভারত, বাংলাদেশ ছাড়াও বিশ্বের অনেক দেশে এ উৎসব মহা ধুমধামে পালিত হয়ে আসছে। সব মিলিয়ে রথযাত্রা হচ্ছে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের দেবতা জগন্নাথ, বললাম ও শুভদ্রা নিয়ে সুসজ্জিত মূর্তি রথে চেপে পুরীর জগন্নাথদেবের মন্দির থেকে মাসির বাড়িতে গুন্ডিচা যাত্রাকে বুঝায়।

তাত্ত্বিক অর্থে জগন্নাথ শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ “জগৎ” বা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রভু”। “জগন্নাথ” কথাটি তৎপুরুষ সমাস। এটি “জগৎ” ও “নাথ” শব্দের সংমিশ্রণ গঠিত। যেমন “জগৎ” (যার মূল ধাতু “গম্”, অর্থাৎ “যা কিছু চলে”) এবং (“নাথ” অর্থাৎ, প্রভু বা আশ্রয়) শব্দটির সংমিশ্রণে গঠিত। সুতরাং “যিনি এই বিশ্বব্রহ্মান্ডের আশ্রয় চলমান জগতের আশ্রয়দাতা অর্থাৎ প্রভু” তিনিই “জগন্নাথ”। প্রতি বছর আষাঢ় মাসের শুক্ল পক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে জগন্নাথদেবকে বিষ্ণুরর অবতার রূপে পূজা করা হয়।
বৈষ্ণব অনুসারীদের পাশাপাশি শৈব, শাক্ত, গানপত্য এবং সৌররা জগন্নাথের পূজা করেন। ভাগবত পুরাণে আছে, ঋষি মার্কণ্ডেয় পুরুষোত্তম জগন্নাথ ও শিবের একত্ব প্রমাণ করেন। মহারাষ্ট্রের গণপতি ভট্ট হাতিবেশের সময় জগন্নাথকে গণেশ রূপে পূজা করেছিলেন। ওড়িষ্যার ভাষায় “জগন্নাথ” নাম থেকে উৎপন্ন “জগা” বা “জগবন্ধু” শব্দদুটিরও প্রচলন লক্ষ্য করা হয়। এছাড়া জগন্নাথের মূর্তির গড়ন অনুসারে তাঁর “কাল্য” (অর্থাৎ, “কালো দেবতা” বা “কালের দেবতা”), “দারুব্রহ্ম” (অর্থাৎ, কাষ্ঠরূপী ব্রহ্ম), “দারুদেবতা” (অর্থাৎ, কাঠের দেবতা), “চকাক্ষী”, “চকাদোলা বা “চকানয়ন” (অর্থাৎ, যে দেবতার চোখ গোলাকার) নামও প্রচলিত। জগন্নাথের সবচেয়ে বিখ্যাত উৎসব রথযাত্রা। এই উৎসবের সময় বলভদ্র, জগন্নাথদেব ও সুভদ্রার বিগ্রহ মূল মন্দিরের গভর্গৃহ থেকে বের করে এনে কাঠে নির্মিত হয়। এই বিগ্রহের চোখ দুটো বড় বড় ও গোলাকার। কোন হাত পা দেখা যায় না এই বিগ্রহের।
জগন্নাথ দেব আবির্ভূত নিয়ে সুপ্রাচীন পুঁথি ব্রহ্মাণ্ডপুরাণ এ কথিত আছে, কলিযুগের আগে দ্বাপর যুগ। এ যুগে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে রাজা ধৃতরাষ্ট্র পত্নী গান্ধারীর অভিশাপে ও ভবিষ্যাদ্বাণীতে শবরের বাণে শ্রীকৃষ্ণের মৃত্যু হবে। চিরন্তন বানী অনুযায়ী দ্বারকায় শ্রীকৃষ্ণ একদিন গাছের নীচে বসে থাকাকালীন সময়ে তাঁর রাঙা চরণকে পাখি ভেবে ভুল করে বাণ মারে জরা নামে এক শবর। ফলে শ্রীকৃষ্ণের মৃত্যু হয় এবং শ্রীকৃষ্ণের মৃত্যুর খবর পেয়ে অর্জুন ছুটে এলেন দ্বারকায়। দেহ সৎকারের সময় অর্জুন দেখলেন, গোটা দেহটা পুড়লেও নাভিদেশ পুড়ছে না! তখনই হয় দৈববাণী, ‘ইনিই সেই পরমব্রহ্ম। অর্জুন, এঁকে সমুদ্রে নিক্ষেপ করো ভাসিয়ে দাও। সেই পরমব্রহ্ম অংশটুকু ঢেউয়ে ভাসতে ভাসতে এগিয়ে চলল। এদিকে বাণ নিক্ষেপকারী শবর রাজ ওই বস্তুটুকু লক্ষ করে সমুদ্রের তীর ধরে ছুটে চললেন। এক পর্যায়ে দ্বারকা থেকে পুরী পর্যন্ত ছুটে আসাকালে শ্রীকৃষ্ণকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে বলেন, ‘কাল ভোরে আমাকে তুলে নে। এখন থেকে তোর বংশধর শবরদের হাতেই নীলমাধব রূপে পুজো নেব আমি’। দৈববাণী মত সেই থেকে শবরদের কাছে পুজিত হতে থাকলেন। শ্রীকৃষ্ণের মৃত্যুর মধ্য দিয়েই দ্বাপর যুগের সমাপ্তি ঘটে। আসে কলিযুগ। এ যুগে কলিঙ্গের রাজা তখন ইন্দ্রদ্যুম্ন দেব। বিষ্ণুর ভক্ত ইন্দ্রদ্যুম্ন শ্রীক্ষেত্রে একটি মন্দির গড়ে তুললেন। বর্তমানে যেটি জগন্নাথধাম রূপে পরিচিত। কিন্তু সেই মন্দিরে তখন বিগ্রহ নেই! কথা প্রসঙ্গে রাজা একদিন রাজসভায় আলোচনার মাধ্যমে জানতে পারলেন বিষ্ণুরই এক রূপ নীলমাধবের কথা। তখনই রাজা চারদিকে লোক পাঠালেন নীল মাধবের সন্ধানে। খুঁজতে যাওয়া অনেকেই সভায় ফিরে আসলেও বিদ্যাপতি ফিরে আসেনি। তিনি জঙ্গলে পথ হারিয়ে ফেলায় শবর রাজ বিশ্ববসুর কন্যা ললিতা তাকে উদ্বার করে নিজ বাড়ীতে নিয়ে আসেন। ললিতা ও বিদ্যাপতি প্রেমের ফলে হল দু-জনের বিয়ে হয়। কিন্তু বিয়ের পর বিদ্যাপতি দেখলেন রোজ সকালেই শবররাজ বিশ্ববসু কয়েক ঘণ্টার জন্য কোথাও যান। স্ত্রীকে প্রশ্ন করে বিদ্যাপতি জানতে পারেন জঙ্গলের মধ্যে নীলাঞ্চল পর্বতের গোপন স্থানে নীলমাধবের পূজো করতে যান শবররাজ বিশ্ববসু। সেদিন থেকেই উৎসাহিত হয় বিদ্যাপতি এবং সিদ্ধান্ত নেয় নীলমাধবের সন্ধান, দর্শন করার। এক পর্যায়ে বিশ্ববসু জামাতা বিদ্যাপতিকে শর্ত দিয়ে বিগ্র পর্যন্ত চোখ বেঁধে যেতে হবে। বিদ্যাপতি রাজী হয়ে চোখ বাঁধা অবস্থায় যাওয়ার সময় তিনি গোটা পথে সরষের দানা ছড়াতে ছড়াতে গেলেন। যথাস্থানে পৌঁছে যখন তিনি দর্শন পেলেন নীলমাধবের, তখন তাঁর প্রাণ আনন্দে ভরে উঠল। বনের মধ্যে পূজোর ফুল কুড়িয়ে এনে বিশ্ববসু যখন পূজোয় বসলেন, অমনি দৈববাণী হল, ‘এতদিন আমি দীন-দুঃখীর পূজো নিয়েছি, এবার আমি মহা উপাচারে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের পূজো নিতে চাই।’
শবররাজ ভীষণ রেগে গিয়ে ইষ্টদেবতাকে হারাবার দুঃখে বন্দি করলেন জামাতা বিদ্যাপতিকে। কিন্তু কন্যা ললিতার অনুরোধে বিদ্যাপতিকে মুক্ত করে দেয়। এরপর বিদ্যাপতির খবরে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন মহানন্দে জঙ্গলের সেই নীলাঞ্চল পর্বতের গুহায় গেলেন নীলমাধবকে সাড়ম্বরে রাজপ্রাসাদে আনতে। কিন্তু নীলমাধব না পেয়ে শবররাজকে আটক করেন।
দৈববাণী মতে, সমুদ্রের জলে নিম কাঠের গুড়ি ভেসে পুরীর সমদ্র তটে আসে। আর এ কাঠেই বানাতে হবে বিগ্রহ। হাজার হাজার হাতি, ঘোড়া, সেপাই, লোক-লস্কর নিয়েও সমুদ্র থেকে তোলা গেল না সেই কাঠ। কিন্তু জগন্নাথের কাছে ব্রাহ্মণ-শবর কোনও ভেদাভেদ নেই যে থাকায় শবররাজ আর একদিক ব্রাহ্মণ পুত্র বিদ্যাপতির মাধ্যমেই কাঠটি তুলা সমতুল্য হয়। এদিকে মহারাজ মূর্তি গড়তে তাঁর কারিগরদের লাগালেন। কিন্তু ওই কাঠ এমনই পাথরের মত শক্ত যে ছেনি, হাতুড়ি সবই ভেঙে যায়। তা হলে উপায়! মূর্তি গড়বে কে?
মহারাজের আকুলতা দেখে স্বয়ং বিশ্বকর্মা বৃদ্ধের বেশে হাজির হয়। তবে তিনিই ২১ দিনের আগে নিজ থেকে দরজা না খুললে কেউ যেন তাঁর ঘরে না আসে এমন শর্তে মুর্তি গড়বেন দাবী করেন। কথা মতো শুরু হল কাজ। এ দিকে মূর্তি তৈরি নিয়ে রাজার স্ত্রী গুন্ডিচা দেবীর আগ্রহ ক্রমশ বাড়তে থাকে। তিনি মন্দিরের দরজায় আড়ি পাতেন, কিন্তু ১৪ দিনের মাথায় মন্দিরের ভেতর থেকে কোনও শব্দ শুনতে পান না। তাঁর মনে হয় বৃদ্ধ কারিগর হয়তো ক্ষুধা-তৃষ্ণায় মারা গিয়েছে। খবর পেয়ে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন ছুটে আসেন এবং মন্দিরের দরজা খোলেন। দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে সেখান থেকে অদৃশ্য হয়ে যান বৃদ্ধ কারিগর রূপী বিশ্বকর্মা। সেখানে তিনটি অসম্পূর্ণ মূর্তি জগন্নাথ ও বলভদ্রের হাত তখনও অর্ধেক এবং সুভদ্রার হাত ও পা বিহীন মুর্তি তৈরি হয়েছিল দেখতে পায় রাজা ইন্দ্রদ্যুম। ইহাই স্বয়ং জগন্নাথের ইচ্ছা মনে করে সেই অসম্পূর্ণ মূর্তিই মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করা হয়। গর্হিত অপরাধ করে ফেলেছেন ভেবে দুঃখে ভেঙে পড়া রাজাকে স্বপ্ন দিয়ে জগন্নাথ বললেন, যে এরকম আগে থেকেই নির্ধারিত ছিল। তিনি এই রূপেই পূজিত হতে চান। সেই থেকেই শ্রী জগন্নাথদেবের মূর্তি ওভাবেই পূজিত হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে। জগন্নাথের প্রধান উৎসব হল রথযাত্রা। আষাঢ় মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতে জগন্নাথ বোন সুভদ্রা ও দাদা বলরাম বা বলভদ্রকে নিয়ে রথে চড়ে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের পত্নী গুন্ডিচারবাড়ি যান। এই যাওয়াটাকেই জগন্নাথের মাসির বাড়ি যাওয়া বলে। সেখান থেকে সাতদিন পরে আবার নিজের মন্দিরে ফিরে আসেন। রথে চড়ে এই গমন ও প্রত্যাগমনকে (সোজা) রথ এবং উল্টোরথ বলে।
হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্যতম বর্ণাঢ্য ধর্মীয় উৎসব জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা। ভারতের ওডিশার পুরী শহরের জগন্নাথ মন্দিরের রথযাত্রা সর্বশ্রেষ্ঠ। তা ছাড়া ও পশ্চিমবঙ্গে পূর্ব মেদিনীপুরের মহিষাদল, হুগলির মাহেশ, কলকাতা এবং বাংলাদেশের ধামরাই জগন্নাথ রথ, ইসকনের রথ ও বহুল প্রসিদ্ধ। তবে ধামরাইয়ের এই রথ যাত্রা ভারতের মাহেশের রথ উড়িষ্যার পুরীতে শ্রী শ্রী জগন্নাথ দেবের রথের মত শ্রী শ্রী যশোমাধবের রথের মেলা এশিয়া উপমহাদেশে বিখ্যাত এবং এ উৎসবের ইতিহাস প্রাচীন। বরাবরই শ্রীশ্রী জগন্নাথ দেব তার বোন সুভদ্রা ও দাদা বলরাম বা বলভদ্রকে নিয়ে রথযাত্রার মাধ্যমে ধরনীর সনাতন ধর্মাবলম্বী তথা সকল জীবের দুঃখ, শোক জড়া মোচন করে হৃদয় আনন্দ ও সুখ শান্তিতে ভরে দিতে আসেন। এবারও জগন্নাথদেবের আগমন উৎসব রথযাত্রা সকল জীবের মুক্তির পথের রসেরহেতু জড়া, তাপ, মোহ, দুঃখ- বেদনাসহ নির্মল পৃথিবী উপহার দিবে -এটাই হোক আজকের দিনের প্রত্যাশা। লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।

নিউজটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © gtbnews24.com
Web Site Designed, Developed & Hosted By ALL IT BD 01722461335