মঙ্গলবার, ০৭ মে ২০২৪, ০৩:৫৪ পূর্বাহ্ন

সংশোধন হচ্ছে বিমা নীতি: ‘বিমা প্রতিষ্ঠানে নীতি-নৈতিকতা ও পেশাদারত্বের অভাব’

নিজস্ব প্রতিবেদক: নতুন নীতিমালা করার নয় বছরের মাথায় জাতীয় বিমা নীতি সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে জাতীয় বিমা নীতি ২০২৩-এর খসড়া তৈরি করেছে বিমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)। এ খসড়া জাতীয় বিমা নীতিতে বিমা প্রতিষ্ঠানে নীতি ও নৈতিকতার আলোকে পেশাদারত্ব ও দায়িত্বশীলতার অভাবসহ বেশকিছু সমস্যা চিহ্নিত করা হয়েছে।

সম্প্রতি এ খসড়া সরকারের অনুমোদনের লক্ষ্যে আইডিআরএ থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে পাঠানো হয়েছে।

জাতীয় বিমা নীতির খসড়ায় বলা হয়েছে, বিমা খাতের নিয়মতান্ত্রিক উন্নয়নের জন্য ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার কর্তৃক প্রথমবারের মতো ‘জাতীয় বিমা নীতি ২০১৪’ প্রণয়ন করা হয়। এ নীতির ভিত্তিতে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করায় অনেক প্রতিবন্ধকতা অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে দূর করা সম্ভব হয়েছে।

এতে বলা হয়েছে, সময়ের প্রয়োজনে বিশেষ করে এসডিজি ২০৩০ এবং রূপকল্প ২০৪১ অনুযায়ী উন্নত বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে জাতীয় অর্থনীতিতে বিমার ভূমিকা আরও বাড়ানোর প্রয়াসে নতুন বিমা নীতি প্রণয়ন করা প্রয়োজন। তাছাড়া ২০১৪ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ৯ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। এ নয় বছরে নতুন অনেক তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়েছে। নতুন অনেক সমস্যা চিহ্নিত হয়েছে, সেগুলো থেকে উত্তরণের জন্য নতুন কর্মপরিকল্পনা ও কর্মকৌশল নির্ধারণ করা প্রয়োজন।

‘বিশেষত স্বাস্থ্য বিমা এবং ঝুঁকিনির্ভর বিমার ক্ষেত্র সম্প্রসারণ ও চলমান বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলাতে নতুন বিমা নীতি প্রণয়ন করা এখন সময়ের দাবি। আমরা জানি, যে দেশের বিমা খাত যত শক্তিশালী সে দেশের অর্থনীতি তত শক্তিশালী। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে যেখানে ইন্স্যুরেন্স গ্যারান্টিকে বিবেচনায় নেওয়া হয় সেখানে আমাদের দেশে ব্যাংক গ্যারান্টি দেওয়া হয়। বিমার প্রসার ঘটানোর জন্য আমাদের দেশেও এ নীতিটি নেওয়া যেতে পারে’ বলে খসড়া বিমা নীতিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে।

এতে আরও বলা হয়, বিমার ক্ষেত্রে যে ভাবমূর্তি সংকট বিদ্যমান তা দূর করতে এবং একই সঙ্গে গ্রাহকদের আস্থা বাড়াতে নতুন দিকনির্দেশনা ও কর্মকৌশল প্রয়োজন। নতুন বিমা নীতি, বিমা ক্ষেত্র আরও গতিশীল করে দেশের অর্থনীতির চাকাকে মজবুত এবং সচল করবে। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিমার অবদানকে কাঙ্ক্ষিত স্তরে নিয়ে যেতে সাহায্য করবে। তাই সার্বিক বিবেচনায় এবং উজ্জ্বল আগামীর প্রত্যাশায় নতুন বিমা নীতি করা প্রয়োজন।

সামগ্রিক অর্থনীতিতে বিমার অবদান ভবিষ্যৎ
খসড়া বিমা নীতিতে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে বিমার অবদান ও ভবিষ্যৎ তুলে ধরা হয়েছে। এ বিষয়ে বলা হয়েছে, উন্নত দেশগুলোতে বিমার পেনিট্রেশন হার অনেক বেশি। বিশ্বের অগ্রসর ও বিকাশমান অর্থনীতির দেশগুলো যেমন হংকংয়ে বিমার পেনিট্রেশন রেশিও ১৯ দশমিক ৬ শতাংশ, যুক্তরাষ্ট্রে ১১ দশমিক ৭ শতাংশ, সিঙ্গাপুরে ৯ দশমিক ৩ শতাংশ, কানাডায় ৮ দশমিক ১ শতাংশ, থাইল্যান্ডে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ এবং ভারতে ৪ দশমিক ২ শতাংশ। দেশের অর্থনীতিতে এ হার মাত্র দশমিক ৫ শতাংশ। বাংলাদেশের অর্থনীতির বিভিন্ন খাত সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যতটা এগিয়েছে বিমার ক্ষেত্রে ততটা হয়নি। তাই বিমা খাতের সুপরিকল্পিত উন্নয়নের মাধ্যমে জাতীয় অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ অগ্রগতি অর্জন সম্ভব হবে বলে আশা করা যায়। দেশের বিমা খাত থেকে সরকারের উল্লেখযোগ্য অঙ্কের রাজস্ব আয় হয়। বিমা শিল্পের ব্যাপক বিকাশ সম্ভব হলে এ খাত সরকারের আয়ের অন্যতম প্রধান উৎসে পরিণত হবে। বিমা খাতের উদ্বৃত্ত অর্থ ব্যাংকে গচ্ছিত থাকে। এ খাতটি দেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতেও অবদান রাখছে।

২০২২ সালের শেষে অনিরীক্ষিত হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের বিমা খাতের মোট প্রিমিয়াম আয় হয়েছে ১৬ লাখ ৮১ হাজার ৪৭১ মিলিয়ন টাকা। মোট সম্পদ ৬৩ লাখ ৬২ হাজার ৯০৫ মিলিয়ন টাকা। মোট লাইফ ফান্ড প্রায় ৩৪ লাখ ৩২ হাজার ৪৬২ মিলিয়ন টাকা এবং মোট বিনিয়োগ ৪৬ লাখ ৪৮ হাজার ৪৩১ মিলিয়ন টাকা। ব্যাংকিং সেক্টর থেকে যেসব বড় প্রকল্পে বিনিয়োগ করা হয়, এর বিপরীতে বিমা কভারেজ থাকা আবশ্যক, এ বিষয়টি নতুন বিমা নীতিতে সংযোজন করা যেতে পারে।

বিমা শিল্পে চিহ্নিত সমস্যা
খসড়া বিমা নীতিতে বিমা শিল্পের বেশকিছু সমস্যা চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- বিমার গুরুত্ব ও উপকারিতা সম্পর্কে জানাতে এবং আগ্রহ সৃষ্টি করতে সাধারণ মানুষের জন্য ব্যাপক প্রচারণা বা সচেতনতামূলক কার্যক্রমের অভাব পরিলক্ষিত হয়। জনমনে বিমা শিল্পের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার কার্যক্রম নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। যারা মাঠপর্যায়ে বিমা পণ্য বিক্রয়কাজে জড়িত তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণ না থাকায় গ্রাহককে বিমা সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা দিতে ব্যর্থ হয়।

এ বিষয়ে আরও বলা হয়েছে, দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, ইনস্টিটিউটে বিমা সম্পর্কিত স্নাতক বা স্নাতকোত্তর শিক্ষা কার্যক্রম নেই। ফলে বিমা শিক্ষার প্রসার কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় হয়নি। বিমা কোম্পানিগুলোর মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা ছাড়া অন্য উচ্চপদস্থদের জন্য বিমা ক্ষেত্রে উচ্চতর প্রশিক্ষণ বা ডিপ্লোমা বা ডিগ্রি থাকার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। ফলে তরুণ প্রজন্মের বিমা বিষয়ে পড়াশোনা করার কোনো আগ্রহ সৃষ্টি হচ্ছে না।

এছাড়া বিমা খাতের বেশি কিছু সমস্যা চিহ্নিত করা হয়েছে খসড়া নীতিতে। এর মধ্যে রয়েছে
>> দেশের বিমা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিদ্যমান সাংগঠনিক কাঠামো অত্যন্ত দুর্বল, যা যুগোপযোগী নয়।
>> বিমা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সুনির্দিষ্ট চাকরি বিধিমালার মাধ্যমে দক্ষ ব্যবস্থাপনা ও সুস্পষ্ট কর্মপরিধির অভাব।
>> পেশাগত বিমা শিক্ষা যেমন- ডিগ্রি, ডিপ্লোমা, সার্টিফিকেট, প্রশিক্ষণ ইত্যাদি যথাযথভাবে মূল্যায়ন না করায় বিমা-শিল্প উন্নয়নে সৃষ্ট প্রতিবন্ধকতা।
>> বিমা কোম্পানিগুলোর সুশাসনের অভাব।
>> জীবন বীমা প্রতিষ্ঠানগুলোর অ্যাকচুয়ারির অভাব।
>> বিমা প্রতিষ্ঠানগুলোর মূলধনের অপর্যাপ্ততা।
>> বিমা প্রতিষ্ঠানগুলো কর্তৃক ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমের অভাব।
>> বিমা প্রতিষ্ঠানগুলোতে উচ্চ হারে ব্যবস্থাপনা ব্যয়।
>> অধিকাংশ সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, শিল্প কারখানাসহ যাবতীয় সম্পত্তি পরিপূর্ণ বিমা সুবিধার আওতায় না আসায় দুর্ঘটনা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগে ব্যাপক জানমাল ও সম্পদের ক্ষতিজনিত কারণে মারাত্মক অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সম্ভাবনা।

>> বিমা প্রতিষ্ঠানগুলোর সুশাসনের অভাব।
>> বিমা প্রতিষ্ঠানগুলোর নীতি ও নৈতিকতার আলোকে পেশাদারত্ব এবং দায়িত্বশীলতার অভাব।
>> বিমা ডিপ্লোমা ডিগ্রি, অ্যাকচুয়ারিয়াল সায়েন্সসহ অন্যান্য পেশাগত ডিগ্রি দেওয়ার অপ্রতুল প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা।
>> কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, টর্নেডো, ভূমিকম্প ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি, প্রাণহানির মতো বিপর্যয়ের ঝুঁকি মোকাবিলায় বিমা শিল্পকে কাজে লাগানোর অধিকতর কার্যকর পরিকল্পনা না থাকা।
>> বাংলাদেশে বিমা ব্যবসায় অন্যতম প্রধান অন্তরায় হচ্ছে জীবন, স্বাস্থ্য, কৃষি ও সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণ সম্বন্ধে সেবাগ্রহীতা ও সেবা প্রদানকারীর জ্ঞানের অভাব। বিমার জন্য ব্যয়িত অর্থকে পরিবারের ও ব্যবসায়ের অতিরিক্ত খরচ হিসেবে বিবেচনা করা।

সমস্যা উত্তরণের উপায়
খসড়া নীতিমালায় বিমা খাতের সমস্যা থেকে উত্তরণের কিছু উপায় উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- বিমা শিক্ষা ও সচেতনতা বাড়াতে কার্যক্রম হাতে নেওয়া। বিমা সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণার ব্যাপক প্রচার-প্রসার ঘটাতে হবে। এক্ষেত্রে প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে হবে। সারাদেশে বিমার ইতিবাচক ধারণা তুলে ধরে সভা, কর্মশালা ইত্যাদির আয়োজন করতে হবে। জনগণকে এ ধরনের অনুষ্ঠানে সম্পৃক্ত করতে হবে। বিমা শিল্পে কর্মরত জনগোষ্ঠীকে পেশাগত প্রশিক্ষণ দিতে হবে।

নতুন বিমা নীতির উদ্দেশ্য
নতুন বিমা নীতির লক্ষ্য-উদ্দেশ্য তুলে ধরা হয়েছে খসড়া নীতিমালায়। এ বিষয়ে বলা হয়েছে, এসডিজি ২০৩০ এবং রূপকল্প ২০৪১ বিবেচনায় রেখে উন্নত, সমৃদ্ধ ও স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার উপযোগী বিমা নীতি প্রয়োজন। বিমা নীতিকে যুগোপযোগী এবং বিমা ব্যবসাকে ডিজিটালাইজড করাসহ বিমা খাতের বিদ্যমান অব্যবস্থাপনা ও অনিয়ম প্রতিরোধ করে বিমা সেবাকে দেশের সর্বস্তরের মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে বিমার সুফল নিশ্চিত করাই নতুন বিমা নীতির লক্ষ্য। একই সঙ্গে জিডিপিতে বিমা খাতের অবদান উল্লেখযোগ্য হারে বাড়িয়ে অর্থনীতিকে শক্তিশালী ভিত্তির মাধ্যমে রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের জীবন ও সম্পদের ঝুঁকি কমানো নতুন বিমা নীতির উদ্দেশ্য।

এ বিষয়ে একাধিক বিমা কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) বলেন, খসড়া জাতীয় বিমা নীতিতে বলা হয়েছে –‘বিমা প্রতিষ্ঠানগুলোর নীতি ও নৈতিকতার আলোকে পেশাদারত্ব ও দায়িত্বশীলতার অভাব’। এটা এমনভাবে বলা হয়েছে, দেখে মনে হবে সব বিমা কোম্পানিতেই একই অবস্থা। কিন্তু সব বিমা কোম্পানিতে নীতি-নৈতিকতা, পেশাদারত্বের অভাবে নেই। গুটিকয়েক কোম্পানিতে এ সমস্যা থাকতে পারে।

তারা বলেন, গুটিকয়েক বিমা কোম্পানি নানা অনিয়মে জড়িত। এজন্য পুরো বিমা সেক্টর ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিমা খাত ইমেজ সংকটে রয়েছে। এখন জাতীয় বিমা নিতেই যদি বলা হয় বিমা কোম্পানিগুলোতে নীতি-নৈতিকতা, পেশাদারত্বের অভাব, তাহলে সেটি বিমা খাতের জন্য খুব একটা মঙ্গলজনক হবে না।

যোগাযোগ করা হলে আইডিআরএ’র মুখপাত্র মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, জাতীয় বিমা নীতি ২০১৪ সালে করা। সময়ের সঙ্গে অনেক কিছু পরিবর্তন হয়েছে। নতুন নতুন অনেক বিষয় এসেছে। এ কারণে জাতীয় বিমা নীতি যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে সংশোধন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

 

নিউজটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © gtbnews24.com
Web Site Designed, Developed & Hosted By ALL IT BD 01722461335