শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২:৩৬ অপরাহ্ন

ক্রেতাশূন্য বঙ্গবাজার, অনুদানের টাকাও পাননি ব্যবসায়ীরা

নিজস্ব প্রতিবেদক: গত ৪ এপ্রিল ভোরের আলো ফোটার পর থেকেই পুড়তে শুরু করে বঙ্গবাজার। দুপুর হতে হতে ভয়াবহ আগুনে পুড়ে ছাই হয় কয়েকটি মার্কেট। নিঃস্ব হন প্রায় চার হাজার ব্যবসায়ী। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের অনেকেই ঘুরে দাঁড়াতে ঈদের আগেই ছোট চৌকি বিছিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। ছোট চৌকিতে কিছু মালামাল রেখে তার ওপর ছাউনি দিয়েই এখনো চলছে তাদের ঘুরে দাঁড়ানোর সংগ্রাম। আগে যে দোকানে প্রতিদিন প্রায় লাখ টাকার বেচাকেনা হতো, এখন সেখানে ক্রেতার দেখাই নেই।

এদিকে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের জন্য যেসব অনুদান দেওয়া হয়েছে, তার কোনোটাই এখনো তাদের কাছে পৌঁছায়নি। এতে তাদের সংগ্রাম আরও কঠিন হয়ে উঠেছে। এছাড়া নতুন করে ভবন নির্মাণ করলে সেখানেও দোকান বরাদ্দ পাবেন কি না, তা নিয়ে রয়েছে নানান শঙ্কা।

অন্যদিকে সিটি করপোরেশন থেকে বঙ্গবাজারে আগের যে নকশায় বহুতল ভবন হওয়ার ছিল সেটি আর হচ্ছে না। নতুন করে পরিকল্পনা নিয়ে, নকশা তৈরি করে ভবন নির্মাণ করতে চায় সিটি করপোরেশন।

বঙ্গবাজারে আগুনের ঘটনায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ক্ষতিগ্রস্ত দোকানের সংখ্যা ৩ হাজার ৮৪৫টি। এসব দোকানের মধ্যে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের চার ইউনিটে মোট দোকান ছিল ২ হাজার ৯৬১টি। বঙ্গ ইউনিটে ৮৬৩টি, গুলিস্তান ইউনিটে ৮২৮টি, মহানগর ইউনিটে ৫৯৯টি ও আদর্শ ইউনিটে ৬৭১টি।

এছাড়া পাশের মহানগর শপিং কমপ্লেক্সে ৭৯১টি, বঙ্গ ইসলামিয়া মার্কেটে ৫৯টি এবং বঙ্গ হোমিও কমপ্লেক্সে ৩৪টি দোকান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এনেক্সকো টাওয়ারের প্রায় সব দোকানের বিমা থাকায় ক্ষতিগ্রস্ত দোকানের কোনো তালিকা নেই প্রতিবেদনে। সব মিলিয়ে ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৩০৩ কোটি টাকার।

সরেজমিনে দেখা গেছে, ছোট চৌকি, বাঁশ-কাঠ দিয়ে তৈরি অস্থায়ী দোকান সাজিয়ে বসেছেন দোকানিরা। এখনো পুলিশ সদর দপ্তরের পাশের ইউনিটসহ বঙ্গবাজারে বাঁশ-কাঠ দিয়ে আরও প্রায় হাজার খানেক দোকান তৈরির কাজ চলছে। সারি সারি বসানো প্রায় হাজার খানেক দোকানে ব্যবসায়ীরা টুকটাক বেচাকেনা করছেন। দোকানের সংখ্যা অনুযায়ী ক্রেতার আনাগোনা নেই বললেই চলে।

ক্রেতাদের আনাগোনায় কর্মব্যস্ত থাকতো যে এলাকা, সেখানে এখন ক্রেতাদের অপেক্ষায় থাকতে হয় দোকানিদের। দোকানগুলোতেও আগের তুলনায় তিন ভাগের এক ভাগ মালামাল নেই। ফলে আগে যেখানে প্রতিদিন ২০ হাজার থেকে লাখ টাকার বিক্রি হতো, এখন তার ৫ ভাগের এক ভাগ বিক্রিও নেই।

বঙ্গবাজারের বিসমিল্লাহ ফ্যাশনের মালিক মহিদ হোসেন বাবু  বলেন, আগে পাইকার আসতো, এখন তারা আসে না। দোকানের অবস্থানও পরিবর্তন হয়ে গেছে। তাই এলেও দোকান খুঁজে পায় না, যা বিক্রি হয় খুচরা ক্রেতার কাছে। আগের ৫ ভাগের এক ভাগও বিক্রি হয় না। দিন শেষে ৩-৪ হাজার টাকা বিক্রি হয়। আগে কোনো কোনো দিন ১ লাখ টাকারও বিক্রি করতাম।

জাহান গার্মেন্টসের মালিক মো. আলতাফ হোসেন  বলেন, দোকানে মাল নাই, বেচাকেনাও নাই। সারাদিনে হাতেগোনা কিছু ক্রেতা আসে। অনেকে জানেও না দোকান বসছে কি না। ঢাকার বাইরের ক্রেতা নাই বললেই চলে। মাল কিছু আনি। ঢাকায় যারা আছে তাদের ফোন দিয়ে বলি মাল দোকানে আনছি, নিয়ে যান। এভাবেই এখন চলছে। দিনে ৪-৫ হাজার টাকার মাল বিক্রি হয়। আগে কোনো কোনো দিন লাখ টাকার মালও বিক্রি করতাম।

মেসার্স মাহি মনি ফ্যাশনের মালিক মো. ইয়াছিন  বলেন, আমার যত মালের পুঁজি ছিল সব শেষ। ২০ লাখ টাকার মতো মাল পুড়ে গেছে। কোনো রকম ব্যবসা চলছে। এখন নতুন করে যে মাল নেবো, সেই সামর্থ্য নাই। হাতে টাকা থাকলে মাল নিয়ে বসা যায়। দোকানে মাল না থাকলে তো বেচাকেনা হয় না। আগে দোকানদাররা আমার দোকান থেকে মাল নিয়ে বিক্রি করতো। দিনে ২ লাখ টাকার মাল বেচাকেনা করতাম। আর এখন মাল নাই বেচাকেনাও সারাদিনে ৫-১০ হাজার টাকা হয়।

তিনি বলেন, নতুন করে ভবন হলে কোথায় বসবো জানি না। কারণ আমার সেই সামর্থ্য নাই একটা দোকান কোথাও নেবো। বসার কোনো ব্যবস্থা না থাকলে হকারি বা রিকশা চালাতে হবে।
মা-বাবার দোয়া গার্মেন্টসের মালিক মো. সুমন হোসেন  বলেন, আগুনে আমার প্রায় ১৭-১৮ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। কোনো মতে এখন একটা দোকান নিয়ে বসছি। তবে বেচা বিক্রি নেই। ব্যবসার অবস্থা খুবই খারাপ। আগে ২০-৩০ হাজার টাকা দিনে বিক্রি করতাম। এখন গড়ে দুই হাজার টাকা বিক্রি হয়। গতকাল (২২ মে) সারাদিনে ৩৮০ টাকা বিক্রি করেছি। আগে তিনজন কর্মচারী ছিল, এখন কোনো রকম একজন রাখছি যেন দোকানে বসতে পারে।

দোকান তৈরি না হওয়া, জায়গা কম থাকা, রোদ ও ভবনের কাজ শুরু হলে কোথায় যাবেন তা ভেবে কিছু ব্যবসায়ী ফ্লাইওভারের নিচে প্রধান সড়কের ওপর এক পাশে চৌকি পেতে বেচা বিক্রি করছেন।

মো. দেলোয়ার হোসেন নামের এক ব্যবসায়ী  বলেন, আপাতত রাস্তায় বসেছি। রোদে প্রচণ্ড গরম। দোকান তৈরি করছে, জায়গা দিলে চলে যাবো। ভবনের কাজ শুরু হলে অস্থায়ীভাবে আমাদের যেন একটা জায়গায় বসতে দেয়। না দিলে কোথায় যাবো আমরা?

তিনতলা বঙ্গ মার্কেটে যেখানে প্রায় ৩ হাজার দোকান ছিল সেখানে এখন অস্থায়ীভাবে সবমিলিয়ে এক হাজার দোকান বসানো হয়েছে। ফলে অনেকেই এখনো দোকান নিয়ে বসেননি। অনেকে বসবেন কি না বা সামনে কী হবে তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন। অনেকে আবার বিভিন্ন জায়গায় দোকান নিয়েছেন।

বঙ্গবাজারের অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী মার্জিয়া ফ্যাশনের মালিক মো. মিজানুর রহমান  বলেন, অগ্নিকাণ্ডে ক্ষয়ক্ষতির পর এখনো ব্যবসা চালু করতে পারিনি। দোকান নিয়ে বসিনি। সামনে কী হবে জানি না। তাই অন্য কিছু করা যায় কি না- ভাবছি।

ব্যবসায়ীরা পাননি অনুদানের টাকা

বঙ্গবাজারের ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী ও কর্মচারীদের জন্য বিভিন্ন জায়গা থেকে অনুদান দেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে বঙ্গবাজারের কর্মচারীদের জন্য দেওয়া হয় ৯ কোটি টাকা। সেই টাকা জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে কর্মচারীদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। ব্যবসায়ীদের জন্য বিভিন্ন জায়গা থেকে অনুদান এসেছে মোট ৫ কোটি ১২ লাখ টাকা। সহযোগিতার জন্য খোলা ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পড়ে রয়েছে সেই টাকা।

একটি দোকানের মালিক মো. সুমন হোসেন  বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের জন্য অনেকে সহযোগিতা করেছে। কেউ অনুদানের টাকা এখনো পায়নি। আমি কোথাও থেকে ১০টি টাকাও পাইনি। সমিতিতে যেসব টাকা আসছে সেখান থেকে আমাদের কোনো টাকা এখনো দেওয়া হয়নি। মাল কিনতে পারছি না। কেউ যদি সহযোগিতা করতো তাহলে বেচাকেনা বেশি হতো।

জাহান গার্মেন্টসের মালিক মো. আলতাফ হোসেন  বলেন, অনেকে টাকা দিয়েছে শুনেছি। কিন্তু আমরা এখনো কোনো টাকা পাইনি। কোনো রকম দোকান নিয়ে বসছি। মাল নেই, খুবই অল্প বেচাকেনা হয়।

অনুদানের টাকার বিষয়ে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জহিরুল ইসলাম  বলেন, আমাদের কাছে ৫ কোটি ১২ লাখ টাকার অনুদান ব্যাংকে রয়েছে। ব্যবসায়ীদের সবচেয়ে বড় সংগঠন এফবিসিসিআই এক কোটি টাকা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীও সহযোগিতা করবেন বলেছেন। আমরা কত টাকা অনুদান পেয়েছি তা সমন্বয় করে ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা করা হবে।

তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে বঙ্গবাজারের কর্মচারীদের জন্য ৯ কোটি টাকা অনুদান দেওয়া হয়েছে। সেই টাকা জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে কর্মচারীদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। এছাড়া অনেকে অনেকভাবে সহযোগিতা করেছে। এটা তারা নিজেরা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে সহযোগিতা করেছে।

নতুন ভবন হবে নতুন নকশায়

মালিক সমিতি সূত্রে জানা গেছে, বঙ্গবাজার মার্কেটের মোট আয়তন ২১ হাজার ২৫০ বর্গফুট বা ১ দশমিক ৬৯৭ একর। মার্কেটটিতে ছিল মোট ২ হাজার ৯৬১টি দোকান।

ডিএসসিসি সূত্রে জানা গেছে, মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনায় আগের কাঠামো ভেঙে পাকা ভবন নির্মাণের লক্ষ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ২০১৭ সালে মার্কেটের নেতাদের চিঠি দিয়ে তাগিদ দেয়। কিন্তু তারা সেটি না মেনে সিটি করপোরেশনের বিরুদ্ধে রিট করে। এতে নতুন ভবন নির্মাণে স্থগিতাদেশ দেন আদালত।

অগ্নিকাণ্ডের পর সেই রিট তুলে নেন ব্যবসায়ীরা। আগের ঠিকাদারকে যে কাজ দেওয়া হয়েছিল সে কাজের মেয়াদ শেষ হওয়ায় নতুন করে নকশা তৈরি করে শিগগির শুরু হবে ভবন তৈরির কাজ।

এ ব্যাপারে মঙ্গলবার বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জহিরুল ইসলাম  বলেন, আমরা রিট তুলে নিয়েছি। মেয়র মহোদয়ের সঙ্গেও আলোচনা করেছি। আগে স্টিলের ভবন তৈরির নকশা ছিল। আর দোকানের আকার ছিল ছোট। এখন নতুন ভবনের জন্য নকশা হবে বিম-কলামে। দোকানের আকারও বড় থাকবে। ১০ তলা ভিত্তিতে ৮ তলা পর্যন্ত করা হবে। একটি আন্ডার গ্রাউন্ড থাকবে। পরে প্রয়োজন হলে আরও দুই তলা করে দেবে। মেয়র মহোদয় আমাদের জানিয়েছেন আগামী তিন মাসের মধ্যেই কাজ শুরু করতে পারবেন।

বঙ্গবাজারে বহুতল ভবন (মার্কেটের) নির্মাণের বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমানকে গত কয়েকদিনে একাধিকবার ফোন করেও পাওয়া যায়নি।

দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আবু নাছের  বলেন, ব্যবসায়ীদের সুবিধার কথা মাথায় রেখে নতুন নকশায় ভবন নির্মাণ করা হবে।

নিউজটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © gtbnews24.com
Web Site Designed, Developed & Hosted By ALL IT BD 01722461335