শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১০:১২ অপরাহ্ন

কাঁচাবাজারের আগুন নেভাবে কে?

ড. মাহবুব হাসান , কবি, সাংবাদিক
কাঁচাবাজারে আগুন- এ কথা লিখতে চাই না। কারণ, ওই আগুনে বাড়িঘর পোড়ে না, কিন্তু মানুষের পকেট পুড়ে ছারখার হয়ে যায়। শূন্য হয়ে যায় তাদের নিত্যদিনের তহফিল।

আজ সকালে (০৫/০৫/২৩) বাজারে গিয়েছিলাম সামান্য শাক-সবজি কিনতে। শাক-সবজিকে ‘সামান্য’ বলছি না। যে পরিমাণ কিনবো তাকে সামান্য বলছি। এক সময় কলকাতায় গেলে ‘একশ দিন তো দাদা/২৫০ দিন তো দাদা’ ইত্যাদি বাক্য শুনে চমকাতাম। ওই ১০০/২৫০ যে গ্রামের হিসাবে বলছে, সেটা বুঝতে কলকাতার একজন বন্ধুর শরণ নিয়েছিলাম। আজ ঢাকার বাজারে, কাঁচাবাজারে ওই গ্রামের হিসেবে শাক-সবজি কেনার ধুম পড়েছে।

আগামী দুই মাসের মধ্যে আসছে আরেকটি উৎসব ঈদুল আজহা। আমরা আজ জানি, কোরবানির জন্য গরুর ঘাটতি নেই দেশে। দেশেই এখন বিপুল পরিমাণ গরুর উৎপাদন হচ্ছে। ভারত থেকে কোনোরকম গরু আসছে না। আর দেশের গরুর ব্যবসায়ীরাও ওই পথ পরিত্যাগ করে নিজেরাই মাংস উৎপাদনে সরব হয়েছেন। কিন্তু এই গরুর উৎপাদন স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করলেও কেন কাঁচাবাজারে গরুর মাংসের দাম বেড়েছে?

ওই ধুম আনন্দের নয়, তা নিত্যবাস্তবের না কিনতে পারার বেদনাজাত ধুম। কেউ আর এক কেজি কেনার কথা বলে না। বড়জোর হাফ কেজি কেনার সাহস তারা দেখায়। আমিও যে মাঝেমধ্যে এক কেজি কেনার কথা ভাবি না, তা নয়। সেটা ভাবতেই হয়। পেঁয়াজ কিনতে গেলে তো আর এক কেজির কম কেনার কথা আমি ভাবতে পারি না। আমার চেয়েও যারা আর্থিকভাবে হীনবল, তারা ফুটপাতের চাটাই বিছানো বিক্রেতার কাছে থেকে সামান্য পেঁয়াজ কেনে।

বেশিরভাগ সময় ওই গরিব মানুষেরা ‘একমুঠো’ পেঁয়াজ কিনে নিয়ে যায়। সে তার সামর্থ্য অনুযায়ী কেনে। তাকে তো সালুন রাঁধার জন্য আরও উপকরণ কিনতে হয়, প্রতিদিনই। সে আলু-পটোল, কাঁচামরিচ, বেগুন, সিম, বরবটি, কচুরলতি ইত্যাদি আর কুচো মাছ তো পরম আরাদ্ধ তাদের কাছে। যে নামগুলো লিখেছি, রিকশাওয়াল, ঠেলাওয়ালা, ভ্যানগাড়ির দোকানদার, ফুটপাতের সিগারেট বিক্রেতা, ভ্রাম্যমাণ হকার এবং পিয়ন-দারোয়ানের পরিবার তো এগুলো ছাড়া খাদ্য খেতে পারে না।

পণ্যের দাম বেড়ে গেলে তাদের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। এরাই, এদেরই পরিবার-পরিজন রাস্তার চাটাই দোকান থেকেই তো সামান্য জিনিস কিনে নিয়ে যায়। কিন্তু সেই দোকানেও জিনিসের দাম শুনলে আপনার চোখ চড়কগাছ হবে। বাজারে যাওয়ার পথে ওই রকম একটি চাটাই দোকান থেকে পেঁয়াজ কেনার দাম শুনলাম আজ। পেঁয়াজের কেজি চাইছে ৬০ টাকা। এর কমে কিশোরী দোকানি বিক্রি করবে না।

শাক-সবজির দোকানে যাওয়ার আগে চাল-ডাল-নুন মরিচের দোকানে ঢুঁ মারলাম। তিন/চার-রকম ডালের কোনোটাই ১শ টাকার কম নয়, বরং অনেকটাই বেশি। ডালে প্রোটিনের পরিমাণ বেশি। তাই গরিবের গোশত হিসেবে ডাল অনন্য পণ্য। চিনি ১৪০ টাকা,পেঁয়াজ প্রকারভেদে ৫০/৬০ টাকা, গোল আলু গত সপ্তাহেই কিনেছিলাম ৩০ টাকা দরে, আজ ৫০ টাকা। রোজার মাসে কাঁচামরিচের দাম কমে এসেছিল। তখন ৪০ টাকা কেজিতে পাওয়া যেতো, এখন মিনিমাম ১২০ টাকা কেজি।

কাঁচামরিচের ঝাল কি সহ্য করতে পারবে গরিব মানুষ। কেবল গরিবের কথাই বা বলছি কেন, আমাদের মতো তথাকথিত মধ্যবিত্ত, যাদের বিত্ত নেই বেসাত নেই তবে ইস্ত্রি করা জামা-জুতোর বাহার আছে, তারাই বা ১২০ টাকা, প্রকারভেদে ১৮০ টাকা কেজি দামে কত দিন কাঁচামরিচ কিনতে পারবেন? কাঁচামরিচ তো আর ভারত থেকে আসে না, আসে না ইউক্রেন বা রাশিয়া থেকে।

তবে চমকানোর মতো দাম বাড়িয়েছে সরকারের লোকেরাই, আমদানিকারকদের সহযোগে, সয়াবিন তেলের। প্রতি কেজি খোলা সয়াবিন বিক্রির রেট বেঁধে দেওয়া হয়েছিল ১৮৭ টাকা, সেটা গত বছরের ডিসেম্বরে। গতকালই (০৫/০৫/২৩) উভয়পক্ষ মিলে বাড়িয়ে করেছে ১৯৯ টাকা। আর বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম কতো বাড়তে পারে, তা আপনারা অনুমান করেন। টিভির নিউজে দেখলাম কাঁচাবাজারের দোকানিরা তাদের মজুতে থাকা বা মজুত করা ৫ লিটারের বোতল ঝেড়ে-মুছে সাফ করে দোকানে সাজাচ্ছেন এগুলো পুরোনো দামে কেনা হলেও বিক্রি করবেন নতুন বেঁধে দেওয়া দামে।

দোকানিরা বলবেন পাইকারি বাজারে তেলের ঘাটতি। দশ কার্টন চাইলে দেয় তিন কার্টন। সেটা বলতে শুনলাম দোকানিকে। এই ঘাটতি তো একটি কৃত্রিম বিষয়, সেটা কেউ না বললেও ক্রেতা/ভোক্তরা ঠিকই বোঝেন। কিন্তু আড়তদার বা রিফাইন করে বোতলজাতকারীরা কোকিলের মতো চোখ বুঝে ভাবেন, ক্রেতারা/ভোক্তরা বোঝেন না যে তারা কারসাজি করছেন। এই যে বে-লেহাজের মতো প্রতিবারই এই কাজ করছেন সামান্য অতিরিক্ত লাভের জন্য এবং সরকার যে তাদেরই সহযোগী আজ, সেটা যে পুণ্যের কাজ হচ্ছে না, অন্যায় ও পাপের কাজ হচ্ছে, দিনশেষে তার যে কল্যাণের চেয়ে অকল্যাণই হবে, হচ্ছে সেটা বোঝার মতো প্রজ্ঞা তাদের আছে। তারপরও লোভই প্রধান আকর্ষক হয়ে উঠেছে আমাদের ব্যবসায়িক সম্প্রদায়ের।

আপনারা লক্ষ্য করুন, আমদানিকারক থেকে শুরু করে খুচরো বিক্রেতা পর্যন্ত যে কয়টি ধাপ আছে, প্রত্যেক ধাপের লোকেরাই লাভকে লোভের তক্তায় নিয়ে গেছেন। একবারও ভাবেননি যে তিনিও কিন্তু ওই লোভের শিকার হচ্ছেন। তিনি একই সঙ্গে বিক্রেতা ও ক্রেতা/ভোক্তাও তো বটেই। নিজের পণ্য দাম বাড়িয়ে দিয়ে নিজেই তা আবার কিনছেন। মাঝে যে কোটি কোটি ক্রেতা/ভোক্তা জনগণ আছে তাদের পকেট তো আর টাকায় ভর্তি নয়। তাদের যে কয়টাকা ছিল পকেটে, তা তো ফাঁকা হয়ে গেলো। ওই যে মধ্যবর্তী ক্রেতা-সাধারণ তারা তো নিঃস্ব হয়ে গেলো। এই যে ভোগবাদি ক্ষুধা, পুঁজিবাদি করপোরেট বাণিজ্যের শোষণ, একেই বলে সাম্রাজ্যবাদি টেকনিক।

আমরা আমজনতা, জানি না কোন যুক্তিতে সরকার ভোজ্যতেলের দাম বাড়ালো। ভোক্তা/ক্রেতারা ওই বাড়তি টাকাটা ব্যয় করতে পারবে কি না, সে খবর না রেখেই যদি তারা এ কাজটি করেন, তাহলে বুঝতে হবে বড় ব্যবসায়ীদের মন্ত্রণায় টু-পাইস বেশি কামাতে ওই মূল্যবৃদ্ধি। গণমানুষের গড় জাতীয় আয় দেখে যদি ভাবেন যে, গরিবের পকেটেও সাড়ে তিন হাজার ডলারের সমপরিমাণ টাকা আছে, এবং তাদের আর্থিক সামর্থ্য তাদের মতোই পোক্ত, তাহলে এর চেয়ে বোকা ভাবনা আর কি হতে পারে? আসলে বোকা ভাবনা না এটা, তারা করপোরেট বাণিজ্যপতিদের মানরক্ষার জন্যই সরকারি তরফের এই মূল্যবৃদ্ধির ফাঁদ।

আগামী দুই মাসের মধ্যে আসছে আরেকটি উৎসব ঈদুল আজহা। আমরা আজ জানি, কোরবানির জন্য গরুর ঘাটতি নেই দেশে। দেশেই এখন বিপুল পরিমাণ গরুর উৎপাদন হচ্ছে। ভারত থেকে কোনোরকম গরু আসছে না। আর দেশের গরুর ব্যবসায়ীরাও ওই পথ পরিত্যাগ করে নিজেরাই মাংস উৎপাদনে সরব হয়েছে। কিন্তু এই গরুর উৎপাদন স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করলেও কেন কাঁচাবাজারে গরুর মাংসের দাম বেড়েছে?

এর জবাব দিতে উৎসাহী নয় সরকারি তরফ। গরুর ব্যবসায়ীরাও যে সিন্ডিকেট করে কাঁচাবাজারে মাংসের সরবরাহ বাড়তে দেয় না, সে খবর কি জনগণ জানে না। আজ প্রতি কেজি মাংস ৮০০ টাকা? যারা গরুর মাংসের উৎপাদন ও দেশের মানুষের চাহিদা নিয়ে সজাগ-সচেতন ও গবেষণা করেন, তারা বলেছেন, মাংসের কেজি তিনশ থেকে চারশ টাকার বেশি হতে পারে না। কাকে আমরা সত্য বলে ধরে নেবো? গবেষকদের নাকি সিন্ডিকেটেড ব্যবসায়ীদের কারসাজি?

সাধারণ ভোক্তা-শ্রেণি এই রকম সিন্ডিকেটেড ব্যবসায়ীদের গ্রাস থেকে রক্ষা পেতে চায়।

লেখক: কবি, সাংবাদিক, কলাম লেখক

 

নিউজটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © gtbnews24.com
Web Site Designed, Developed & Hosted By ALL IT BD 01722461335