রবিবার, ১২ মে ২০২৪, ০৪:১২ অপরাহ্ন

ব্যক্তি মালিকানায় রেকর্ড যশোরের হরিহর নদ

নিজস্ব প্রতিবেদক: চুরি হয়ে গেছে যশোরের হরিহর নদ। নদের জমি দখল করে মালিকানাও পরিবর্তন করে নেওয়া হয়েছে। অধিকাংশ স্থান ভরাট করে ফেলেছেন স্থানীয়রা। এখন চলছে নদের জমি ইজারা দেওয়া ও বেচাকেনা। কেউ পুকুর বানিয়ে মাছচাষ করছেন, কেউ আবার বালু তুলে বিক্রি করছেন। এমনকি লিজ নিয়ে পার্কও বানানোর চেষ্টা করছে একটি এনজিও।

তবে কর্তৃপক্ষ বলছে, নদের জমি ব্যক্তি মালিকানায় রেকর্ডের সুযোগ নেই। নদটি খননের প্রকল্প রয়েছে। অনুমোদন হলে সিএস ম্যাপ অনুযায়ী খনন করা হবে।

সূত্র জানায়, হরিহর নদটি কপোতাক্ষ নদ থেকে উৎপত্তি হয়ে খুলনার আপারভদ্রা, সর্বশেষ তেলিগাতিতে মিশেছে। ৪৫ কিলোমিটার এই নদের বেশিরভাগ এখন দখল হয়ে গেছে। অধিকাংশ স্থান ভরাট করে ফেলেছেন স্থানীয়রা। ১৫৪ জন দখলদার নদের জমি বিভিন্ন সময়ে নিজ নামে রেকর্ড করে নিয়েছেন। তারা কেউ পুকুর বানিয়ে মাছচাষ, কেউ বালু তুলে বিক্রি করছেন। যেসব স্থান দখল হয়নি, বর্ষা মৌসুমে সেসব স্থানে অল্প পানি থাকে। শীতকালে পানি শুকিয়ে হাঁটুসমান হয়ে যায়।

নদপাড়ের মণিরামপুরের কুলিন্দা গ্রামের বাসিন্দা কৃষক মোশাররফ হোসেন জানান, নদটি ঝিকরগাছা, মণিরামপুর ও কেশবপুরবাসীর সম্পদ। এই নদের পানি দিয়ে চাষবাস করা হতো। কৃষকরা পাট জাগ দিতেন। কিন্তু এখন এটি দখল হয়ে গেছে। বিভিন্ন জায়গায় বাঁধ দিয়ে মাছচাষ করছেন প্রভাবশালীরা। তারা বলেন এই জমি নাকি তাদের নামে রেকর্ড। নদীর জমি কিভাবে মানুষের নামে রেকর্ড হয় সেই প্রশ্ন করেন কৃষক মোশাররফ।

নদের পাড়ের বাসিন্দা মণিরামপুর উপজেলার এড়েন্দা গ্রামের বৃদ্ধা সৈয়দা খাতুন জানান, ছোটবেলা থেকে নদে গোসল করেছেন তিনি। এখন লোকজন দখল করে নিয়েছে। মানুষকে নামতেও দেয় না।

‘৩০ বছর আগে এই নদে স্নান করেছি, সাঁতরাইছি’ বলে স্মৃতিচারণ করেন নদের পাড়ের বাসিন্দা গোয়ালদহ গ্রামের পীযুষ বিশ্বাস।

তিনি বলেন, এখন নদের ভেতরে বিভিন্ন লোক বাঁধ দিয়ে নিজেদের সম্পত্তি বানিয়ে ফেলেছে। তারা এখানে মাছচাষ করে, কেউ বালু তুলে বিক্রি করে দেয়। এইটা যে একসময়ের প্রবল প্রবাহের নদ ছিল, তা এখন দেখে বোঝার উপায় নেই।

মণিরামপুরের গোয়ালদহ বাজারের পাশে নদের একটি অংশে ‘ইচ্ছা ফাউন্ডেশন’ নামে একটি এনজিও ‘ইএফ ফ্যামিলি পার্ক’র প্রকল্প হাতে নিয়েছে। ১৩ বিঘা জমি ঘিরে মাছ, হাঁস ও সবজিচাষের প্রকল্প দেখিয়ে তারা সরকারি ঋণ পাওয়ারও চেষ্টা করছে। এজন্য তারা নদের পাড়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ‘হরিহর নদী’ সাইনবোর্ডটিও মুছে দিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

হরিহর নদকে চুরি করে নেওয়া হচ্ছে উল্লেখ করে স্থানীয় ব্যবসায়ী তবিবর রহমান বলেন, শুনেছি, নদের একটি অংশজুড়ে পার্ক বা ফার্ম করার চেষ্টা করা হচ্ছে। নদনদী সরকারি সম্পত্তি। কখনো শুনিনি এটি ব্যক্তিগত সম্পত্তি হয় কারো। হরিহরকে এখন ব্যক্তিগত সম্পত্তি বানিয়ে বিক্রি করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, আমরা চাই, সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ নদটি দ্রুত উদ্ধার করুক। সাধারণ মানুষ যেন এখানে গোসল করতে পারে, সাঁতার কাটতে পারে, জমিতে সেচ দিতে পারে, মাছ ধরতে পারে।

এ ব্যাপারে ইচ্ছা ফাউন্ডেশনের লিগ্যাল এডভাইজার অপু হাসান বলেন, জমি মালিকের কাছ থেকে তারা ডিট করে ১৩ বিঘা জমি লিজ নিয়েছেন। কিন্তু জমির মালিকানা নিয়ে সমস্যা থাকায় প্রকল্পটি সেভাবেই পড়ে আছে।

নদের পাড়ের বাসিন্দা মণিরামপুর উপজেলার এড়েন্দা গ্রামের আলিমুন নেছা (৬৮) বলেন, ‘নদীর মদ্যি মেশিন লাগায়ে লোকজন বালি তুলতেছে। ভয় করে কখন আমার বাড়িডা ধইসে পড়ে। স্বামী-সন্তান নেই, ভয়তে কাউরে কতিও পারিনে কিছু।’

নদের জমি ব্যক্তি মালিকানায় রেকর্ড প্রসঙ্গে স্থানীয় বাসিন্দা আল রোহান বলেন, এই নদ ছোটবেলা থেকে দেখছি। সম্প্রতি জানতে পেরেছি, নদকে কৃষিজমি দেখিয়ে অনেকে নিজের নামে রেকর্ড করে দখল করেছেন। আমার দাদার নামেও কিছু জমি রেকর্ড হয়েছে। কিন্তু আমরা নদের জমি দখল করতে চাই না। আমরা চাই আমাদেরসহ যাদের ব্যক্তি নামে নদের জমি রেকর্ড হয়েছে তা বাতিল করে অবিলম্বে নদ পুনরুদ্ধার করা হোক।

যশোর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ তাওহীদুল ইসলামও স্বীকার করেছেন হরিহর নদের বাস্তবতা।

তিনি জানান, হরিহর নদ ঝিকরগাছার কপোতাক্ষ থেকে উৎপত্তি হয়ে আপারভদ্রায় মিলিত হয়েছে। সর্বশেষ এটি তেলিগাতিতে পতিত হয়েছিল। এখন অনেক স্থান ভরাট হয়ে গেছে।

নদ দখলের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা কাউকে নদ ভরাট কিংবা দখলের অনুমোদন দিইনি। যদি কেউ দখল করে থাকেন, সেটি অবৈধ। খননের সময় সবকিছু উচ্ছেদ করা হবে।’

উজানে নদের ১৫ কিলোমিটার ২০২১ সালের জুন মাসে খনন করা হয়েছে উল্লেখ করে তাওহীদুল ইসলাম আরও বলেন, বাকি ৩০ কিলোমিটার খননের একটি প্রকল্প অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছে। প্রকল্প অনুমোদন হলে সিএস ম্যাপ অনুযায়ী নদটি খনন করা হবে।

 

নিউজটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © gtbnews24.com
Web Site Designed, Developed & Hosted By ALL IT BD 01722461335