শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ১১:৩১ পূর্বাহ্ন

পোশাক শিল্পে নারী অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে ঘটছে নেতৃত্বের বিকাশ

নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশের রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮৩ শতাংশ আসে পোশাকশিল্পের হাত ধরে। এ শিল্প বিকাশের শুরু থেকেই রয়েছে নারী শ্রমিকের প্রাধান্য। পোশাকশিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক, যাদের ২৬ লাখই নারী। যদিও করোনা মহামারির পর কিছুটা কমে আসে নারী শ্রমিক। পোশাকখাতে বিপুল সংখ্যক নারী শ্রমিক থাকার পরও বিগত ৩০ বছরে এ খাতে নারী নেতৃত্বের বিকাশ হয়নি সেভাবে। কিছুটা বড় পদ হিসেবে সুপারভাইজার এবং লাইন চিফ পদে কাজ করে আসছিলেন কেউ কেই। বাকিরা সাধারণ শ্রমিক।

তবে বর্তমানে এই ধারার পরিবর্তন হচ্ছে। ধীরে ধীরে পোশাকশিল্পের বড় পদে আসছেন নারীরা। এভাবে নিজে যেমন স্বাবলম্বী হচ্ছেন, তেমনই হচ্ছে নারী নেতৃত্বের বিকাশ। মূলত বিদেশি ক্রেতার চাপ, মালিকদের আচরণ এবং কারখানায় নারীবান্ধব পরিবেশের কারণে এখন পরিবর্তন ঘটছে ধীরে ধীরে।

একটা সময় ছিল, ভালো কাজের পরিবেশ ছিল না। সেই অবস্থা এখন নেই। যে যার মতো করে কাজ করছে, কেউ কাউকে বাধা দিচ্ছে না। এখানে নারী-পুরুষ সবাই আছে, সবার সম্মিলিত কাজের মাধ্যমেই এগিয়ে যেতে হবে।

কথা হয় আশুলিয়ার ফোর-এ ইয়ার্ন ডায়িংয়ে টেকনিক্যাল ম্যানেজার পদে কর্মরত সাথি আক্তার রেনুর সঙ্গে।  তিনি বলেন, ছোট পদ থেকেই আমার কর্মজীবন শুরু হয় পোশাক কারখানায়। এরপর কাজের পরিবেশ তৈরি করে নেই। কাজে মনযোগী হওয়ায় মালিকপক্ষের সহযোগিতাও পেয়েছি। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এখন প্রায় লাখ টাকা বেতন পাচ্ছি। কারখানার পাশেই সাত কাঠা জমি কিনেছি। আমার একমাত্র ছেলে একটি স্কুলে পড়ালেখা করছে। সাড়ে চার লাখ টাকা খরচ করে জমির চারপাশে প্রাচীর দিয়েছি। আগামী দুই-এক বছরের মধ্যে আমি বাড়ির কাজ শুরু করবো।

নারী নেতৃত্বের বিকাশ নিয়ে তিনি বলেন, একটা সময় ছিল, ভালো কাজের পরিবেশ ছিল না। সেই অবস্থা এখন নেই। যে যার মতো করে কাজ করছে, কেউ কাউকে বাধা দিচ্ছে না। এখানে নারী-পুরুষ সবাই আছে, সবার সম্মিলিত কাজের মাধ্যমেই এগিয়ে যেতে হবে। তবে অনকে নারী সহকর্মী আছেন যারা একটা সময় পর গ্রামে চলে যান বা কাজ ছেড়ে দেন। কিন্তু আপনাকে কাজে লেগে থাকতে হবে, নেতৃত্বে যাওয়ার মানসিকতা থাকতে হবে। আপনার চেষ্টাই আপনাকে এগিয়ে নেবে।

কথা হয় পোশাক কারখানায় অপারেটর পদে কর্মরত দৃষ্টি প্রতিবন্ধী সুবেদা খাতুনের সঙ্গে।  তিনি বলেন, প্রতিবন্ধী হওয়ায় নানা কটুকথা শুনতে হতো গ্রামে। পরে ঢাকায় চলে আসি। এখানে এসে একটি কারখানায় কাজ শুরু করি। বেতনও ভালো পাচ্ছি। আমার স্বামীও অন্য একটি পোশাক কারখানায় কাজ করছেন। এখন স্বামী-সংসার নিয়ে ভালো আছি। কারও কথা শুনতে হচ্ছে না, কারও বোঝা হতে হচ্ছে না। বরং নিজের উপার্জিত অর্থ এখন পরিবারকে পাঠাতে পারি। নিজের সংসারে খরচের পর একটি অংশ গ্রামের বাড়িতে মা-বাবাকে দেই।

কথা হয় পোশাক কারখানায় কর্মরত আরেক প্রতিবন্ধী নারী শ্রমিক লিপি খাতুনের সঙ্গে।  লিপি বলেন, একসময় লোকমুখে শুনতাম তৈরি পোশাক কারখানায় ভালো পরিবেশ নেই। তবে বর্তমানে বাস্তবের সঙ্গে ওই কথার কোনো মিল পাই না। তালিকাভুক্ত পোশাক কারখানায় এখন নারীবান্ধব পরিবেশ রয়েছে। এরপরও কোথাও নারীদের হয়রানির কথা শুনলে প্রতিবাদ করা যায়।

‘প্রথম যখন কাজে আসি প্রতিবন্ধী বলে অন্য সহকর্মীরা আমাকে হেয় প্রতিপন্ন করেনি। বরং তারা আমাকে কাজে সহযোগিতা করেছেন বলেই আজ আমি প্রতিষ্ঠিত। বিয়ে করেছি, সংসার করছি, চাকরি করছি… সবমিলিয়ে ভালোই আছি।’

লিপি খাতুন আরও বলেন, সব মিলিয়ে বলা যায়, পোশাক কারখানায় এখন সুযোগ-সুবিধা বেশ ভালো। এখন আর বেতনের জন্য বাড়তি চিন্তা নেই। বেশ ভালো আছি, পরিবার নিয়ে আছি। আমার মতো অন্য শ্রমিকরাও ভালো আছেন। এসব কারণে এখন শ্রমিক অসন্তোষ নেই। তবে সাব কন্ট্রাক্ট কারখানায় (ছোট ছোট কারখানা) অনেক সময় নানা সমস্যা দেখা যায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতায় সেগুলোর সমস্যাও কমে এসেছে।

এসব বিষয়ে কথা হয় তৈরি পোশাক মালিক ও রপ্তানিকারক সমিতি- বিজিএমইএ’র পরিচালক এবং ফোর-এ ইয়ার্ন ডায়িং লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আব্দুল্লা হিল রাকিবের সঙ্গে।  তিনি বলেন, আমি সবসময় এটা মনে প্রাণে বিশ্বাস করি যে আমার শ্রমিক বাঁচলে উৎপাদন আসবে। যেখানে শ্রমিক অসুস্থ বা অপুষ্টিতে থাকবে, সেখানে কাজ হবে না। এভাবে কোনো কাজই টেকসই হবে না। তাই শ্রমিকের স্বাস্থ্য ও পুষ্টির কথা মাথায় রেখে আমরা স্বাস্থ্যকেন্দ্র চালু করেছি। যেখানে নারীরা সব ধরনের সেবা নিতে পারেন। পুরুষ শ্রমিকদের জন্যও আলাদা চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়াও শ্রমিকদের জন্য সুপারশপ করেছি। স্বাস্থ্যকেন্দ্রে টিম ফার্মা থেকে ওষুধ দেওয়া হচ্ছে, সুপারশপ থেকে ৩০ শতাংশ ছাড়ে পণ্য সরবরাহ করা হচ্ছে।

আব্দুল্লা হিল রাকিব বলেন, কারখানার সব শ্রমিকের ছোট শিশুর জন্য দিবাযত্ন কেন্দ্র (ডে কেয়ার সেন্টার) রয়েছে। এখানে আছে শিশুদের খাবারের ব্যবস্থা। পাশাপাশি অন্তঃসত্ত্বা নারী শ্রমিকদের জন্য রয়েছে দিনে দুই বার বিরতির ব্যবস্থা। একই সঙ্গে তাদের পুষ্টি চাহিদার জোগান দিতে ওষুধ ও খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। কারখানায় কর্মরত সবাইকে আমরা সমানভাবে দেখি। সবাইকে সমানভাবে দেখি বলেই এতদূর এগিয়েছি। এভাবেই আরও এগিয়ে যেতে চাই। আমি মনে করি, সব কারখানায় মালিক-শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হলে সবাই মিলে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী দেশ গড়তে পারবো।

প্রতিবন্ধী হওয়ায় নানা কটুকথা শুনতে হতো। পরে ঢাকায় এসে একটি কারখানায় কাজ শুরু করি। বেতনও ভালো পাচ্ছি। এখন স্বামী-সংসার নিয়ে ভালো আছি। কারও কথা শুনতে হচ্ছে না, কারও বোঝা হতে হচ্ছে না। বরং নিজের উপার্জিত অর্থ এখন পরিবারকে পাঠাতে পারি।

সবসময় মনে প্রাণে বিশ্বাস করি যে শ্রমিক বাঁচলে উৎপাদন আসবে। যেখানে শ্রমিক অসুস্থ বা অপুষ্টিতে থাকবে, সেখানে কাজ হবে না। এভাবে কোনো কাজই টেকসই হবে না। তাই শ্রমিকের স্বাস্থ্য ও পুষ্টির কথা মাথায় রেখে আমরা স্বাস্থ্যকেন্দ্র চালু করেছি।

নিউজটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © gtbnews24.com
Web Site Designed, Developed & Hosted By ALL IT BD 01722461335