শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৫:৫২ পূর্বাহ্ন

সুপারির খোলে নান্দনিক তৈজসপত্র

নিজস্ব প্রতিবেদক: লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলায় সুপারি গাছের ঝরে যাওয়া পাতা-খোল দিয়ে গৃহস্থালির নান্দনিক তৈজসপত্র তৈরি হচ্ছে। এতে থালা, বাটি, নাস্তার ট্রে, ঘড়ি, ফটোফ্রেম, বিয়ের কার্ড, ওয়ালমেট ও জুতাসহ ১৪টি পণ্য তৈরি হচ্ছে। ব্রাদার্স ইকো ক্রাফট নামের একটি প্রতিষ্ঠানের তৈরিকৃত পরিবেশবান্ধব ও স্বাস্থ্যসম্মত এসব পণ্য যাচ্ছে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। ইউটিউবে এসব পণ্য তৈরির ভিডিও দেখে আগ্রহী হয়ে উদ্যোক্তা মামুনুর রশিদ গড়ে তুলেছেন কারখানাটি।

এদিকে ২০১৯ সালের ৬ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকায় বহুমুখী পাট পণ্য মেলার স্টল পরিদর্শনকালে সুপারির খোলে তৈরি করা উদ্যোক্তা মামুনের নান্দনিক তৈজসপত্র হাতে নিয়ে দেখেন। একই বছরের আগস্টে নিউজিল্যান্ড থেকে জেরিক নামের এক বায়ার রায়পুর কারখানায় আসেন। এ সময় গ্রামীণ পরিবেশে উৎপাদিত এসব পণ্য দেখে তিনি উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন।

২০১৭ সালে ইউটিউবে ভিডিও দেখে সুপরির খোলে তৈজসপত্র তৈরিতে আগ্রহী হন রায়পুর পৌরসভার দক্ষিণ-পশ্চিম কেরোয়ার তুলাতলি এলাকার মামুনুর রশিদ। ২০১৯ সালের শুরুতে তিনি একটি টিনশেড ঘরে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি বসিয়ে খোল দিয়ে বিভিন্ন পণ্য তৈরির কাজ শুরু করেন। দূর-দূরন্ত থেকে সৌখিন লোকজন কারখানাটি দেখতে আসেন। কারখানায় যাওয়ার পথে দুপাশে নজর কাড়ে ভরপুর সবুজ গাছ-গাছালি। সবুজ-শ্যামল পরিবেশেই কারখানাটির অবস্থান।

কারখানায় গিয়ে দেখা গেছে, ৩ জন নারী শ্রমিক কাজ করছেন। তারা বাছাই করা নির্দিষ্ট আকারে সুপারির খোল কাটছেন। এরপর অত্যাধুনিক মেশিনের মাধ্যমে তৈরি করছেন থালা ও বাটি। শ্রমিকদের চোখে-মুখে যেন ব্যস্ততার চাপ। বাসন-কোসনসহ ১৪ ধরনের পণ্য তৈরি করছেন। এখানে ১০ জন শ্রমিক নিয়মিত কাজ করেন। এরই মধ্যে ২০ লক্ষাধিক টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। এটি লক্ষ্মীপুরের প্রথম কারখানা। শুকনো খাবার পরিবেশন ও পানির ব্যবহার না করলে কয়েক বছর ব্যবহার করা যায়। এতে কোনো ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহার করা হয় না।

শ্রমিক রেজিয়া খাতুন বলেন, ‘প্রথমে খোল বাছাই করে জীবাণুমুক্ত করা হয়। এরপর তা হাতে কেটে বিদ্যুচ্চালিত মেশিনের মাধ্যমে বাসন-কোসন বানানো হয়। আমি এখানে এসেই কাজ শিখেছি। মাস শেষে পাওয়া টাকায় আমার সংসার চলে।’

জেলা কৃষি বিভাগ জানায়, মেঘনা উপকূলীয় জেলা লক্ষ্মীপুরে ৭ হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে সুপারি বাগান আছে। এ বছর সুপারিকে ঘিরে হাজার কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। গত বছর প্রায় ৫৫০ কোটি টাকা আয় করেছেন লক্ষ্মীপুরের কৃষক ও ব্যবসায়ীরা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বংশ পরম্পরায় অপরিকল্পিতভাবে করা সুপারি বাগানে প্রচুর পাতা-খোল (স্থানীয়ভাবে বাইল বলে) হয়। এতে পাতা-খোল সহজলভ্য। সাধারণত এ খোল কুড়িয়ে নিয়ে জ্বালানির কাজে ব্যবহার করা হয়। এটি অনেকটাই ফেলনা ছিল। অনেক মালিক না কুড়ানোর কারণে বাগানেই তা পড়ে নষ্ট হতো।

সুপারির খোল দিয়ে নান্দনিক গৃহস্থালির পণ্য তৈরি হয়, তা সম্প্রতি জানাজানি হচ্ছে। এতে স্থানীয়ভাবে সুপারির খোলের কদর বাড়ছে। অতীতে অনেক মালিক বাগান থেকে না তুললেও এখন বাণিজ্যিকভাবে বিক্রি করার উদ্দেশে পাতা-খোল সংরক্ষণ করা হচ্ছে। জেলার যেখানেই খোলের সন্ধান পান-ছুটে যান মামুন। ঝরে পরা পাতা-খোল এখন কেনাবেচা হয়।

৫৪ বছর বয়সী মামুনুর রশিদ বলেন, ‘সুপারি গাছের খোলে তৈরি তৈজসপত্রগুলো পরিবেশবান্ধব। নান্দনিক এসব পণ্যের দেশ-বিদেশে প্রচুর চাহিদা। যত্ন নিয়ে ব্যবহার করলে এগুলো কয়েক বছর পর্যন্ত টেকে। প্ল্যাস্টিকের বিকল্প হিসেবে আমাদের পণ্যগুলো ব্যবহার করা যায়। অনলাইন মার্কেটিংয়ের পাশাপাশি চাহিদা অনুযায়ী পরিচিতদের কাছে বিক্রি করছি। বড় পরিসরে কারখানা স্থাপন ও নতুন পণ্য তৈরির পরিকল্পনা আছে। তৈজসপত্র তৈরির উদ্যোক্তা বেশি হলে এটি শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে। বিপুল কর্মসংস্থান হবে।’

রায়পুর পৌরসভার মেয়র গিয়াস উদ্দিন রুবেল ভাট বলেন, ‘একসময় সুপারির খোল ফেলনা ছিল। এখন খোল থেকে বাহারি পণ্য তৈরি হচ্ছে। উদ্যোক্তাদের সহজ শর্তে ঋণ ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা থাকলে এর প্রসার ঘটনো সম্ভব। এতে এলাকায় কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।’

লক্ষ্মীপুর বিসিক শিল্পনগরী বিভাগের উপ-ব্যবস্থাপক (ভারপ্রাপ্ত) মো. মাকছুদুর রহমান বলেন, ‘নতুন শিল্প উদ্যোক্তাদের ঋণ সহায়তা দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। মামুনুর রশিদ চাইলে ঋণ নিতে পারেন। তার তৈরি পণ্যের প্রচারণার জন্য আমাদের অনলাইনের সহযোগিতা নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।’

 

নিউজটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © gtbnews24.com
Web Site Designed, Developed & Hosted By ALL IT BD 01722461335