বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ০৬:৩৩ পূর্বাহ্ন

রাবার ড্যামের সুফল দিনাজপুরে কৃষির পালে হাওয়া, বদলে গেছে জেলে-জীবিকা

নিজস্ব প্রতিবেদক: দিনাজপুরের চার নদীতে রাবার ড্যাম ও জলকপাট দুই দশক ধরে কৃষকের আশীর্বাদ হয়ে কাজ করছে। কম খরচে সেচ সুবিধা ছাড়াও নদীতে বেড়েছে মাছ। ফলে জেলের সংখ্যা বাড়ার পাশাপাশি ড্যামকেন্দ্রিক গড়ে উঠেছে পর্যটন শিল্প, যা জেলার অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। সহজ সেচের আওতায় এসেছে জেলার ১১ হাজার ৬৬৫ হেক্টর কৃষিজমি।

জানা গেছে, ২০০৩ সালে দিনাজপুরের চিরিরবন্দর কাঁকড়া নদীতে প্রথম রাবার ড্যাম নির্মাণ হয়। এরপর একে একে সদরের আত্রাই, বোচাগঞ্জের টাংগন এবং বিরলের পুনর্ভবা নদীতে আরও তিনটি রাবার ড্যাম নির্মাণ হয়। এছাড়া চিরিরবন্দরের চিরি নদীতে রয়েছে মিনি রাবার ড্যাম।

কয়েক দশক ধরে উত্তরের জেলা দিনাজপুরে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছিল। এতে ওই অঞ্চলের কৃষিতে বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করে। চারটি রাবার ড্যাম, একটি মিনি রাবার ড্যাম এবং দুটি জলকপাট এখন অনেক কৃষকের জন্য স্বস্তির উৎস হিসেবে কাজ করছে।

মোহনপুর রাবার ড্যাম
এটি চিরিরবন্দর ও সদর উপজেলার আত্রাই নদীতে অবস্থিত একটি রাবার ড্যাম বা ব্যারাজ। সদর উপজেলার ৮ নম্বর শংকরপুর ইউনিয়নের মধ্যে আত্রাই নদীর ওপর ২০১৩ সালের ২২ অক্টোবর এ ড্যাম উদ্বোধন করা হয়। ১৭ কোটি ৫১ লাখ ১৫ হাজার টাকা ব্যয়ে নির্মিত রাবার ড্যামটি এক দশক ধরে অনেক কৃষককে বেশি ধান উৎপাদন করতে, তাদের সেচ খরচ কমাতে এবং অন্য সবজি চাষে সহায়তা করছে। প্রচুর পানি প্রবাহের ফলে এলাকার জেলেরাও অনেক উপকৃত হচ্ছেন। ১৩৫ মিটার দৈর্ঘ্যের বাঁধটির খরিপ মৌসুমে প্রায় ৪৪ কিলোমিটার এলাকায় নদীর পানি মজুত রাখার ক্ষমতা রয়েছে। বর্তমানে প্রায় এক হাজার হেক্টর জমির সেচ এই ড্যামে করা হয়। ফলে এলাকায় চাষাবাদ ১০ শতাংশ বেড়েছে। যার পরিমাণ ৬ দশমিক ৬ মেট্রিক টন। এ ড্যামে ৪ হাজার সমিতিভুক্ত সদস্যসহ ৬০ হাজার কৃষক বিভিন্নভাবে সুবিধা ভোগ করছেন। এছাড়া মাছ চাষসহ এ প্রকল্প ঘিরে তৈরি হয়েছে পর্যটন এলাকা।

পুনর্ভবা নদী রাবার ড্যাম
২০১৬ সালে ১২ কোটি ৪৫ লাখ টাকা ব্যয়ে সর্বশেষ রাবার ড্যাম নির্মাণ হয় বিরল উপজেলার ১২ নম্বর ইউনিয়নের পুনর্ভবা নদীর ওপর। এতে কৃষক আর মৎস্যজীবীদের ভাগ্যের দরজা খুলেছে। ড্যামটির কারণে মরুকরণের কবল থেকে রক্ষা পেয়েছে ১০০০ হেক্টর ফসলি জমি। ফলে প্রায় ৬ হাজার টন অতিরিক্ত খাদ্যশস্য উৎপাদিত হচ্ছে। এতে বছরে প্রায় ৫ কোটি টাকা আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন সুবিধাভোগীরা। এছাড়া এ প্রকল্পের মাধ্যমে নদীর ৪৪ কিলোমিটার দীর্ঘ পানিতে মাছ চাষের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এ ড্যামের আওতায় সরাসরি সমিতিভুক্ত উপকার ভোগীর সংখ্যা ৯৯২ । ৯০ মিটার দীর্ঘ রাবার ড্যাম থেকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বিরল এবং কাহারোল উপজেলার প্রায় ৫০ হাজার পরিবার সুবিধা ভোগ করছেন।

টাঙ্গন নদী রাবার ড্যাম
২০১৩ সালে বোচাগঞ্জ উপজেলার ৫ নম্বর ছাতইল ইউনিয়নের টাঙ্গন নদীতে ১১ কোটি ১৫ লাখ টাকা ব্যয়ে তৈরি হয় রাবার ড্যাম। আশির দশকেও এই নদীতে ১২ মাস পানির প্রবল স্রোত থাকতো। তবে সেই টাঙ্গন যৌবন হারিয়ে এখন মৃতপ্রায়।

টাঙ্গনের যৌবন হারানোর প্রভাব পড়ে আশপাশের এলাকায়। নদীর দুই পাশের বিস্তীর্ণ এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যায়। টাঙ্গন নদীর দুপাশে বোচাগঞ্জ উপজেলার প্রায় এক হাজার হেক্টর আবাদি জমি পানির অভাবে অনাবাদি পড়ে থাকতো শুষ্ক মৌসুমে। এসব জমিতে চাষাবাদ করতে স্বাভাবিকের চেয়ে তিনগুণ খরচ গুনতে হতো।

তবে এ এলাকার কৃষকের মুখে হাসি ফোটায় রাবার ড্যামটি। ২০১৩ সালে বোচাগঞ্জের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া টাঙ্গন নদীতে শুষ্ক মৌসুমে পানি ধরে রাখতে নির্মাণ করা হয় এ রাবার ড্যাম। এটি নির্মাণের পর থেকেই হাসি ফোটে বোচাগঞ্জ উপজেলার প্রায় ২১ গ্রামের মানুষের মুখে।

স্থানীয় নোমান আলী নামে এক কৃষক জানান, দীর্ঘদিন খরা মৌসুমে পানির অভাবে চাষাবাদ করা যেত না। নদীতে পানি না থাকায় শ্যালো মেশিন চালু করেও পানির লেয়ার পাওয়া যায়নি। কোনো স্থানে লেয়ার পাওয়া গেলেও সেচ দিতে খরচ অনেক বেশি হতো।

তিনি বলেন, এ ড্যামের আওতায় সরাসরি চার হাজার সমিতিভুক্ত ৫০ হাজার মানুষ বিভিন্নভাবে সুবিধা ভোগ করছে। এতে বছরে প্রায় পাঁচ কোটি টাকা আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন কৃষকরা। খরিপ মৌসুমে এ প্রকল্পের আওতায় সেচ সুবিধা বৃদ্ধির মাধ্যমে বছরে বোরো ধানের অতিরিক্ত প্রায় সাড়ে তিন হাজার টন উৎপাদন বেড়েছে।

কাঁকড়া নদী রাবার ড্যাম
চিরিরবন্দরে কাঁকড়া নদীর ওপর এ ড্যাম নির্মাণের ফলে কৃষির অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে। সেচ সুবিধার ফলে লাভবান হচ্ছে দুইকূলের সমিতিভুক্ত এক হাজার ৬১৭ সদস্যসহ প্রায় পাঁচ হাজার কৃষক ও দুই হাজার জেলে পরিবার। এছাড়া কৃষি, মাছ চাষসহ এ প্রকল্প ঘিরে তৈরি হয়েছে পর্যটন এলাকা।

চিরিরবন্দর উপজেলার উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাঁকড়া নদীর ওপরে আট কোটি ৪০ লাখ টাকা ব্যয়ে ১৩০ ফুট দীর্ঘ রাবার ড্যামটি নির্মাণ করে দিনাজপুর এলজিইডি। এতে উপজেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া আত্রাই ও কাঁকড়া নদীর ১০ কিলোমিটার, পাশের ১২ কিলোমিটার এবং কয়েকটি শাখা খালে সারাবছর পানি আটকে রাখা সম্ভব হয়েছে। উপজেলার ১ হাজার ২০৫ হেক্টর জমি সেচ সুবিধার আওতায় এসেছে। এতে চার হাজার ৯৫০ কৃষক ড্যামের পানি দিয়ে ফসল উৎপাদন করছেন। বিভিন্নভাবে সুবিধা নিচ্ছেন আরও প্রায় ৩০ হাজার মানুষ।

শীত মৌসুমে এখানে অনেকে আসছেন বনভোজনে। রাবার ড্যাম শুধু কৃষকদের ভাগ্যই বদলায়নি, পুরো এলাকার প্রাকৃতিক পরিবেশেও এসেছে ভারসাম্য। এছাড়া চিরি লিঙ্ক নদীর ওপর একটি মিনি ড্যাম স্থাপন করায় কৃষকরা উপকৃত হচ্ছেন।

বেলান নদীর ড্যাম
খানসামা উপজেলার ভাবকী ইউনিয়নে প্রবাহিত বেলান নদীতে নির্মাণ হচ্ছে রাবার ড্যাম। এটি নির্মাণে ওই অঞ্চলের এক হাজার হেক্টর জমি সেচের আওতায় আসবে। চলমান কাজের গতি অব্যাহত থাকলে ২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বরের নির্মাণ কাজ শেষ হবে বলে জানান এলজিইডি নির্বাহী প্রকৌশলী এ এস এম খায়রুল ইসলাম।

তিনি জানান, এলজিইডির ক্ষুদ্রাকার পানি সম্পদ উন্নয়ন প্রকল্পের (দ্বিতীয় পর্যায়) আওতায় বেলান নদীতে ওই রাবার ড্যামটি নির্মাণ হচ্ছে। প্রকল্পের অধীনে ৩৫ মিটার দৈর্ঘ্যের রাবার ড্যামসহ পাম্প হাউজ, অ্যাপ্রোচ রোড, বেলান নদীর বাম ও ডান তীরে হেডার ট্যাংকসহ বারিড পাইপ নেটওয়ার্ক নির্মাণ, পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতির অফিস করা হবে।

এছাড়া আট কিলোমিটার বেলান খাল, এক হাজার ৪৯০             মরা নদী ও ৭২৫ মিটার শাখা খাল খনন করা হবে। এটি নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৪ কোটি ১৫ লাখ ৭৬ হাজার টাকা। বাংলাদেশ সরকার ও জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) অর্থায়নে নির্মাণ হচ্ছে ড্যামটি।

গৌরীপুর জলকপাট
সদর ও বিরল দুই উপজেলার যোগাযোগব্যবস্থা এবং খরা মৌসুমে সম্পূরক সেচের লক্ষ্যে পুনর্ভবা নদীতে নির্মিত হয়েছে জলকপাট। দিনাজপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তত্ত্বাবধানে খরিপ মৌসুমে সম্পূরক সেচের লক্ষ্যে সমন্বিত পানি নিয়ন্ত্রণ অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্পের অধীনে গৌরীপুর-রানীপুর এলাকায় জলকপাট ও সেতু নির্মাণ করা হয়েছে।

দিনাজপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী রাকিবুল ইসলাম বলেন, দুই উপজেলার প্রায় চার হাজার ২০০ হেক্টর অনাবাদি জমি চাষের আওতায় এসেছে। এছাড়া সেতু নির্মাণের ফলে যোগাযোগব্যবস্থা ও আর্থসামাজিক ব্যবস্থারও উন্নয়ন হয়েছে। তবে এ সেতুতে ভারী যানবাহন চলাচলের অনুমতি মিলবে না।

বীরগঞ্জ জলকপাট
পাউবোর তত্ত্বাবধানে খরিপ মৌসুমে সম্পূরক সেচ দেওয়ার লক্ষ্যে পুনর্ভবা নদীর ওপর ঢেপা নদীর সেচ প্রকল্পের আওতায় জলকপাট ও সেতু নির্মাণ করা হয়। ২০১০ সালে এ জলকপাট ও সেতু উদ্বোধন করা হয়। জলকপাট নির্মাণে ১৩ কোটি ৬৮ লাখ ৭২ হাজার এবং সেতু নির্মাণে ব্যয় হয় ৮১ কোটি ২৩ লাখ টাকা। ফলে এক হাজার ২১৫ হেক্টর জমি সেচের আওতায় আসে। ধান উৎপাদন বেড়েছে দুই হাজার ৩০০ এবং শস্য বেড়েছে এক হাজার ৮০০ মেট্রিক টন।

চিরিরবন্দর উপজেলার কৃষক আইনুল ইসলাম বলেন, আগে এক বিঘা জমিতে সেচ দিতে প্রায় চার হাজার টাকা লাগতো, এখন ড্যামের পর্যাপ্ত পানি পাওয়া যায়। ফলে সেচ খরচ দুই থেকে আড়াই হাজার টাকায় নেমেছে। রাবার ড্যাম এবং জলকপাট শুধু কৃষকদের মুখেই হাসি ফোটায়নি। নদীতে মাছ চাষের সুযোগও সৃষ্টি করেছে।

রাবার ড্যাম বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান এলজিইডি দিনাজপুরের নির্বাহী প্রকৌশলী এফ এম খায়রুল ইসলাম বলেন, পানির স্তর দিন দিন নিচে নামছে। রাবার ড্যামগুলো তৈরির মাধ্যমে জমিয়ে রাখা উপরিভাগের পানি ব্যবহার করছি। এতে পানির স্তর রক্ষা পাচ্ছে। এছাড়া খরিপ মৌসুমে কম খরচে ও সহজে সেচ পাওয়ায় উৎপাদনও বেড়েছে। এছাড়া বেকার জেলেদের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি দেশি প্রজাতির মাছ বাড়ছে। ফলে স্থানীয় অর্থনীতিতে এ ড্যাম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এছাড়া পর্যটককেন্দ্রিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানও তৈরি হয়েছে রাবার ড্যাম এলাকায়। এতে অনেকের কর্মসংস্থান হয়েছে।

দিনাজপুর পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী রাকিবুল ইসলাম বলেন, গৌরীপুর জলকপাট নির্মাণের ফলে সদর ও বিরল দুই উপজেলার প্রায় চার হাজার ২০০ হেক্টর অনাবাদি জমি চাষের আওতায় এসেছে। এছাড়া সেতু নির্মাণের ফলে যোগাযোগব্যবস্থা ও আর্থসামাজিক ব্যবস্থারও উন্নয়ন হয়েছে। তবে এই সেতু দিয়ে ভারী যানবাহন চলাচলের অনুমতি মিলবে না।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, দিনাজপুরে প্রতিবছর শুষ্ক মৌসুমে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর তিন থেকে ছয় ফুট নিচে নেমে যায় এবং প্রতি পাঁচ বছরে স্তরটি গড়ে এক থেকে দুই ফুট পর্যন্ত নামে।

অধিদপ্তর বলছে, গত ১০ বছরে দিনাজপুরে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দুই থেকে চার ফুট নিচে নেমেছে। কিন্তু রাবার ড্যাম এবং জলকপাটের কারণে দুই দশক ধরে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর কমলেও সদর, চিরিরবন্দর, বিরল, বোচাগঞ্জ, কাহারোল, বীরগঞ্জ উপজেলার কৃষকরা কিছুটা স্বস্তি পেয়েছেন।

দিনাজপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, যেসব উপজেলায় রাবার ড্যাম রয়েছে সেসব উপজেলায় চাষাবাদ ১০ শতাংশ বেড়েছে। জেলার অন্য এলাকায় বোরো ধানের ফলন প্রতি হেক্টরে ছয় মেট্রিক টন হলেও বাঁধের কাছাকাছি এলাকায় হয় ছয় দশমিক ছয় মেট্রিক টন।

মৎস্য কর্মকর্তা মুক্তাদির খান বলেন, গত কয়েক বছরে জেলায় মাছ ও জেলের সংখ্যাও বেড়েছে। ২০১৬ সালে জেলায় প্রায় ১১ হাজার ৫৭ জেলে ছিল ২০২১ সালে তা বেড়ে হয়েছে ১১ হাজার ৯১২। ২০২০-২১ অর্থবছরে মাছ উৎপাদন হয়েছে ৬২ হাজার ৭৭০ মেট্রিক টন।

 

নিউজটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © gtbnews24.com
Web Site Designed, Developed & Hosted By ALL IT BD 01722461335