শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৪:৫৬ পূর্বাহ্ন

উশৃঙ্খলরা ছাত্ররাজনীতির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস নষ্ট করছেন: হাইকোর্ট

নিজস্ব প্রতিবেদক: কিছু শিক্ষার্থীর উশৃঙ্খল আচরণে ও শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনায় দেশের ছাত্ররাজনীতির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে বলে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন হাইকোর্ট। একই কারণে দলের (ছাত্রসংগঠন) ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ণ হচ্ছে বলে উল্লেখ করেছেন হাইকোর্ট।

পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতির নামে কিংবা রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে কিছু উশৃঙ্খল শিক্ষার্থী নবাগতদের র‌্যাগিংয়ের নামে অমানবিক নির্যাতনের ঘটনায় উদ্বেগও প্রকাশ করেন উচ্চ আদালত।

বুধবার (১ মার্চ) হাইকোর্টর বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতির রাজিক আল জলিলের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এমন পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে (ইবি) দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলে শিক্ষার্থী ফুলপরী খাতুনকে রাতভর মারধর ও শারীরিক নির্যাতনের ঘটনায় দুটি তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন জমার পর কয়েক দফা নির্দেশনাসহ এই পর্যবেক্ষণ দেন আদালত।

আদালতে আবেদনের পক্ষে ছিলেন রিটকারী আইনজীবী গাজী মো. মহসীন। তার সঙ্গে ছিলেন আজগর হোসাইন তুহিন। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল তুষার কান্তি রায়। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী অ্যাডভোকেট শাহ মঞ্জুরুল হক।

রিটকারী আইনজীবী গাজী মো. মুহসীন আদালতের বরাত দিয়ে  জানান, আদালত সুষ্পষ্ট অবজারভেশন (পর্যবেক্ষণ) দিয়ে বলেছেন, ‘ছাত্ররাজনীতির একটি গৌরবোজ্জ্বল অতীত আছে, ইতিহাস আছে। সেই ইতিহাসকে ব্যবহার করে রাজনীতিকে কলঙ্কিত করছে, এটা ছাত্ররাজনীতির জন্যও খারাপ, শিক্ষার্থীদের জন্যও খারাপ।’

‘আদালত বলেন, বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে দেখা যাচ্ছে, সম্প্রতি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, নির্দিষ্টভাবে বললে আবাসিক হল ও হোস্টেলে কিছু উশৃঙ্খল শিক্ষার্থী তাদের রাজনৈতিক পরিচয়ের অপব্যবহার করে অপ্রত্যাশিত ঘটনায় জড়িয়ে পড়ছেন। এসব শিক্ষার্থীরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভেতরে ঢুকে সাধারণ শিক্ষার্থী বিশেষ করে নবাগতদের নির্যাতন করেন। এ ধরনের অবাধ্য ছাত্ররা শিক্ষার মানসম্মত পরিবেশ বাধাগ্রস্ত করেন। এমনকি তাদের দলীয় শৃঙ্খলাও ভঙ্গ করেন। এর মাধ্যমে তারা দলের পাশাপাশি ছাত্র রাজনীতির গৌরবোজ্জ্বল ভাবমূর্তি ভূলুণ্ঠিত করছেন’ বলে জানান গাজী মো. মুহসীন।

তিনি আরও জানান, আদালত একপর্যায়ে বলেন, ‘বিচার তো আমরা করছি না। বিচার করবে বিশ্ববিদ্যালয়, তারা রিপোর্ট (তদন্ত প্রতিবেদন) পুঙ্খানুপুঙ্খ দেখে সিদ্ধান্ত দেবেন। আমরা উদ্বিগ্ন অন্য সব শিক্ষার্থী ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ে। অনেক সময় রাজনৈতিক আশ্রয়ের অপব্যবহার করে দলের ভাবমূর্তি নষ্ট করার ঘটনাও ঘটছে। ছাত্ররাজনীতির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস নষ্ট করা হচ্ছে। এভাবে চললে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করো- এমন কথাও উঠতে পারে। তবে ছাত্ররাজনীতির যে প্রয়োজন, সেটি ইতিহাস থেকে দেখেছি। কিন্তু এটাকে নষ্ট করার জন্য, ক্ষুণ্ণ করার জন্য, অনেকে না বুঝে করেন, অনেকে বুঝেও করেন। এটা থেকে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।’

এদিন, শুনানি শেষে দুটি তদন্ত প্রতিবেদন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে সিলগালা করে পাঠানোর আদেশ দেন আদালত। ওই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে জড়িত শিক্ষার্থী, অবহেলা করা হল প্রশাসনসহ অন্যদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও বিধি অনুসারে ব্যবস্থা নিতে কর্তৃপক্ষের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসা পর্যন্ত ছাত্রলীগ নেত্রী অন্তরাসহ পাঁচ ছাত্রীকে সব ধরনের শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ ও ক্যাম্পাসের বাইরে অবস্থান করতে বলা হয়েছে।

পাঁচ ছাত্রী হলেন- পরিসংখ্যান বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি সানজিদা চৌধুরী অন্তরা, চারুকলা বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের হালিমা আক্তার উর্মি, আইন বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে ইসরাত জাহান মীম, ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে তাবাসসুম ইসলাম ও মোয়াবিয়া জাহান।

নির্যাতনের শিকার শিক্ষার্থী ফুলপরী খাতুনের ভিডিও করা চারুকলা বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী হালিমা আক্তার উর্মির মোবাইল ফোন সংগ্রহ ও ধারণ করা ভিডিও উদ্ধার করে আদালতে জমা দিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি নির্ভয়ে স্বাভাবিক শিক্ষাজীবন চালিয়ে নিতে তিনদিনের মধ্যে আবাসিক হলে ফুলপরীর জন্য সিট বরাদ্দ দিতে বিশ্ববিদ্যালয় ও হল কর্তৃপক্ষকে বলা হয়েছে।

একইসঙ্গে কুষ্টিয়া ও পাবনার পুলিশ সুপারসহ (এসপি) বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে ফুলপরীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। ঘটনার সাক্ষীদেরও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। এ আদেশের বিষয়ে ৮ মের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও রেজিস্ট্রারকে নির্দেশ দেন আদালত।

আদেশের সময় আদালত রিটকারী আইনজীবীর উদ্দেশে বলেন, ‘আমরা বিষয়টি মনিটরিংয়ে রাখবো। আপনিও এ বিষয়ে খেয়াল রাখবেন। কোনো সমস্যার উদ্ভব হলে আদালতকে জানাবেন। তখন আমরা প্রয়োজনীয় আদেশ দেবো।’

গত ১২ ফেব্রুয়ারি ইবির দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলে রাত সাড়ে ১১টা থেকে রাত প্রায় ৩টা পর্যন্ত শারীরিক নির্যাতন করা হয় নবাগত ছাত্রী ফুলপরী খাতুনকে। ভুক্তভোগী ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী।

অভিযোগ ওঠে, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি সানজিদা চৌধুরী অন্তরা ও তার সহযোগীরা ফুলপরীর ওপর নির্যাতন চালিয়েছেন। ভুক্তভোগীর অভিযোগ, তারা ওই শিক্ষার্থীকে মারধর করে তার বিবস্ত্র ভিডিও ধারণ করে রাখেন।

এ ঘটনায় ১৩ ফেব্রুয়ারি সকালে ভয়ে হল ছেড়ে বাসায় চলে যান ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী। র‌্যাগিংয়ের নামে শারীরিক ও মানসিকভাবে হেনস্তার বিচার ও নিরাপত্তা চেয়ে ১৪ ফেব্রুয়ারি হল প্রভোস্ট, প্রক্টর ও ছাত্র উপদেষ্টা দপ্তর বরাবর লিখিত অভিযোগ দেন তিনি। বিষয়টি নিয়ে হল প্রশাসন ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং শাখা ছাত্রলীগ পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করে।

এর মধ্যে বিষয়টি নিয়ে হাইকোর্টে রিট করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী গাজী মো. মহসীন। হাইকোর্ট প্রশাসন ক্যাডার, বিচার বিভাগ ও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের সমন্বয়ে একটি কমিটি করে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলে কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দেন। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের গঠিত কমিটির প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন। এ সময় দুই অভিযুক্তকে ক্যাম্পাসের বাইরে রাখতে বলা হয়।

সেই অনুসারে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কমিটি এবং উচ্চ আদালতের নির্দেশে গঠিত কমিটির প্রতিবেদন হাইকোর্টে পাঠানো হয়। প্রতিবেদন পাঠানোর পর ২৭ ফেব্রুয়ারি ওই পাঁচ শিক্ষার্থীর আবাসিকতা বাতিল করা হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, পরিসংখ্যান বিভাগের ২০১৭-১৮ সেশনের শিক্ষার্থী সানজিদা চৌধুরী অন্তরার নির্দেশে পরিসংখ্যান বিভাগের ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ফুলপরীকে র‌্যাগিং ও শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতন করা হয়। এ অমানবিক, পাশবিক, শারীরিক, ন্যক্কারজনক, জঘন্য ঘটনার সঙ্গে সরাসরি চারুকলা বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী হালিমা আক্তার উর্মি, আইন বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের ইসরাত জাহান মীম, ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের তাবাসসুম ইসলাম ও মোয়াবিয়া জড়িত ছিলেন। এছাড়া আল আমিন নামে একজনের সঙ্গে অন্তরার মোবাইলে কথা হয়। সেই ফোন কলে আল আমিন হুমকি দিয়েছেন বলেও প্রতিবেদনে বলা হয়।

এদিকে, উচ্চ আদালতের নির্দেশে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী- অন্তরা নির্দেশ দেন প্রত্যেকে যেন ফুলপরীকে একটা একটা করে চড় মারেন। আর লিমা ফুলপরীর মোবাইল কেড়ে নেন এবং সবাই অন্তরার পা ধরতে ফুলপরীকে বাধ্য করেন। এছাড়া প্রভোস্ট হলে থাকা অবস্থাতেই অন্তরা, তাবাসসুম, মীম, উর্মি, মোয়াবিয়াসহ অন্যরা ফুলপরীকে হাত ধরে টানাটানি করে হেনস্তা করেন। একপর্যায়ে প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. শামসুল আলম বরাবরে মুচলেকা দিতে বাধ্য করেন।

প্রতিবেদনে এ ঘটনায় প্রভোস্ট ড. শামসুল আলম, সহকারী রেজিস্ট্রার আব্দুর রাজ্জাক, কর্মকর্তা হালিমা খাতুন, একজন আয়া, ডাইনিং ম্যানেজার সোহেল রানা, হাউজ টিউটর মৌমিতা আক্তার, ইসরাত জাহানদের দায়িত্বে চরম অবহেলা এবং ফুলপরী ইস্যুতে ব্যাপক গাফিলতি ছিল বলে উল্লেখ করা হয়। এছাড়া প্রক্টর শাহাদাত হোসেন আজাদের উদাসীনতার কথাও উল্লেখ করা হয়।

 

নিউজটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © gtbnews24.com
Web Site Designed, Developed & Hosted By ALL IT BD 01722461335