শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৫:০২ অপরাহ্ন

কিভাবে বুঝবেন আপনি করোনায় আক্রান্ত ?

জিটিবি নিউজডেস্কঃ বর্তমানে বৈজ্ঞানিক গবেষণা অনুসারে আমরা জানতে পেরেছি যে যখন কোনো সংক্রামিত ব্যক্তি হাঁচি বা কাশি দেয় বায়ুতে, তখন খুব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভাইরাসযুক্ত কণা নির্গত হয়। যদি কোনো সুস্থ ব্যক্তি সেই বাতাস শ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করে, তবে ভাইরাসটি তার নাক ও গলায় ঢোকে। মানবদেহের শ্বাসযন্ত্রের এপিথেলিয়াম কোষগুলো এনজিওটেনসিন-রূপান্তরকারী এনজাইম ২ (এসিই-২) নামক প্রোটিন সমৃদ্ধ হয়। প্রকৃতপক্ষে মানবদেহের সর্বত্র, এসিই-২ প্রোটিনের উপস্থিতি, যা সাধারণত রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। করোনভাইরাস আক্রমণের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে করোনভাইরাসের এস-প্রোটিন মানব শ্বাসযন্ত্রের এপিথেলিয়াম কোষগুলোর প্রোটিনের সঙ্গে তালা–চাবির মতো সংযুক্ত হয় এবং মানুষের দেহের কোষে ভাইরাস ঢোকার সুযোগ করে দেয়। এত দিন পর্যন্ত জানা ছিল যে এসিই-২ রিসিপ্টারের মাধ্যমে করোনাভাইরাস মানবদেহের কোষে প্রবেশ করে। সাম্প্রতিক কালে হার্ভার্ড ও এমআইটির একদল বিজ্ঞানীর সেল জার্নালে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, মানবকোষে করোনভাইরাস প্রবেশের জন্য এসিই-২ প্রোটিনের সঙ্গে টিএমপিআরএ-২ প্রোটিনও প্রয়োজন হয়। তাঁরা দেখিয়েছেন যে এসিই-২ ও টিএমপিআরএ-২ উভয়ই ফুসফুসের টাইপ-২ নিউমোসাইটস, ইলিয়াল শোষণকারী এন্টোসাইট ও অনুনাসিক গোবলেট সিক্রিটরি কোষগুলোয় সহাবস্থান করে এবং প্রচুর পরিমাণে বৃদ্ধি পায়।

ভাইরাসটি কোষের ভেতরে প্রবেশের পরেই এটি মানবকোষের প্রক্রিয়া ব্যবহার করে অগণিত কপি তৈরি করে এবং অন্য কোষগুলোকে আক্রমণ করে। বিশেষত, প্রথম সপ্তাহের মধ্যে বা তারপরে ভাইরাসের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই ভাইরাস সংক্রমিত ব্যক্তির দেহের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে। এই সংক্রমণের সময় বিভিন্ন লক্ষণ যেমন মাথা ও শরীরব্যথা, জ্বর, গলাব্যথা, শুকনো কাশি, গন্ধ ও স্বাদ নষ্ট হয়ে যাওয়া থাকতে পারে, আবার এ লক্ষণগুলো ওই সময়ে নাও থাকতে পারে। এটা নির্ভর করে ব্যক্তির শারীরিক অবস্থার ওপর।

আক্রমণের প্রথম লক্ষ্য শ্বাসযন্ত্র (ফুসফুস)
করোনাভাইরাসের আক্রমণের প্রাথমিক পর্যায়ে যদি মানবদেহের প্রতিরোধব্যবস্থা এই ভাইরাসের সঙ্গে লড়াই করতে অপারগ বা পরাজিত হয়, তখন ভাইরাসটি ফুসফুসের কোষগুলোয় আক্রমণ করে। তখন এটি মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে। শ্বাসযন্ত্রের গঠন ব্যবস্থায় এমন কিছু বিশেষ ধরনের ছোট ছোট বায়ুথলি থাকে যা ‘অ্যালভেওলি’ নামে পরিচিত। অ্যালভেওলি দিয়ে অক্সিজেন রক্তের মাধ্যমে শরীরের অন্যান্য অংশে সরবরাহ হয়। এই অ্যালভেওলি বা বায়ুথলির কোষগুলো এসিই-২ প্রোটিনসমৃদ্ধ। যেখানে ভাইরাল এস-প্রোটিনগুলো আবদ্ধ হয়ে কোষগুলোয় প্রবেশ করে। ভাইরাল সংক্রমণের সঙ্গে লড়াই করার জন্য, সাদা রক্তকণিকা কেমোকাইনস নামক জৈব রাসায়নিক পদার্থ নিঃসরণ করে, যা আরও বেশি রোগ প্রতিরোধক কোষকে ডেকে আনে এবং ভাইরাস-সংক্রামিত কোষকে হত্যা করে। এই প্রক্রিয়া চলাকালে অ্যালভেওলি বা বায়ুথলির মধ্যে শ্বেত রক্তকণিকা, শ্লেষ্মা, ধ্বংস হওয়া ফুসফুসের কোষের ডিট্রেটাস এবং অন্যান্য তরল জমা হয়। এ তরল শেষ পর্যন্ত মানবদেহে অক্সিজেন পরিবহনকে বিঘ্নিত করে। এই উল্লিখিত কার্যক্রম মানবদেহে কাশি, জ্বর, দ্রুত এবং অগভীর শ্বাস–প্রশ্বাস সৃষ্টি করে। সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত সাম্প্রতিক একটি প্রতিবেদন অনুসারে দেখা যায়, কোভিড-১৯ রোগীর ২০ শতাংশ তীব্র শ্বাসকষ্টজনিত সিনড্রোমে আক্রান্ত হয়েছে (এআরডিএস)।

হার্ট রক্তে সংক্রমণ
আমেরিকান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের জার্নাল কার্ডিওলজির মার্চ মাসে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে জানা গিয়েছে, চীনের উহান শহরে কোভিড-১৯–এ আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ৪১৬ জন রোগীর মধ্যে প্রায় ২০ শতাংশ রোগী হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। অন্য একটি গবেষণায় দেখা গেছে, আইসিইউতে থাকা ৩৯ জন রোগীর ৪৪ শতাংশ রোগীর মধ্যে ‘এরিথমিয়া’ ছিল। থ্রম্বোসিস রিসার্চ জার্নালের এপ্রিলে প্রকাশিত অন্য একটি গবেষণায় জানা গেছে, ডাচ্‌ আইসিইউতে কোভিড-১৯–এ আক্রান্ত ১৮৪ জন রোগীর মধ্যে ৩৮ শতাংশের রক্ত অস্বাভাবিকভাবে জমাট বাঁধা ছিল এবং প্রায় এক-তৃতীয়াংশের ইতিমধ্যে রক্ত ক্লট হয়ে ছিল। এই কেস স্টাডিগুলো পরিষ্কারভাবে ইঙ্গিত দেয় যে কোভিড-১৯ সংক্রমণের সময় রক্ত জমাট বাঁধে, তবে কীভাবে এটি ঘটে, এখন পর্যন্ত তার কোনো স্পষ্ট প্রমাণ ও প্রক্রিয়া জানা যায়নি। হৃদ্‌রোগের কারণ কী, তা বোঝার জন্য বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানীরা আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। হতে পারে ভাইরাসটি হৃৎপিণ্ড ও রক্তনালির আস্তরণকে সরাসরি আক্রমণ করতে পারে, যা নাক ও অ্যালভোলির মতো এসিই-২ রিসেপ্টরসমৃদ্ধ অথবা এটি অক্সিজেনের অভাব বা ফুসফুসের ব্যাপক ক্ষতির কারণে হতে পারে, যা শেষ পর্যন্ত রক্তনালিগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। অতি সম্প্রতি গত ১৭ এপ্রিল প্রকাশিত সায়েন্স জার্নালের একটি প্রতিবেদনে করোনাভাইরাস সংক্রমণের সময় আইএল-৬–এর মতো সাইটোকাইনগুলোর পরিমাণ বেশি দেখা গেছে, যা হার্টের ক্ষতি করার কারণ হতে পারে।

কিডনিতে সংক্রমণ
যদিও করোনাভাইরাস সংক্রমণে ফুসফুসের ক্ষয়ক্ষতি চিকিৎসক আর গবেষকদের নজর সবচেয়ে বেশি কেড়েছে, কিন্তু সম্প্রতি (২২ এপ্রিল) আমেরিকান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের জার্নালে নিউইয়র্ক অঞ্চলের কোভিড-১৯ রোগীদের ওপর পরিচালিত একটি বিশাল আকারের কেস স্টাডি প্রকাশ হয়েছে, যেখানে ৫ হাজার ৭০০ রোগীর মধ্যে ৩ দশমিক ২ শতাংশ রোগীকে কিডনি প্রতিস্থাপন থেরাপি দিয়ে চিকিৎসা করতে হয়েছিল। অন্য একটি রিপোর্টে দেখা গেছে, চীনের হুবেই ও সিচুয়ান প্রদেশের প্রায় ২০০ হাসপাতালে ভর্তি কোভিড-১৯ রোগীর মধ্যে ৫৯ শতাংশের প্রস্রাবে প্রোটিন ছিল, এবং ৪৪ শতাংশের রক্ত ছিল, যা কিডনি সংক্রমণের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত। এই পর্যবেক্ষণের সমর্থনে চীনের চংকিং মিলিটারি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত একটি প্রাথমিক পরীক্ষায় কোভিড-১৯ রোগীদের কিডনিতে ভাইরাল কণা শনাক্ত করা হয়েছে। প্রতিবেদনটি গত ১০ এপ্রিল মেডআরসিভ জার্নালে প্রকাশিত হয়। সম্মিলিতভাবে এই কেস স্টাডিজগুলো মানুষের কিডনিতে সরাসরি ভাইরাল আক্রমণের ইঙ্গিত দেয়। এ ছাড়া করোনাভাইরাস আক্রমণে বিভিন্ন ধরনের সাইটোকিনিনের প্রাচুর্য কিডনিতে রক্তপ্রবাহকে উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করতে পারে, যা প্রায়ই মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে থাকে।

 

নিউজটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © gtbnews24.com
Web Site Designed, Developed & Hosted By ALL IT BD 01722461335