শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১১:২৯ পূর্বাহ্ন

রাজন হত্যা অভিযোগের আংগুল এসি এ এইচ এম কামরুলের দিকে

জিটিবি নিউজ: আটুকেরবাজার আবাসিক এলাকার বেলালের দোকান থেকে জালালাবাদ থানার এসি এ এইচ এম কামরুল ইসলামের বাসার দূরত্ব ১০০ গজ হবে। জনতা যখন শিশু সামিউল আলম রাজনের লাশবাহী মাইক্রোবাসটি আটকায় তখন এসি কামরুল নিজ বাসাতেই ছিলেন। তখন বেলা দেড়টা হবে। ক্ষুব্ধ জনতা মুহিতকে আটক করে মারধরের চেষ্টা করছিল। শোরগোল শোনে বাসা থেকে বেরিয়ে আসেন এসি কামরুল। তিনি এসে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করেন। ফোন দেন ওসি (তদন্ত) আলমগীরকে। এসির ফোন পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে যান ওসি আলমগীরসহ পুলিশ। এরপর থেকে ঘটনার সঙ্গেই ছিলেন এসি কামরুল ইসলাম। সার্বক্ষণিক তিনি রাজন খুনের পরবর্তী ঘটনাবলি পর্যবেক্ষণ করেন। মামলা-সংক্রান্ত যাবতীয় নির্দেশনা দেন ওসিকে। কিন্তু ঘটনার পর সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার রোকন উদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে তদন্ত কমিটি যে রিপোর্ট দিয়েছে, সেটিতে এসি কামরুল ইসলামের দায়িত্বে গাফিলতির বিষয়টি উঠে আসেনি। মাঠপর্যায়ের পুলিশ সদস্যরা মনে করছেন, তদন্ত রিপোর্টে খুব কৌশলে এসি কামরুলকে রক্ষা করা হয়েছে। আর এ তদন্ত কমিটির রিপোর্ট নিয়েও পুলিশ প্রশাসনের মধ্যে তোলপাড় চলছে। লাশ উদ্ধারের পর থেকে এসি কামরুল ইসলাম জালালাবাদ থানাতেই ছিলেন। দায়িত্বপ্রাপ্ত ওসি আক্তার হোসেন যেহেতু ছুটিতে ছিলেন, এ কারণে সার্বিক বিষয়টি দেখভালের দায়িত্ব ছিল তার ওপর। তিনি দায়িত্ব পালনও করেছেন। কিন্তু সব দোষ গিয়ে চাপলো অধীনস্ত তিন পুলিশ কর্মকর্তার ওপর। বিকাল ৪টায় থানায় যান ডিসি ও এডিসি। তারা পুরো ঘটনাটি শুনেন। এ সময় তারা গ্রেপ্তারকৃত মুহিত আলমকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করেন এবং কী করতে হবে সে ব্যাপারেও দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন ওসিকে। আর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নির্দেশনা পেয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন ওসি। ডিসি, এডিসির নির্দেশনার পর এসি কামরুল ইসলাম ও ওসি আলমগীর হোসেন রাজনের মরদেহ পোস্টমর্টেমের জন্য হাসপাতালে পাঠান। সঙ্গে যান এসআই আমিনুল। আর রাত সাড়ে ৮টায় এসআই আমিনুল এজাহার নিয়ে যান ওসি আলমগীরের কাছে। এ সময় ওসি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে এসি কামরুলের মতামত চান। এসি কামরুল মামলা রেকর্ড করতে বলেন। তার নির্দেশেই ওসি আলমগীর নিহত রাজনকে ‘অজ্ঞাত পুরুষ’ দেখিয়ে মামলা নেন। অথচ পুরো ঘটনা কৌশলে পাশ কাটিয়ে গেছেন জালালাবাদ থানার সহকারী পুলিশ কমিশনার এ এইচ এম কামরুল ইসলাম। অভিযোগের ধারে-কাছেও নেই তিনি। এর পরের ঘটনা আরও বিচিত্র। গতকাল মানবজমিন-এর পক্ষ থেকে নিহত রাজনের পিতা আজিজুর রহমানকে ফোন করা হয়। প্রশ্ন করা হলো- পুলিশের তদন্ত রিপোর্টে তিনি খুশি কি-না। জবাবে আজিজুর রহমান বলেন, ‘তিনজনের মধ্যে দুজনের শাস্তিতে আমি খুশি। কিন্তু ওসি আলমগীরের কোন দোষ নেই। ঘটনার প্রথম থেকেই তিনি আমাকে সহযোগিতা করছেন। রাতে যখন কেঁদে কেঁদে এজাহার নিয়ে থানায় যাই তখন ওসি আলমগীর আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। বলেন, ভাই কেউ লাশটির পরিচয় দিতে পারেনি। এ কারণে আমরা মামলা রেকর্ড করেছি। আপনি এজাহার দেন। আমরা আপনার এজাহারও নেবো।’ এবং পরে ওসি আলমগীর এজাহার নেন বলে জানান তিনি। তবে এসি কামরুল ইসলাম সম্পর্কে গতকালও মানবজমিন-এর কাছে অভিযোগ করেন শিশু সামিউল আলম রাজনের বাবা আজিজুর রহমান। বলেন, ‘মধ্যরাতে আমি এজাহার নিয়ে যখন থানায় যাই তখন প্রথম দেখা হয় এসআই আমিনুলের সঙ্গে। আমিনুল আমাকে পাত্তা দিচ্ছিল না। একপর্যায়ে বললো স্যারের কাছে যান। আমি তার কথামতো এসি কামরুলের কাছে যাই। ওই সময় এসি আমাকে ধমক দেন। বলেন, চুরের বাপ এসেছেন। ওই মামলা হয়ে গেছে। আর মামলা হবে না। আপনি চলে যান।’ আজিজুর রহমান বলেন, ‘এসি কামরুলের এ আচরণে আমি কেঁদে ফেলি। আজিজুর রহমান বলেন, ‘থানার চত্বরে যখন বের হই তখন অবস্থান করছিল রাজনের খুনি কামরুল। সঙ্গে ছিল আলী হায়দার। এ সময় গিয়াস মেম্বার, আল মদিনার রুবেল, পাবেলসহ কয়েকজন থানা চত্বরে ছিল। তারা আমাকে দেখে ধমক দেয়। বলে, থানা থেকে চলে যেতে। আমি যাই নি। বসে থাকি। একপর্যায়ে দেখি থানার কোনায় অন্ধকার স্থানে খুনিদের সঙ্গে এসআই আমিনুল বৈঠক করছেন। বেশ কিছুক্ষণ তারা কথাবার্তা বলেন। একপর্যায়ে এসআই আমিনুল ঘাতক কামরুল ও আলী হায়দারকে বলে ওঠেন, ‘৬ পেলাম। আরও ৩ কই। স্যারকে কীভাবে ম্যানেজ করবো। এ সময় আলী বলে, পাবেন, রাতটা সময় দেন।’
কী ঘটেছিল সেদিন: শিশু সামিউল আলম খুনের ঘটনার দিন সিলেটের জালালাবাদ থানায় শিশুর লাশ নিয়ে পুলিশের কর্তব্য অবহেলার বিষয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলেন স্থানীয় লোকজন। এ কারণে ঘটনার দুই দিন পর শুক্রবার এলাকার লোকজন থানা ঘেরাও করেন। তারা থানার সামনেই বিক্ষোভ করেন। আর দোষী পুলিশ কর্মকর্তাদের বিচার দাবি করেন। তখনও রাজন খুনের আলোচিত ভিডিওটি প্রকাশ পায়নি। ঘটনাটিও ছিল অনেকটা আড়ালে। মিডিয়ার নজরও পড়েনি। এলাকার লোকজন জানিয়েছেন, পুলিশ রাজন খুনের ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে আপ্রাণ চেষ্টা চালায়। এদিকে, পুলিশের কয়েকজন কর্মকর্তা, রাজনের পরিবার ও ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে বিস্তারিত। রাজনের লাশ জনতা আটক করার পরপরই এসি কামরুল যান সেখানে। তিনি গিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করেন। এরপর লাশ নিয়ে আসা হয় থানায়। তখন বিকাল ৩টা হবে। আটক মুহিত আলম রাজনের পরিচয় জানাতে পারে নি। বারবার পুলিশ তাকে জেরা করে। কিন্তু মুহিত রাজনের পরিচয় জানায়। বিকাল ৪টায় থানায় যান পুলিশের ডিসি ও এডিসি। তারা গিয়েও মুহিতকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। কিন্তু মুহিত রাজনের পরিচয় গোপন রাখে। এ সময় ডিসি, এডিসি ও এসির সিদ্ধান্তমতো লাশ মর্গে পাঠানো হয়। বিকাল হয়ে যাওয়ায় ডাক্তার ওই দিন ময়নাতদন্ত করেননি। ইফতারে চলে যান। ফলে লাশ হাসপাতালে রেখে থানায় চলে যান এসআই আমিনুল। এ সময় এসআই জাকির ও এসআই আমিনুলের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করে আসামিপক্ষ। থানায় বসা ছিলেন এসি কামরুল। তিনিই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে এ নিয়ে যোগাযোগ রাখেন। কী হচ্ছে, আর কী করা উচিত এসব বিষয়ে মতামত নেন। ওদিকে, মুহিতকে মামলা থেকে রেহাই করতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করে প্রবাসী কামরুল, আলীসহ অন্যরা। রাত সাড়ে ৮টায় এসআই আমিনুল এজাহার নিয়ে যান ওসি আলমগীরের রুমে। মামলায় আসামি কেবল আটক মুহিত ও পলাতক ময়না মিয়া। এসির নির্দেশে ওসি আলমগীর মামলা রেকর্ড করেন। ওদিকে, রাত সাড়ে ১১টায় থানায় ছুটে যান রাজনের পিতা আজিজুর রহমান। তিনি রাজনের ছবি দেখেন। রাজনকে চিহ্নিত করেন। এরপর তিনি কাঁদতে শুরু করেন। সাড়ে ১২টায় তিনি থানায় যান। এসি কামরুলের কক্ষে গেলে তাকে বলা হয়, ‘মামলা হয়ে গেছে। আর মামলা হবে না।’ এ সময় আজিজুর রহমান বলেন, ‘ছেলে তো আমার, মামলা পুলিশ করবে কেন।’ এসব নিয়ে আজিজুর রহমান তর্ক জুড়ে দিলে এসআই আমিনুল তাকে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দেন। এরপর থানার ভেতরেই কামরুল, আলী, পাবেল, রুবেল ও দুই মেম্বারকে নিয়ে বৈঠক করেন। রাজনের পিতা জানিয়েছেন, এসি কামরুল ও এসআই আমিনুল এবং জাকির হোসেন আমার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছেন। গতকাল প্রত্যাহার হওয়া ওসি আলমগীর হোসেন মানবজমিনকে জানিয়েছেন, তিনি রাজনের পিতার অভিযোগ নিয়েছেন। এরপর শুক্রবার ওই অভিযোগটি তিনি আদালতে পাঠান।’ তিনি বলেন, ‘রাজনের পিতার অভিযোগ আগের এজাহারের সঙ্গে যুক্ত করার আবেদনও আদালতে জানান।’ এর বাইরে আলমগীর কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি।

নিউজটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © gtbnews24.com
Web Site Designed, Developed & Hosted By ALL IT BD 01722461335