শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ০৩:৫৯ পূর্বাহ্ন
বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের শরিক দলগুলোর মধ্যে চলছে নানা লাভ-ক্ষতির হিসাব। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শোচনীয় পরাজয়ের গ্লানি সহ্য করে তারা এখন এ হিসাব কষতে ব্যস্ত। বর্তমানে জোটের শরিক দলগুলোর সার্বিক কার্যক্রমে এমন চিত্রই ফুটে উঠেছে।
চলতি মাসের ৬ তারিখে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জোটত্যাগের ঘোষণা দেয় বিএনপির দুই দশকের সঙ্গী বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি)। এর পরের দিন অর্থাৎ ৭ মে জোটের আরেক শরিক বাংলাদেশ লেবার পার্টির একাংশের চেয়ারম্যান ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান বিএনপিকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ত্যাগের আল্টিমেটাম দেন।
অবশ্য বিজেপির পার্থও জোটত্যাগের কারণ হিসেবে বিএনপির ঐক্যফ্রন্টপ্রীতির পাশপাশি বিএনপির নির্বাচিতদের সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ গ্রহণের সিদ্ধান্ত এককভাবে নেয়ার বিষয়টি উল্লেখ করেন।
ভোটের বাজারে বিজেপি বা লেবার পার্টির ঠাঁই না থাকলেও যুক্তিবাদী ও সুবক্তা হিসেবে বিজেপি চেয়ারম্যান আন্দালিভ রহমান পার্থ দেশব্যাপী বেশ সুপরিচিত।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন উঠেছে, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ক্ষমতাসীনদের বলয় থেকে বিপক্ষ শক্তিকে দুর্বল করার জন্য জোট ভাঙার চাপ থাকে। বিভিন্ন সময় কেউ কেউ সেই চাপে নতি স্বীকারে বাধ্য হন। কিন্তু সেই অর্থে সরকারের পক্ষ থেকে বিএনপি জোট ভাঙার জন্য চাপ থাকার কথা নয়, তাহলে এখন কেন বিজেপি ২০ দলীয় জোট ত্যাগ করলো? আবার লেবার পার্টির একাংশ হঠাৎ কেনই-বা তাদের প্রধান শরিক বিএনপিকে আল্টিমেটাম দিলো?
বিজেপির বিএনপিজোট ত্যাগ নিয়ে রাজনৈতিক মহলে নানা গুঞ্জন ডানা মেলেছে। অনেকে বলছেন, যেহেতু বিজেপির চেয়ারম্যান আন্দালিভ রহমান পার্থ একদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চাচাতো ভাইয়ের মেয়েজামাই। অন্যদিকে শেখ হাসিনার ফুফাতো ভাই আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিমের ভাগ্নে। তাই আওয়ামীবিরোধী রাজনীতিতে থাকার কারণে আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন ঘোচাতে পার্থ জোটত্যাগ করেছেন। এখন ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাবেন- এটাই স্বাভাবিক।
কিন্তু পার্থ বিএনপিজোট ত্যাগ করলেও আওয়ামী লীগের সঙ্গে এখন পর্যন্ত প্রকাশ্যে কোনো জোট গড়েননি। এ পরিস্থিতিতে বলা হচ্ছে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ২০ দলীয় জোটের প্রধান শরিক বিএনপির ভবিষ্যৎ অন্ধকার দেখছেন পার্থের নেতৃত্বাধীন বিজেপি। এছাড়া বিএনপিপ্রধান বেগম খালেদা জিয়া কারাগারে, দ্বিতীয় প্রধান তারেক রহমান দেশের বাইরে। এ পরিস্থিতিতে নিজের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের শঙ্কা থেকেই পার্থের জোটত্যাগ। এখন আওয়ামী লীগে যোগ না দিলেও আওয়ামীবিরোধী শক্তির সঙ্গে সম্পর্ক না থাকলে অহেতুক হয়রানিমূলক মামলা থেকে নিস্তার পাবেন পার্থ। তার ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারেও সরকারি মহল থেকে কোনো বাধা আসবে না। আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গেও সম্পর্কের উন্নতি হবে।
আবার রাজনীতিতে নতুন কোনো মেরুকরণ হলে পার্থ নিতে পারেন কোনো মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বও। এমনও হতে পারে, খালেদা জিয়া কারামুক্ত হলে তিনি আবারও জোটে ফিরে আসবেন। সবমিলিয়ে ষোল আনা লাভের গুড়ের আশায় কৌশলগত অবস্থানে রয়েছেন পার্থ।
এদিকে লেবার পার্টির একাংশের চেয়ারম্যান ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান ঐক্যফ্রন্ট ত্যাগের জন্য বিএনপিকে যে আল্টিমেটাম দিয়েছেন তা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে হাস্যরস তৈরি হয়েছে।
পার্থের জোটত্যাগের ঘোষণা এবং ইরানের আল্টিমেটামের পরিপ্রেক্ষিতে দীর্ঘদিন পর গত ১৩ মে ২০ দলীয় জোটের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে ইরান আল্টিমেটামের কথা অস্বীকার করেন। বৈঠকের পর জোটের সমন্বয়কারী বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বিষয়টির ওপর দৃষ্টিপাত করে বলেন, ‘এটা হয়তো তিনি (ইরান) মিডিয়াকাভারেজের জন্য বলেছেন।’
গত ১৭ মে লেবার পার্টির ছাত্র সংগঠন ছাত্র মিশনের ইফতার মাহফিলে প্রধান অতিথি হিসেবে অংশ নেন নজরুল ইসলাম খান। যে জোটত্যাগের ঘোষণা দিয়েছিলেন (পরবর্তীতে অস্বীকার করা) সেই জোটের সমন্বয়কারীকে প্রধান অতিথি করা! এ বিষয়ে ইরানের ঘনিষ্ঠ এক সূত্র জাগো নিউজকে জানান, লেবার পার্টির আল্টিমেটাম ২৩ তারিখ পর্যন্ত রয়েছে। ২৪ তারিখে দেখতে পাবেন।
সূত্র মতে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার কারাবাস এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের লন্ডন নির্বাসনের কারণে বিএনপি ও জোটের মধ্যে নেতৃত্বের অভাব দেখা দিয়েছে। এ সুযোগে যে অস্থির পরিবেশ তৈরি হয়েছে সেটি কাজে লাগাতে লেবার পার্টির ইরান অংশের পক্ষ থেকে বিএনপিকে আল্টিমেটাম দেয়া হয়েছে। যেহেতু রাজনৈতিক দল হিসেবে লেবার পার্টির নিবন্ধন নেই। সম্প্রতি কয়েকটি দল আদালতের আদেশে নিবন্ধন পেয়েছেন। ইরানও তার দলের নিবন্ধনের জন্য উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হয়েছেন। নিবন্ধন পেতে সরকারের সহায়তা আদায়ে ইরান বিএনপিবিরোধী মনোভাব প্রকাশ করেছেন। যাতে লেবার পার্টির নিবন্ধন পেতে সরকারের দিক থেকে কোনো বাধার সম্মুখীন হতে না হয়। পাশপাশি বিএনপিবিরোধিতার কারণে ক্ষমতাসীন বলয় থেকে নানাবিধ সুবিধা পাওয়ার সম্ভাবনা যেমন থাকে, তেমনি হয়রানিমুক্তও থাকা যায়।
অন্যদিকে ইরান বিএনপিকে আল্টিমেটাম দেয়ায় জোট থেকে লেবার পার্টিকে বহিষ্কারের দাবি ওঠে। কিন্তু বিএনপির স্থায়ী কমিটির নেতারা ইরানের নেতৃত্বাধীন লেবার পার্টিকে তাদের স্বার্থে বহিষ্কার করতে নারাজ। কারণ জোট থেকে লেবার পার্টির মতো ভোটশূন্য দলগুলোকে বহিষ্কার করলে অবশিষ্ট দলগুলো জোটে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করবে। কারণ ওই দলগুলোর নেতৃত্বে যারা আছেন তারা অনেকাংশে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যদের চেয়েও বেশি প্রজ্ঞাবান। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম (বীর প্রতীক) জোট সমন্বয়কারী বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খানের নেতৃত্বের ওপর হতাশা প্রকাশ করেছেন। জোটের প্রধান সমন্বয়কারী হিসেবে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি- এলডিপির চেয়ারম্যান কর্নেল (অব.) অলি আহমদের নাম প্রস্তাব করেছেন। অলিও বিএনপিকে এলডিপির নেতৃত্ব গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন। সঙ্গত কারণে, বিএনপির স্থায়ী কমিটির নেতারা চান না ২০ দলীয় জোট কার্যকর হোক। কারণ এ জোট কার্যকর হলে জাতীয় সিদ্ধান্তগুলো জোটগতভাবে নিতে হবে। সেক্ষেত্রে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যদের কদর অনেকটা কমে যাবে।
সার্বিক এ পরিস্থিতি নিয়ে জোটের শরিক জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি’র (জাগপা) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার তাসমিয়া প্রধান জাগো নিউজকে বলেন, ‘দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া কারগারে, তারেক রহমান দেশের বাইরে- এমন পরিস্থিতিতে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দক্ষতার সঙ্গে নেতৃত্ব দিতে পারছেন না। তার স্থলে অন্য কাউকে বসানো দরকার।’
তিনি অভিযোগ করেন, ‘মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কারণে বিএনপি এবং ২০ দলীয় জোট ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।’
ফখরুলকে নিয়ে তাসমিয়ার এমন বক্তব্যের বিষয়ে জোটের এক শীর্ষনেতা নাম প্রকাশ না করে বলেন, ‘ব্যারিস্টার তাসমিয়া প্রধান একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন না পেয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সম্পর্কে এমন মন্তব্য করেছেন। কদিন হলো তাসমিয়া রাজনীতিতে এসেছেন? পরিবারতন্ত্রের কারণে তিনি জাগপার শীর্ষ নেতৃত্বে জায়গা পেয়েছেন। রাজনীতি দৈনিক পত্রিকা নয় যে, আজকের ঘটনা কালকে সংবাদ হিসেবে ছাপা হবে। এটা দীর্ঘ প্রক্রিয়ার বিষয়। প্রয়াত শফিউল আলম প্রধান বর্ষীয়ান রাজনীতিক। তার কন্যা রাজনীতিতে আরও পক্ক হোক- এটাই আমাদের প্রত্যাশা।’
বিজেপি আর লেবার পার্টি প্রসঙ্গে বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বলেন, ‘সময়টা অস্থিতিশীল। বিভিন্ন রকমের চিন্তা, দুঃশ্চিন্তা, উদ্বেগ আসবে। এসব বিবেচনা করে ওনারা ওনাদের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, এখানে আমাদের কোনো মন্তব্য নাই।’
এদিকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ মুহূর্তে চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। বিদেশ যাওয়ার আগে তিনি বিজেপির জোটত্যাগ এবং লেবার পার্টির আল্টিমেটামকে ‘তাদের হতাশা’ বলে মন্তব্য করেন।
ফখরুল বলেন, ‘একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের নামে সরকার যে নিষ্ঠুর প্রহসন করেছেন জনগণের সঙ্গে, তাতে জনগণের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়েছে। তাদের মধ্যেও হতাশা সৃষ্টি হয়েছে।’