বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ০৭:১২ পূর্বাহ্ন

জলে ভাসে ডাঙায় চলে

শেখ আনোয়ার : এমন যদি হতো, আমাদের বাসা-বাড়িটা ঘাড়ে করে সব জায়গায় বয়ে নিয়ে বেড়াতে পারতাম! তাহলে ভারী মজাই হতো। সারাদিনের পরিশ্রমে ক্লান্ত শরীর নিয়ে দিনের শেষে পথের জ্যামে, ভিড়ে কষ্ট করে ঘরে ফেরার আর দরকার হতো না। আত্মরক্ষার দরকার হলে টুক্ করে ঢুকে পড়া যেত ঘরে।

আমরা এমনটা না পারলেও কচ্ছপ কিন্তু ঠিকই পারে। ওদের পিঠে ও পেটে আছে শক্ত খোলস। এই খোলসই হলো তাদের বাসা-বাড়ি। কচ্ছপ প্রয়োজনে তার মাথা, লেজ ও পা খোলসের ভেতরে ঢুকিয়ে নেয়। আবার দরকার মতো বের করে। বিজ্ঞানীরা বলেন, কচ্ছপরা আসলে সাপ জাতীয় প্রাণীদের মধ্যে বেঁচে থাকা প্রাচীনতম জীব। একশ ষাট কোটি বছর ধরে ওরা পৃথিবীর ঘটনাবলির সাক্ষী। বাংলায় কচ্ছপ বলা হয় যাকে, ইংরেজিতে তার নাম টরটয়েজ। টার্টলও বলা হয়। তবে ডাঙায় বসবাসকারী কচ্ছপরা হলো টরটয়েজ। আর পানিতে বসবাসকারী কচ্ছপরা হলো টার্টল। কেবল বিশেষ প্রয়োজনে টরটয়েজরা যেমন পানিতে নামে। টার্টলরা ঠিক তেমনি ওঠে ডাঙায়।

বাসস্থানের ওপর ভিত্তি করে টার্টল অর্থাৎ পানিতে বসবাসকারী কচ্ছপরা দু’রকম। সাগরের টার্টল ও মিষ্টি পানির টার্টল। সাগরের টার্টলদের সাতটি প্রজাতির মধ্যে পাঁচটি প্রজাতিরই দেখা মেলে বঙ্গোপসাগর উপকূলে। সাগরের টার্টলদের পাগুলো প্যাডেলের মতো হওয়ায় পানিতে সহজে সাঁতার কাটতে পারে। সাঁতারের সময় এ পা দুটোই ওরা বেশি ব্যবহার করে। পেছনের পা দুটো দিক পরিবর্তনে সাহায্য করে। মিষ্টি পানির টার্টল ও স্থলবাসী কচ্ছপদের মতো কিন্তু ওরা মাথা, লেজ ও পা খোলসের ভেতর ঢুকিয়ে নিতে পারে না। ওরা সবজি, শৈবাল থেকে শুরু করে সবকিছুই খায়।

বাংলাদেশ, ভারত তথা এশিয়া উপমহাদেশের সাগরের পাঁচটি কচ্ছপ প্রজাতির মধ্যে অন্যতম হলো অলিভ রিডলে কচ্ছপ। এদের বঙ্গোপসাগরের হাতিয়া, সন্দ্বীপ ও আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের সাগর উপকূলে যথেষ্ট পরিমাণে দেখা মেলে। বঙ্গোপসাগর ছাড়া প্রশান্ত ও আটলান্টিক মহাসাগরেও অলিভ রিডলে কচ্ছপ পাওয়া যায়। অলিভ রিডলে কচ্ছপকে সাগর তীরবর্তী আদিবাসীরা ‘গাধা কাছুয়া’ বলে থাকেন। এ কচ্ছপের পিঠের খোলস বেশ চওড়া। হৃৎপিণ্ডও লম্বায় প্রায় এক মিটার। পরিণত অলিভ রিডলে কচ্ছপের খোলসের রং জলপাই-সবুজ। আর নিচের খোলসের রং হালকা হলুদ। তবে এ কচ্ছপের বাচ্চাদের খোলসের রং ধূসর। এরা সবকিছুই খেতে অভ্যস্ত। মাছ, কাঁকড়া, চিংড়ি, জেলিফিশ, তারা মাছে যেমন এদের অরুচি নেই, তেমনি শামুক, ঝিনুক, সমুদ্র সজারু পেলে এদের বেশ জমে ভোজ।

মেয়ে অলিভ রিডলে কচ্ছপ দশ থেকে বারো বছর বয়স হলেই ডিম পাড়ার উপযুক্ত হয়। ডিম পাড়ার সময় স্ত্রী কচ্ছপ উপকূলের স্থলভাগে চলে আসে। বেশিরভাগই সাগরপাড়ের ম্যানগ্রোভ অরণ্য এলাকার কাছাকাছি উঠে আসে। পুরুষ কচ্ছপ কখনোই স্থলভাগে আসে না। লোকগাথা আছে, যে স্থানে ডিম ফুটে জন্ম হয়, পূর্ণবয়স্ক মেয়ে কচ্ছপ ডিম পাড়ার সময় হলে নাকি ঠিক সেই স্থানেই ডিম পাড়তে আসে। বিজ্ঞানীদের গবেষণায়ও এ লোকগাথা প্রমাণ হয়েছে। তারা দেখেছেন, মেয়ে কচ্ছপের কোষের নিউক্লিয়াসে যে ডিএনএ থাকে তার অর্ধেক আসে তার বাবা ও অর্ধেক আসে তার মার কাছ থেকে। কিন্তু তার মাইটোকনড্রিয়াতে যে ডিএনএ থাকে, তা কিন্তু কেবল মা-কচ্ছপের কাছ থেকেই আসে। একই স্থানে বছরের পর বছর যেসব কচ্ছপ ডিম পাড়তে আসে, তাদের সবার ডিএনএ হুবহু একই রকম। মেয়ে কচ্ছপরা প্রতি বছর কয়েক হাজার কিলোমিটার সাগর পথ পাড়ি দিয়ে ডিম পাড়তে আসে। একটা মেয়ে কচ্ছপ পয়ষট্টি-সত্তর বছর বেঁচে থাকে। এসময়ে ত্রিশ-চল্লিশ বার ডিম পাড়তে আসে। প্রতিবারে প্রায় একশটি ডিম পাড়ে। অর্থাৎ একটি মেয়ে কচ্ছপ তার গোটা জীবনে ৩ হাজার থেকে ৪ হাজার ডিম পাড়ে। যদিও ডিম ফুটে বেরোনো বাচ্চাদের মাত্র এক শতাংশ, অর্থাৎ মাত্র ত্রিশ থেকে চল্লিশটি পরিণত বয়স পর্যন্ত বাঁচে।

আগেই বলা হয়েছে, মেয়ে কচ্ছপরা সাধারণত একই এলাকায় সবাই ডিম পাড়ে। তবে যেখানে-সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ডিম পাড়ে না ওরা। ডিম পাড়ার সময় হাজারে হাজারে দলবেঁধে আসে এবং দলবেঁধে ডিম পেড়ে তারপর আবার ফিরে যায়। বিজ্ঞানীদের ধারণা, এ দলবদ্ধতা তাদের জীবনরক্ষায় সহায়ক। মেয়ে কচ্ছপ, তাদের ডিম বা বাচ্চা কচ্ছপ একই স্থানে প্রচুর সংখ্যায় থাকে। শিকারী প্রাণীরা তাদের ইচ্ছেমতো শিকার করার পরেও যথেষ্ট সংখ্যক বেঁচে থাকার সম্ভাবনা থাকে।

পৃথিবীর চারটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান হলো অলিভ রিডলে কচ্ছপের ডিম পাড়ার স্থান। কোস্টারিকার প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূল এলাকায় দুটো। মেক্সিকো উপকূলে একটি এবং ভারতের উড়িষ্যা রাজ্যে একটি আর বঙ্গোপসাগরের উপকূলে গাহিরমাথা নামক বেলাভূমিতে একটি। ভারতের উড়িষ্যা উপকূলে প্রতি বছর পাঁচ লাখের বেশি মেয়ে অলিভ রিডলে কচ্ছপ ডিম পাড়তে আসে। এ অঞ্চল অলিভ রিডলে কচ্ছপদের এই পৃথিবীর বৃহত্তম প্রজননক্ষেত্র। ষাট থেকে সত্তর কেজি ওজনের এক-একটা মেয়ে কচ্ছপ সাগর পানির সর্বোচ্চ তরঙ্গরেখা থেকে প্রায় পঁচিশ মিটার ডাঙায় উঠে আসে। তারপর পা দিয়ে বালি খুঁড়ে নিজের মাপ মতো একটা গর্ত করে সেখানে নিজেকে ঢুকিয়ে নেয়। এ অবস্থায় কচ্ছপের কেবল পিঠের অংশটুকুই দেখা যায়। এ গর্তে মেয়ে কচ্ছপটি প্রায় একশ থেকে দেড়শটি ডিম পাড়ে। ডিম পাড়েও বেশ দ্রুত। প্রতি ঘণ্টায় প্রায় নব্বইটি ডিম পাড়ে। ডিম পাড়া শেষ হলে মেয়ে কচ্ছপটি পা দিয়ে বালি টেনে গর্তের মধ্যে থাকা ডিমগুলো ঢাকা দেয়। ডিম পাড়ার চুয়ান্ন থেকে ছাপ্পান্ন দিন পরে ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়। যদিও বালি ফুঁড়ে বাইরে বেরিয়ে আসতে তাদের আরও চার থেকে ছয় দিন সময় লাগে। তবে অলিভ রিডলে কচ্ছপের বাচ্চা সাধারণত বেরোয় রাতের বেলায়। একই সময়ে ডিম ফুটে বেরোনোর কারণে হাজার হাজার বাচ্চা অলিভ রিডলে কচ্ছপ রাতের আঁধারে চাঁদের আলোয় চকচক করা সাগরের পানির দিকে আকৃষ্ট হয়ে সেদিকে দৌড়ে যায়। সে দৃশ্য বড়ই নয়নাভিরাম। সাগরের পানিতে নেমে ওরা কোথায় যে গায়েব হয়ে যায়, তা কেউ জানে না। হঠাৎ আবার দেখা মেলে দশ-বারো বছর পর। যখন ডিম পাড়ার সময় হয় তখন। গবেষকদের ধারণা, বাচ্চারা সম্ভবত সাগরের নিচে একরকম ক্ষুদ্র বাচ্চা জেলিফিস, সমুদ্রের অগভীর জলের মধ্যে থাকা অমেরুদণ্ডী জীবন্ত প্রাণী ‘সমুদ্র সজারু’ ইত্যাদি খেয়ে বেঁচে থাকে। বড় হলে ওরা প্রবাল প্রাচীরের খাঁজে বা সাগরের পর্বতের গুহায় বাসা বাঁধে।

সমস্যা হলো, অলিভ রিডলে কচ্ছপ বর্তমানে বিলীন হতে চলেছে। নানা কারণে এদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। চিলি, মেক্সিকো, কোস্টারিকা, আমেরিকা প্রভৃতি দেশে জেলেদের সাগরে মাছ ধরার জন্য পেতে রাখা জালে কচ্ছপ না আটকানোর যন্ত্র ‘টেডগ্রিজি’ লাগানো বাধ্যতামূলক। জালের সঙ্গে এটি লাগানো থাকলে জালে কেবল মাছ ধরা পড়ে, কচ্ছপ নয়। টেডগ্রিজির প্রতিরোধক, আটকে পড়া কচ্ছপকে ঠেলে জাল থেকে অন্য পথে বেরিয়ে যেতে সাহায্য করে। আমেরিকা ও মেক্সিকোর যেসব জেলের টেডগ্রিজি লাগানো জাল আছে, কেবল তাদেরই সরকার থেকে মাছ ধরার অনুমতি কার্ড দেওয়া হয়। এ কার্ড দেখিয়ে তবেই তারা তাদের মাছ ধরতে ও বিক্রি করতে পারে। কিন্তু এ উপমহাদেশে আজও জেলেদের জালে এ যন্ত্রের ব্যবহার শুরু হয়নি।

পর্যটন শিল্পের প্রসারে আজকাল বাংলাদেশ ও প্রতিবেশী ভারতের সাগর উপকূলের একেবারে সর্বোচ্চ তরঙ্গরেখা ঘেঁষে কচ্ছপের প্রজনন স্থলের কাছাকাছি গঁজিয়ে উঠেছে অসংখ্য হোটেল, রিসোর্ট ও বাড়ি। তাতে অলিভ রিডলে কচ্ছপরা তাদের প্রজননক্ষেত্র হারাচ্ছে। রাতে রাস্তা বা বাড়ির উজ্জ্বল আলোয় আকৃষ্ট হয়ে সাগরে না গিয়ে বহু বাচ্চা কচ্ছপ ডাঙার দিকে গিয়ে বেঘোরে প্রাণ হারাচ্ছে। কুকুর, শিয়াল, চিল, বাজ, কাক প্রভৃতি প্রাণীর শিকার হয়ে বহু ডিম ও বাচ্চা কচ্ছপ নিঃশেষ হচ্ছে। কচ্ছপদের সবচেয়ে বড় শত্রু নিশ্চয়ই মানুষ। সাগরে ব্যাপক তেল-দূষণের জন্য বহু অলিভ রিডলে কচ্ছপ দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলছে। ফলে ওরা ডাঙায় সহজেই শিকারীর শিকারে পরিণত হচ্ছে। অন্যদিকে পর্যটক ও চোরা শিকারীদের আনাগোনায় এদের নির্জনতা আর থাকছে না। ফলে ডিম না পেড়েই বহু কচ্ছপ সাগরে ফিরে যাচ্ছে। সাগর উপকূলে ব্যাপক অরণ্য-ধ্বংসও এ কচ্ছপদের প্রজননক্ষেত্র কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ।

রূপে মনোহর ও স্বভাবে বিস্ময়কর সাগরের কচ্ছপের প্রজাতি অলিভ রিডলে কচ্ছপ। প্রতিবছর কয়েক হাজার কিলোমিটার সাগরপথ পাড়ি দিয়ে পৃথিবীর মাত্র চারটি উপকূল এলাকায় ওরা ডিম পাড়তে আসে। কিন্তু মানুষ লোভ আর অবিবেচকের মতো শিকার করায়, একশ ষাট কোটি বছরের প্রাচীন শান্ত-নিরীহ প্রজাতিটি বর্তমানে বিলুপ্তপ্রায়। মানুষের চাহিদার সাপেক্ষে ওদের চাহিদা তো নগণ্য। বছরে দুটো মাসের জন্য প্রয়োজন সাগরের কাছে একটা নির্জন স্থান আর দূষণমুক্ত উপকূল। কিন্তু তা-ও আমরা মানুষরা দিতে অপারগ। বর্তমানে টিকে থাকা প্রজনন ক্ষেত্রগুলোকে যদি এখনই গুরুত্ব সহকারে সংরক্ষণ না করা হয়, তবে এ শতকেই পৃথিবীর বুক থেকে চিরতরে হারিয়ে যাবে অলিভ রিডলে কচ্ছপের প্রজাতি। এজন্য ওরা আমাদের ক্ষমা করলেও প্রকৃতি কখনো আমাদের ক্ষমা করবে না।

 

নিউজটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © gtbnews24.com
Web Site Designed, Developed & Hosted By ALL IT BD 01722461335