বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ০৬:১১ পূর্বাহ্ন

বিএনপির সামনে সুদিন দেখা যাচ্ছে না

মোনায়েম সরকার , রাজনীতিবিদ ও কলামিস্ট
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন দেখতে দেখতে চলে আসছে। সাত-আট মাস খুব বেশি সময় নয়। এরমধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনকেন্দ্রিক প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। কারও প্রস্তুতি ঢাকঢোল পিটিয়ে, কেউ বা তৈরি হচ্ছে নীরবে-নিভৃতে। তবে নির্বাচন করতে চায়, এরকম কোনো দলই হাত-পা গুটিয়ে বসে নেই। দেশে রাজনৈতিক দল অনেক থাকলেও সব দল ভোটে অংশ নেয় না, আবার অংশ নিলেও সব দলের প্রার্থীই নির্বাচিত হতে পারেন না।

হাতেগোনা কয়েকটি দলেরই সংসদে প্রতিনিধিত্ব আছে। ভোটের বিচারে দেশে বড় দল দুটি- আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। এর বাইরে জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামীর কিছু উল্লেখযোগ্য ভোট আছে। ইসলামী আন্দোলনও ভোটের রাজনীতিতে নতুনভাবে জায়গা করে নিচ্ছে। তাছাড়া অন্য সব ছোট দল ভোটের সময় আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটে শামিল না হলে খাতা খুলতে পারে না।

কয়েক মাস আগে বিভাগীয় গণসমাবেশে শত বাধা উপেক্ষা করে নেতাকর্মীদের উপস্থিতি চোখে পড়লেও ১০ ডিসেম্বরের পর পরিস্থিতি আবার নেতিয়ে পড়েছে। দলের ভেতরের একটি অংশ মনে করে তাদের নেতারা ১৪ বছর ধরে বলে আসছেন রোজার পর, না হয় ঈদের পর সরকারবিরোধী জোরদার আন্দোলন হবে। দল ঘুরে দাঁড়বে। সংবাদ মাধ্যমেও ঘুরেফিরে এসব বিষয় এসেছে। কিন্তু বাস্তবে সেই ঘুরে দাঁড়ানো আর হয়নি। তাই এটা বলা যায় যে, আন্দোলনের অলীক কল্পনা ছেড়ে বিএনপি নির্বাচনের সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিলেই সব বিবেচনায় বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত হবে।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক মেরুকরণ কেমন হবে তা এখনো স্পষ্ট নয়। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি- উভয় পক্ষই নিজ নিজ মিত্র সংখ্যা বাড়ানোর দিকে যে মনোযোগ দিয়েছে, তা স্পষ্ট। আওয়ামী লীগ আরও এক মেয়াদ ক্ষমতায় থাকার আশা নিয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছে। বিএনপিও ক্ষমতায়ই যেতে চায় কিন্তু তাদের প্রস্তুতিটা ভিন্ন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচনে না জিতে ক্ষমতায় যাওয়ার উপায় নেই। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য বিএনপি উদগ্রীব হলেও নির্বাচনে রয়েছে এই দলটির অনীহা। তাই তাদের আশু লক্ষ্য সরকারের পতন ঘটানো।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হওয়ার পর একটি নির্বাচনকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নিতে চায় বিএনপি। তাদের এই লক্ষ্য পূরণ খুব সহজ হবে না। বিএনপি তাওয়া গরম করতে চাচ্ছে, কিন্তু রুটি সেঁকার মতো গরম হচ্ছে না। সরকার পতনের আন্দোলন সফল না হলে কি বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে না? এ প্রশ্নের উত্তর কোনো রাজনৈতিক জ্যোতিষীরই জানা নেই।

তবে ক্ষমতায় ফিরে আসার জন্য আওয়ামী লীগের তৎপরতায় কোনো ঘাটতি নেই। দলটি দেশের মধ্যে যেমন জয়ের লক্ষ্যে কাজ করছে, তেমনি দেশের বাইরে কূটনৈতিক যোগাযোগেও এগিয়ে থাকার কৌশল নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তিনটি দেশ সফরকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা শুধু কূটনৈতিক নয়; বরং রাজনৈতিক দিক থেকেও তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন। জাপান, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য সফরে অপ্রকাশ্য রাজনীতির বার্তা কী তা জানার কৌতূহল রয়েছে সবারই।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাপান সফর শেষে যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সম্পর্কের ৫০ বছর উদযাপনের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন। সব শেষে নতুন ব্রিটিশ রাজার রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যুক্তরাজ্য গিয়ে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকের সঙ্গেও কথা বলেছেন। সুনাক শেখ হাসিনাকে বলেছেন, ‘আপনি আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা। আমি আপনাকে অনেক বছর ধরে অনুসরণ করছি। আপনি একজন সফল অর্থনৈতিক নেতা।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরের রাজনৈতিক তাৎপর্য অবশ্যই আছে। সরকারপ্রধানের সঙ্গে রাজনীতি ও কূটনীতি দুটোই একসঙ্গে চলে। তবে জাপান, বিশ্বব্যাংক ও যুক্তরাজ্যের সঙ্গে যুক্ত থাকা অবশ্যই ইতিবাচক। রাজনীতি ও কূটনীতিকে আলাদা করা যায় না। আমরা যতই বলি, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করা ঠিক নয়। কিন্তু নির্বাচনী বছরে বিভিন্ন দেশ পরিস্থিতি ঘনিষ্ঠভাবে দেখছে।’

জাপানের সঙ্গে কৌশলগত অংশীদারত্ব চীনের সঙ্গে সম্পর্কে কোনো প্রভাব ফেলবে কি না সে বিষয়ে অধ্যাপক দেলোয়ার বলেন, আমরা যতই বলি সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব; কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়- বাস্তবে ভারসাম্যের মধ্যে থেকেও কোনো না কোনো চয়েস নিতে হচ্ছে। সোনাদিয়ায় চীন গভীর সমুদ্রবন্দর করতে চেয়েছিল। বাংলাদেশ দেয়নি।

জাপানকে মাতারবাড়িতে গভীর সমুদ্রবন্দর করতে দিয়েছে। চীন কর্ণফুলী টানেল করেছে। পদ্মা সেতুতে কাজ পেয়েছে। চীনের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের রক্ষাকবচ হলো, আমরা চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ সংক্ষেপে বিআরআইতে আছি। আমরা নিজেদের উন্নয়নের জন্য জাপানের সঙ্গে গেছি। আমরা তাদের সঙ্গে জোটবদ্ধ হচ্ছি না।’

প্রধানমন্ত্রীর এই সফরের যে রাজনৈতিক প্রভাব আছে তা পরবর্তী সময়ে পশ্চিমা দেশগুলোর নড়াচড়া বা বক্তব্য-বিবৃতি থেকেও স্পষ্ট হয়ে উঠবে।

অন্যদিকে বিএনপি কি করছে? নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবিতে আন্দোলন ক্রমেই বেগবান করার জন্য মিত্রদের সঙ্গে দফায় দফায় পরামর্শ করছে। বিভাগীয় পর্যায়ে রোডমার্চ, লংমার্চের পর শেষে ঢাকামুখী কর্মসূচি দেওয়ার কথা শোনা যাচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এসব কর্মসূচি সরকারের ওপর কতটুকু চাপ তৈরি করতে পারবে?

গত ১০ ডিসেম্বর ঢাকার বিভাগীয় গণসমাবেশ থেকে ১০ দফার ভিত্তিতে যুগপৎ আন্দোলনের ঘোষণা দেয় বিএনপি। ১০ দফা দাবির মধ্যে সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন ছাড়াও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ সব কালাকানুন বাতিল এবং খালেদা জিয়াসহ দলীয় নেতাকর্মীদের মুক্তির বিষয়টি রয়েছে। পরে রাষ্ট্রের সার্বিক সংস্কারে ১৯ ডিসেম্বর রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের একটি ২৭ দফা রূপরেখা ঘোষণা করে দলটি।

বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ১৯ দফা এবং চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ঘোষিত ‘ভিশন-২০৩০’-এর আলোকে ২৭ দফার ওই রূপরেখা প্রস্তুত করা হয়। ভবিষ্যতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় গেলে কী কী করতে চায়, ওই রূপরেখার মধ্যে সেটা স্পষ্ট করেছে বিএনপি। রূপরেখায় তারা সংবিধান সংস্কার কমিশন, জাতীয় সমঝোতা কমিশন, জুডিশিয়াল কমিশন, প্রশাসনিক কমিশন, মিডিয়া কমিশন, অর্থনৈতিক সংস্কার কমিশন করবে বলে ঘোষণা করেছে।

এদিকে গত ১০ ডিসেম্বর জামায়াতে ইসলামীও ১০ দফা দাবির ভিত্তিতে দেশব্যাপী যুগপৎ গণআন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানায়। এছাড়া বিএনপি ঘোষিত ১০ দফার সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে ১২ ডিসেম্বর যুগপৎ আন্দোলনের ১৪ দফা ঘোষণা করে গণতন্ত্র মঞ্চ। সেখানে সরকারের পদত্যাগ, সংসদ বাতিল, সংবিধানের ৭০তম অনুচ্ছেদের সংশোধন করে সরকার গঠনে আস্থা ভোট ও বাজেট পাস ছাড়া অন্য বিষয়ে সংসদ সদস্যদের স্বাধীনভাবে ভোট দেওয়ার ক্ষমতা রাখাসহ বেশ কিছু দাবি রয়েছে।

পরে গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য ১৩ দফা এবং গণফোরাম (মন্টু) ও বাংলাদেশ পিপলস পার্টি যৌথভাবে ৭ দফার ভিত্তিতে যুগপৎ আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়। বর্তমানে ৩৮টি রাজনৈতিক দল সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনে যুক্ত রয়েছে। এদের মধ্যে ৩৩টি দল গণতন্ত্র মঞ্চ, ১২ দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট ও গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য- এই চারটি জোটে বিভক্ত হয়ে আন্দোলন করছে। আর বিএনপি, জামায়াত, এলডিপি পৃথকভাবে এবং গণফোরাম ও বিপিপি যৌথভাবে যুগপতে রয়েছে।

এত এত দফা এবং এতগুলো দল নিয়ে সরকারবিরোধী আন্দোলনে নেমেও উল্লেখযোগ্য কোনো সাফল্য ঝুলিতে ভরতে পারছে না বিএনপি। ভোটের আগে তারা লক্ষ্য অর্জন করতে পারবে তারও কোনো আলামত চোখে পড়ছে না। আন্দোলনের ফসল ঘরে তুলতে না পারলে ভয়াবহ চাপে পড়বে দলটি। জয় বাংলার বদলে বাংলাদেশ জিন্দাবাদ এবং খোদা হাফেজের বদলে আল্লাহ হাফেজ বলে জনগণকে আকর্ষণ করা যাবে না।

দীর্ঘ এক যুগের বেশি সময় ক্ষমতার বাইরে মাঠের বিরোধী দল বিএনপি। নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করে দলটি। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে আন্দোলন করে শেষ মুহূর্তে ভোটে যান নেতারা। কিন্তু ওই নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ এনে তা প্রত্যাহার করে ফের মাঠের আন্দোলনের প্রস্তুতি শুরু হয়। বিগত কয়েক বছর ধরে দল গোছানোসহ সরকারবিরোধী আন্দোলনের চূড়ান্ত প্রস্তুতির কথাই বলে যাচ্ছে শুধু। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার ব্যাপারে অনড় অবস্থানে থেকে কোন পরিণতির দিকে এগোচ্ছে দলটি, দেখার বিষয় সেটাই। ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য করা খুব সহজ নয়।

বিএনপি এবার ব্যর্থ হলে তাদের কঠিন পরিস্থিতিতে পড়তে হতে পারে। দলের ঐক্য রক্ষা করা সহজ হবে না। এটা এখন অনেকটাই নিশ্চিত যে বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনেই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হবে। বিএনপি আন্দোলন করছে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে। কিন্তু বিষয়টি সংবিধানবহির্ভূত। তাদের দাবি অনুযায়ী নির্বাচন করতে হলে সংবিধান সংশোধন করতে হবে।

আওয়ামী লীগ সেটা কেন করবে? সংবিধান সংশোধনে সরকারকে বাধ্য করা বিএনপির পক্ষে সম্ভব কি না, দলের মধ্যেই সে প্রশ্ন আছে। এক্ষেত্রে সময় স্বল্পতা একটি বড় বাধা হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করছেন অনেকে। কিন্তু নেতাকর্মীদের আশ্বস্ত করার মতো অবস্থা সম্ভবত দলের হাইকমান্ডেরও নেই।

দলটির নীতিনির্ধারকরা ‘ডু অর ডাই’ মানসিকতা নিয়ে আন্দোলনের পরিকল্পনা ও ছক কষলেও দলের মধ্যে আগাগোড়া সমান আত্মবিশ্বাস তৈরি হচ্ছে না। বিগত সময়ে রাজপথে নেতাকর্মীদের উপস্থিতিও সেই বার্তাই দিচ্ছে। কয়েক মাস আগে বিভাগীয় গণসমাবেশে শত বাধা উপেক্ষা করে নেতাকর্মীদের উপস্থিতি চোখে পড়লেও ১০ ডিসেম্বরের পর পরিস্থিতি আবার নেতিয়ে পড়েছে। দলের ভেতরের একটি অংশ মনে করে তাদের নেতারা গত ১৪ বছর ধরে বলে আসছেন রোজার পর, না হয় ঈদের পর সরকারবিরোধী জোরদার আন্দোলন হবে। দল ঘুরে দাঁড়াবে। সংবাদ মাধ্যমেও ঘুরেফিরে এসব বিষয় এসেছে। কিন্তু বাস্তবে সেই ঘুরে দাঁড়ানো আর হয়নি। তাই এটা বলা যায় যে, আন্দোলনের অলীক কল্পনা ছেড়ে বিএনপি নির্বাচনের সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিলেই সব বিবেচনায় বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত হবে।

মোনায়েম সরকার: রাজনীতিক, লেখক মহাপরিচালক, বিএফডিআর

 

নিউজটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © gtbnews24.com
Web Site Designed, Developed & Hosted By ALL IT BD 01722461335