শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৫:০০ পূর্বাহ্ন

ভোলা বৃদ্ধ নিবাসের বেশিরভাগ বাবার খোঁজ নেন না সন্তানরা

নিজস্ব প্রতিবেদক: ভোলায় বৃদ্ধ নিবাসে আশ্রয় নেওয়া অধিকাংশ বাবারই খোঁজ রাখেন না সন্তানরা। এই অসহায় বাবারা আশায় বুক বেঁধে অপেক্ষা করেন সন্তানরা হয়তো কোনোদিন ভুল বুঝতে পেরে তাদের ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন। কিন্তু সেইদিন আর আসে না। তাই নিজেদের কষ্টগুলো বুকে চেপে দিন কাটে এই বাবাদের।

ভোলা পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাঁঠালি এলাকায় নিজাম-হাসিনা ফাউন্ডেশন পরিচালিত বৃদ্ধ নিবাসে সরেজমিনে দেখা যায়, সেখানে বাস করেন ১৮ জন বাবা। পরিবারের কাছে বোঝা হয়ে যাওয়ায় এখানে আশ্রয় নিয়েছেন তারা। এখানে তারা ভালো থাকলেও নিজের পরিবারের কাছে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা জাগে। সন্তানরা ভুল বুঝতে পেরে তাদের বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন এমন অপেক্ষায় দিন গোনেন বৃদ্ধ নিবাসের বাবারা। কিন্তু ফিরে নিয়ে যাওয়া তো দূরের কথা, বেশিরভাগ বাবারই খোঁজ রাখেন না সন্তানরা।

কথা হয় বৃদ্ধ নিবাসে আশ্রয় নেওয়া ৮৫ বছর বয়সী সামছুল হকের সঙ্গে। তিনি জানান, তার বাড়ি ভোলা সদর উপজেলার আলীনগর ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের মাদরাসা বাজার সংলগ্ন রহমত উল্লাহ বাড়িতে। তার এক ছেলে ও চার মেয়ে। অন্যের জমি বর্গা নিয়ে কৃষিকাজ করে সংসার চালিয়েছেন তিনি। চার মেয়েও বিয়ে দিয়েছেন। তার একমাত্র ছেলে ভোলা সদর হাসপাতালের সামনে ছোট-খাটো ব্যবসা করেন।

বৃদ্ধ সামছুল হক জানান, বয়সের ভারে তিনি আয়-রোজগার করতে পারেন না। তাই ছেলের বউয়ের কাছে তিনি ও তার স্ত্রী বিলকিছ বেগম বোঝা হয়ে যান। প্রতিনিয়ত ছেলের বউয়ের কাছে মানসিক নির্যাতনের শিকার হতেন। অনেক সময় ঠিকমতো তাদের খাবারও দেওয়া হতো না। প্রায় ১১ বছর আগে বৃদ্ধ নিবাসে রেখে যান ছেলে। আর তার স্ত্রী মেয়েদের বাড়ির থাকতেন। তিনি মারা গেছেন প্রায় ছয় বছর। এখন আর আপন বলে তার কেউ নেই। এক ছেলে ও চার মেয়ে থাকলেও তারা খোঁজ রাখেন না। তবে সব সময়ই তিনি পরিবারের কাছে ফিরে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করেন।

আরেক বাবা মো. শহীদুল ইসলাম (৮৬) জানান, তার বাড়ি ভোলা পৌর শহরের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের চর জংলার কবিরাজ বাড়ি। আগে ফেরিওয়ালার কাজ করে সংসার চালাতেন। দুই ছেলে ও দুই মেয়ে তার। মেয়েদের অনেক কষ্টে বিয়ে দিয়েছেন। বয়সের কারণে আয় রোজগার করতে না পারায় ছেলে ও মেয়েরা তাকে বৃদ্ধ নিবাসে পাঠান। তিনিও প্রায় ১১ বছর ধরে বৃদ্ধ নিবাসে আছেন। আর তার স্ত্রী নূর বানু এখনো ছেলে ও তাদের বউদের অবহেলা সহ্য করে সেখানেই আছেন। মাঝে মধ্যে স্ত্রীর সঙ্গে কথা হলেও সন্তানরা খোঁজ নেন না।

বৃদ্ধ শহীদুল বলেন, বিয়ের পর থেকে শত দুঃখ-কষ্টেও স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে কাটালেও শেষ বয়সে এসে আলাদা থাকতে হচ্ছে। আর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগে স্ত্রী-সন্তানদের মুখ দেখতে পারবো কী না তাও জানি না।

অন্যদিকে, শিবপুর ইউনিয়নের রতনপুর গ্রামের কালাগাজী হাওলাদার বাড়ির রতন মিয়ার (৭৫) গল্পটা অন্যদের চেয়ে আলাদা। তার এক ছেলে ও দুই মেয়ে। কৃষিকাজ করে সংসার চালাতেন তিনি। দুই মেয়েকে বিয়ে দেন। বয়সের কারণে নিজের কর্মক্ষমতা হারিয়ে যাওয়ায় পরিবারে আর্থিক সংকট দেখা দেয়। ছেলে অটোরিকশা চালিয়ে সংসার চালাতে পারেন না। তার ছেলেরও দুই সন্তান। ছেলের আয়ে ঠিকমতো সবাই খেতেও পারতেন না। তাই ছেলের সংসারের বোঝা কমাতে স্ত্রী রানু বেগমের সঙ্গে পরামর্শে করে প্রায় ১০ বছর আগে বৃদ্ধ নিবাসে আসেন।

রতন মিয়া বলেন, বৃদ্ধ নিবাসে আমি অনেক যত্নে আছি। সময়মতো নাশতা, মাছ-মাংস দিয়ে ভালো ভালো খাবার খেতে পারছি। তবে স্ত্রী, ছেলে ও নাতিদের জন্য সব সময় খারাপ লাগে। তারা ঠিকমতো খেতে পারছে কী না সবসময় তাই ভাবি।

তিনি আরও বলেন, ছেলে মাঝে-মধ্যে আমাকে দেখতে আসে। তার সঙ্গে বাড়িতে ফিরে যেতে মন চায়। কিন্তু ছেলের সংসারে অভাবের কারণে মুখ ফুটে বলতে পারি না। তাই কষ্ট বুকে চাপা দিয়ে বেঁচে আছি।

ভোলা নিজাম-হাসিনা ফাউন্ডেশনের বৃদ্ধ নিবাসের ম্যানেজার সালেহ উদ্দিন সেলিম বলেন, ২০১০ সালে এই বৃদ্ধ নিবাস প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রায় একশজনের ধারণক্ষমতা আছে। বর্তমানে ১৮ বৃদ্ধ এখানে আছেন। আমরা ছয়জন স্টাফ আছি তাদের দেখাশোনার জন্য। এখানে আশ্রয় নেওয়া বাবাদের অনেক যত্ন নিয়ে থাকি। এখানে তাদের সকালের নাস্তা, দুপুরে ভাত, সন্ধ্যায় নাস্তা ও রাতে ভাত খাওয়ানো হয়। প্রতিবেলায় ভাতের সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের মাছ, মাংস ও সবজি থাকে।

তিনি আরও বলেন, বৃদ্ধ নিবাসে থাকা বাবাদের অনেক ছেলেরাই খোঁজ-খবর নেয় না। কিন্তু আমরা তাদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিই। তাদের দেখাশোনা, খাবার, পোশাকের পাশাপাশি সব ধরনের চিকিৎসা আমাদের প্রতিষ্ঠান বহন করে থাকে।

 

নিউজটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © gtbnews24.com
Web Site Designed, Developed & Hosted By ALL IT BD 01722461335