শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০২:৪৮ পূর্বাহ্ন

‘কাম করি সমান কিন্তু টাকা দেয় বেডা মানুষের অর্ধেক’

নিজস্ব প্রতিবেদক: দিনমজুর রহিমা বেগম। স্বামী নেই। দুই সন্তান নিয়ে তিনজনের সংসার তার। ইটভাঙার কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। কোনোদিন কাজ না থাকলে দুই সন্তান নিয়ে অনাহারে দিন কাটে রহিমা বেগমের। আবার কাজ করলেও ন্যায্য মজুরি মেলে না। তাই কাজই তার কাছে মূল বিষয়। কোনো বিশেষ দিবস বা উৎসব নিয়ে তেমন ভাবনা নেই তার। ১৯১৪ সাল থেকে নারীর সম-অধিকার প্রতিষ্ঠায় বিভিন্ন দেশ নারী দিবস পালন করে আসছে। তবে দিনমজুর রহিমা জানেনই না নারী দিবস আসলে কী। তার ভাষ্য, ‘দিন আনি দিন খাই, আমগো আবার দিবস কী? দিবস দিয়া আমগো কোনো লাভ নাই, কাম করি সমান সমান কিন্তু টাকা দেয় বেডা মানুষের অর্ধেক। আমগো অধিকার বইলা কিছু নাই। মহিলা মানুষ বইলা অনেকে কামেও নিতে চায় না। আগে ওইডা ঠিক হউক, তারপর দিবস পালন করুম নে।’

মানুষের বাড়িতে গৃহপরিচারিকার কাজ করেন পারুল। পারুল জানেনই না নারী দিবস বলে কোনো দিবস রয়েছে। সকাল থেকে মানুষের বাড়িতে কাজ শেষে নিজের ঘরও সামলাতে হয় তাকে। আর এভাবেই বছরের পর বছর দিন কাটছে তার।

জানতে চাইলে পারুল বলেন, ‘নারী দিবস আবার কী? মাইনষের বাড়ি একদিন কাম না করলে সংসার চলব না, আমগো আবার কিয়ের দিবস। মহিলাগো অধিকার বইলা কিছু নাই। আমগো জন্মই হইছে কাম করে জীবন শেষ করার লাইগ্গা। কাম কইরা টাকা কামায়ে স্বামীরে দেই, হেয় সংসার চালায়। তাইলে আমগো অধিকার নিয়া ভাইব্বা লাভ কি? আমগো কাছে কোনো দিবস নাই, খালি কাম করুম আর সংসার চালামু।’

৮ মার্চ সারাবিশ্বের মতো বাংলাদেশেও যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করা হয় আন্তর্জাতিক নারী দিবস। প্রতি বছর আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে নানা আয়োজন থাকে। তবে এসব দিবস কিংবা দিবসের কর্মসূচিতে প্রান্তিক নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ কম।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নারী আন্দোলন বা নারী দিবস উদযাপন প্রান্তিক নারীর কাছে কতটুকু পৌঁছাতে পেরেছে সেটি মুখ্য বিষয় নয়। প্রান্তিক নারীরা কতটুকু জানলো তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ এ আন্দোলনের জন্য তাদের জীবন কতটুকু প্রভাবিত হয়েছে। একটি আন্দোলনের ফলেই এ দিবস পালন করা হয়। সুতরাং এ দিবস নারীদের ফিরে দেখার দিন যে, তারা কতটুকু করতে পেরেছেন বা কতটুকু পারেননি, কতুটুকু যেতে হবে এবং প্রান্তিক নারীর কাছে আর কতভাবে এটি পৌঁছানো যায়।

একটি পোশাক কারখানায় কর্মরত তাহমিনা  বলেন, ‘আমাদের অফিসে নারী দিবসের অনুষ্ঠান করে, তাই নারী দিবস আছে সেইটা জানি। কিন্তু এ দিবস দিয়া আমার কোনো লাভ নাই। কারণ ওই একদিন ফুল দিয়া বরণ করে নেয়, পরের দিন থেকে আবার একই অবস্থা। বেতন নিয়া ঝামেলা, মেয়ে বইলা অবহেলা- এসব সারা বছরই চলে। তাই আমগো এসব দিবস থাকলেও যা, না থাকলেও তা।’

১৮৫৭ সালের ৮ মার্চ। সেসময় যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে একটি সুচ কারখানার নারী শ্রমিকরা দৈনিক শ্রম ১২ ঘণ্টা থেকে কমিয়ে আট ঘণ্টায় আনা, ন্যায্যমজুরি এবং কর্মক্ষেত্রে সুস্থ ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করার দাবিতে সোচ্চার হয়েছিলেন। আন্দোলন করার অপরাধে সে সময় গ্রেফতার হন অসংখ্য নারী। কারাগারে নির্যাতিত হন অনেকেই। এর তিন বছর পরে ১৮৬০ সালের একই দিনে গঠন করা হয় ‘নারী শ্রমিক ইউনিয়ন’। ১৯০৮ সালে পোশাক ও বস্ত্রশিল্পের কারখানার প্রায় দেড় হাজার নারীশ্রমিক একই দাবিতে আন্দোলন করেন। অবশেষে আদায় করে নেন দৈনিক আটঘণ্টা কাজ করার অধিকার। ১৯১০ সালের এ দিনে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক সম্মেলনে জার্মানির নেত্রী ক্লারা জেটকিন ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন। এরপর থেকেই সারাবিশ্বে দিবসটি আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। জাতিসংঘ ১৯৭৫ সালে আন্তর্জাতিক নারীবর্ষে ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালন করা শুরু করে। এর দুই বছর পর ১৯৭৭ সালে জাতিসংঘ দিনটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।

প্রান্তিক নারীদের নারী দিবস সম্পর্কে সচেতনতা সম্পর্কে জানতে চাইলে অ্যাকশন এইডের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবির জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রান্তিক আর অপ্রান্তিক বলে কোনো কথা নেই, নারী দিবস সবার জন্য। এটা আয়োজন কারা করছেন, সেখানে প্রান্তিক নারীরা হয়তো করছেন না। কিন্তু যে অধিকারগুলোর কথা বলা হচ্ছে সেটা তো সব নারীর জন্য। সমাজের যে কাঠামোগত বৈষম্য আছে সেগুলোতো বেছে বেছে বলা হচ্ছে না যে এটা মধ্যবিত্তের জন্য, এটা উচ্চবিত্তের জন্য বা এটা প্রান্তিক নারীদের জন্য। আন্তর্জাতিক নারী দিবস তো গ্লোবাল, সেটার আয়োজন এবং পালন করা হয়।’

তিনি বলেন, ‘আমরা দেখেছি আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালনের জন্য গার্মেন্টসশ্রমিক ও অন্যান্য জায়গায় সচেতনতা বাড়ানো হয়েছে। পালন করছে কি না সেটা ভিত্তি হওয়া উচিত নয়, ভিত্তি হওয়া উচিত নারীরা প্রান্তিকই রয়ে যাচ্ছেন। নারীর সম-অধিকারের জায়গাটা হচ্ছেই না। সেখানে বৈষম্য রয়েই যাচ্ছে, সেদিকে ফোকাস করা উচিত। নারীদের অধিকারের কথা বারবার সামনে আসছে। কাঠামোগত বৈষম্য এখনো রয়ে গেছে। মন মানসিকতা, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি সেখানেও বেড়ে গেছে। সব নারীই সেখান থেকে ভুক্তভোগী হচ্ছে।’

ফারাহ কবির আরও বলেন, ‘মজুরির বেলায় বৈষম্য হয়। কিন্তু দিনমজুরের বেলায় তো মজুরির বিষয়ে কাগজে কলমে কোথাও লেখা নেই, এটা তো প্র্যাকটিসের ব্যাপার। সরকার এটুকু কেন করতে পারে না যে মজুরি এক ঘণ্টায় মজুরি মিনিমাম এত হবে, যা সাবাইকে দিতে হবে। সেখানে নারী-পুরুষ আলাদাভাবে কেন ঠিক করা হবে। মাটি কাটতে গিয়ে নারী-পুরুষ, কৃষিকাজে নারী-পুরুষ। কোথায় লেখা আছে যে নারীর জন্য ১৫০ টাকা আর পুরুষের জন্য ৩০০ টাকা মজুরি। এগুলো একটি ব্যবস্থায় নিয়ে এসেছে প্র্যাকটিসের মাধ্যমে। যেহেতু রাষ্ট্র ও সংবিধান বলছে সম-অধিকারের কথা, সেখানে কেন সেটির প্রয়োগ নেই। ৫০ বছরে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ আশা করে এক ঘণ্টায় কত মজুরি সেটা ঠিক করে দিলে তা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার জন্য প্রযোজ্য হবে। বৈষম্যটা হয় ইনফরমাল সেক্টরে, সেটিকে একটি কাঠামোতে নিয়ে আসতে হবে।’

মেরি স্টোপস-বাংলাদেশের অ্যাডভোকেসি লিড (প্রধান) ও জেন্ডার বিশেষজ্ঞ মনজুন নাহার জাগো নিউজকে বলেন, ‘দিবসটি যে পালন হয় সেটাও একটি আন্দোলনের ফসল। এ আন্দোলন বিশ্বব্যাপী কেন হয়েছে? হয়েছে যাতে সব নারী জাতির জীবনমান উন্নয়ন হয়। আমার মনে হয়, প্রান্তিক নারীরা জানলেন কী জানলেন না প্রশ্ন কিন্তু তার থেকেও বড় তারা এ আন্দোলনের ফলে তাদের জীবনের পরিবর্তন আমরা কতটুকু করতে পেরেছি। এ বদলের সঙ্গে সঙ্গে তারা কতটুকু সম্পৃক্ত বোধ করছেন।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রান্তিক মেয়েদের অবস্থান চাকরির বাজারে অনেক বেড়েছে। তবে কর্মক্ষেত্রে হয়রানি যেমন গার্মেন্টসে আছে, তেমনি করপোরেটে আছে, তেমনি সব সেক্টরেও আছে। এর হয়তো মাত্রা ভিন্ন, কিন্তু আমরা কেউই তার বাইরে না। আমি বলবো নারী দিবস অবশ্যই আমরা চাই তারা একদিন এ তথ্য পাক যে, বিশ্বে একদিন নারীর জন্য পালন করা হয়। একটা হচ্ছে কতটা পথ আমরা নারী অগ্রযাত্রায় আমরা এগোলাম, আর কতটা পথ বাকি আছে। এবং সেই প্রান্তিক নারীরা যেন লেখাপড়ার সুযোগ পান, তাদের চাকরির ক্ষেত্র যেন নারীবান্ধব হয় এবং পরিবারে তাদের স্বীকৃতি মেলে।’

জেন্ডার বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, ‘নারীর সঙ্গে নারীর অবশ্যই কিছু পার্থক্য রয়েছে। আমার সঙ্গে তার পার্থক্য হচ্ছে আমি কিছু সুযোগ পেয়েছি লাইফে। আমি লেখাপড়া করেছি, জব পেয়েছি। তাই আমার জীবনের ক্রাইসিস তার থেকে আলাদা, ক্রাইসিস কিন্তু আছে। একটা নারী, যদি সুযোগ পেতেন, তিনিও জানতেন আজকে নারী দিবস। সব নারী যে যার জায়গায় যতটুকু করতে পেরেছে সেই জায়গা থেকে তার সেলিব্রেট করা উচিত। ভালো কিছু করে উদযাপনও তো আন্দোলনের একটা পার্ট। জেন্ডার সমতার যে কাজ শুরু হয়েছে সেটা অনেক বড় কাজ, কারণ গ্লোবালি জেন্ডার বৈষম্য বিরাজমান। কিন্তু আমরা ধাপে ধাপে এগোচ্ছি। আমাদের ড্রপ আউট রেট স্কুলে কমেছে। কোভিডে আমাদের বাল্যবিয়ে বেড়েছে। তাই নারী দিবসকে যেন এভাবে দেখি শুধু নারী জানলেই হবে না পুরুষকেও জানতে হবে। এটা শুধু প্রান্তিক নারীর বিষয় নয়। এ বিষয়টা রাষ্ট্রের এবং বৈশ্বিক। আন্দোলনটা যেন বিশ্বব্যাপী একসঙ্গে চলে সেজন্যই আমরা উদযাপন করেছি।’

 

নিউজটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © gtbnews24.com
Web Site Designed, Developed & Hosted By ALL IT BD 01722461335