বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ০৬:০২ অপরাহ্ন

নারী বন্দিদের স্বপ্ন দেখান জিনাত

নিজস্ব প্রতিবেদক: নিজে স্বপ্ন দেখেন, অন্যকেও দেখান। গড়তে চান অপরাধমুক্ত সমাজ। স্বাবলম্বী করতে চান নারীদের। এ প্রেরণা থেকেই সংগ্রামে নেমেছেন অদম্য নারী জিনাত খান। থেমে থাকার পাত্রী নন তিনি। বছরের পর বছর ধরে কারাগারে নারী বন্দিদের হাতের কাজের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। অনুপ্রেরণা দেন যেন কারামুক্ত হয়ে তারা নিজেরা নিজেদের মতো প্রতিষ্ঠিত হতে পারেন। তাদের শোনান নিজের সংগ্রামী জীবনের গল্প।

জিনাত খানের বাবা মোস্তফা কামাল ছিলেন হবিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক। সাত বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে জিনাত দ্বিতীয়। সবাই নিজেরা নিজেদের মতো প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। বিএ পাস করার পর ২০০৬ সালে জিনাতের বিয়ে হয়। স্বামী আব্দুল হালিম পেশায় সাংবাদিক। তাদের সংসারে এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। স্বামী একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের জেলা প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত।

২০১৪ সালের দিকে তিনি একটি স্থানীয় সংবাদপত্র খোলেন। এটিই যেন তার জন্য কাল হয়ে এলো। সারাদিন মাঠ দাঁপিয়ে বেড়ানো এ সাংবাদিক রাতের পর রাত জেগে স্থানীয় সংবাদপত্রে কাজ করতেন। পত্রিকার খরচ জোগাতেও তাকে হিমশিম খেতে হতো। এমন পরিস্থিতিতে ২০১৭ সালে হঠাৎ এক রাতে তিনি স্ট্রোক করেন। নেওয়া হয় সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে দীর্ঘদিন চিকিৎসা করে শঙ্কামুক্ত হলে ফেরেন বাড়ি। এরপর দেশে ও ভারতে গিয়ে ডাক্তার দেখিয়েছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত পুরোপুরি সুস্থ হতে পারেননি। তার একটি হাত ও একটি পা এখনো তেমন কাজ করছে না। মুখেও কথা আটকে থাকে।

এদিকে, স্বামীর স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার দিনই পুরো আকাশ অন্ধকার হয়ে যায় জিনাত খানের। মনে দাগ কাটে এবার হয়তো সংসারের হাল ধরতে হবে তাকেই। তবুও যেন মাথার ওপরের ছায়াটা হারিয়ে না যায়। স্বামীকে সাহস জোগান। প্রেরণা দেন। স্বামী হাসপাতাল থেকে ফেরার পরই তিনি সিদ্ধান্ত নেন তাকে কিছু একটা করতে হবে। কিন্তু কী করবেন তাও ভেবে উঠতে পারছিলেন না। অবশেষে কলেজে পড়াকালীন শেখা সেলাইয়ের কাজে ভর করেই এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

এর আগে ২০০৩ সালে মূলত শখের বসেই যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে সেলাই শিখেছিলেন জিনাত। সেটিই পরে তার জীবনের বড় পাথেয় হয়ে দাঁড়ায়। যেই সিদ্ধান্ত সেই কাজ। স্থানীয়ভাবে নারীদের সেলাই শেখানোর কাজ শুরু করেন। পরে ২০১৭ সালে দৃষ্টি মহিলা উন্নয়ন সংস্থা নামে নিজে একটি এনজিও প্রতিষ্ঠা করেন। একই বছর তার সামনে কারাগারে বন্দি নারীদের সেলাই প্রশিক্ষণের সুযোগ আসে। সঙ্গে সঙ্গে সেটিও লুফে নেন। জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের তত্ত্বাবধানে এ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। সপ্তাহে তিনদিন সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত প্রশিক্ষণ চলে।

জিনাত খান  বলেন, আমার এখন খুব ভালো লাগে। আমি চাই অপরাধমুক্ত সমাজ গড়তে। অন্তত নারীরা যেন কারাগারে নয়, বাইরে থেকে নিজেদের জীবন নিজেরা গড়তে পারেন। প্রতিষ্ঠিত হতে পারেন। আমার জীবনের গল্প তাদের শোনাই। সাহস দিই। তাদের শুধু সেলাই নয়, ব্লক, বাটিক, নকশিকাঁথা তৈরিসহ বিভিন্ন ধরনের হাতের কাজের প্রশিক্ষণ দিই।

তিনি বলেন, তবে কষ্ট লাগে তাদের জীবনের গল্প যখন শুনি। অনেকেই আছেন মিথ্যা মামলায় কারাগারে। অনেকেই অল্প অপরাধে গুরুতর শাস্তি ভোগ করছেন। বর্তমানে হবিগঞ্জ কারাগারের পাঁচ নারী বন্দি হাতের কাজ শিখছেন। গড়ে আট থেকে ১০ জন সব সময় থাকেন। বর্তমানে বন্দি আছেন ৩৫ জন নারী। যার অধিকাংশই হত্যা এবং চেক জালিয়াতি মামলায়। হয়তো দেখা যায় পাঁচ বা ১০ হাজার টাকা নিয়েছিলেন। কিন্তু না বুঝেই টাকার প্রয়োজনের কথা ভেবে একটি খালি চেক দিয়েছিলেন। তা দিয়েই সুদখোর চার/পাঁচ লাখ টাকা বসিয়ে মামলা ঠুকে দিয়েছে। আর তাতেই আদালত সাজা দিয়েছেন।

জিনাত খান আরও বলেন, আসলে এসবের সঠিক তদন্ত হওয়া দরকার। অন্যথায় সুদখোররা আরও উৎসাহিত হবেন। আর সামান্য অপরাধেই মানুষকে জেল খাটতে হবে। আমি চাই, এসব নারী যেন বাইরে গিয়ে নিজেরা প্রতিষ্ঠিত হতে পারেন। কাজ শেখার পর তাদের সমাজসেবা থেকে সেলাই মেশিনও দেওয়া হয়। কারাগারে বন্দি নারীদের যাদের সঙ্গে পাঁচ বছরের নিচে সন্তান রয়েছে তাদেরও প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা দিয়ে থাকি।

কারাগারে প্রশিক্ষণের দায়িত্বে থাকা সমাজসেবা অধিদপ্তরের প্রবেশন কর্মকর্তা নিপুণ রায় বলেন, কারাগারে মানুষ বন্দি অবস্থায় থাকতে গিয়ে অনেকটা একঘেঁয়ে হয়ে ওঠেন। তাদের মেজাজও অনেকটা খিটখিটে হয়ে ওঠে। কিন্তু পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কারাগারকে প্রশিক্ষণের একটি জায়গা হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে। এখন আমাদের দেশেও অপরাধী সংশোধন ও পুনর্বাসন সমিতি নামে একটি সংগঠন করে এর তত্ত্বাবধায়নে কারাগারের ভেতর প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হয়েছে। যাতে কয়েদিরা বের হওয়ার পর সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেন।

তিনি আরও বলেন, কেবল শিক্ষা দিয়ে এটি হয় না। তাদের বিভিন্ন কারিগরি প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। আমরা সেটিই করি। এ মুহূর্তে হবিগঞ্জ কারাগারে শুধু নারীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। শিগগির পুরুষদেরও প্রশিক্ষণের আওতায় আনা হবে।

হবিগঞ্জ কারাগারের জেল সুপার মো. মতিয়ার রহমান বলেন, আমরা চাই বন্দিরা যেন কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে আর কোনো অপরাধে না জড়ান। তারা যেন পুনর্বাসিত হতে পারেন। সেজন্যই মূলত এ উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। আমরা এটি প্রতিনিয়তই মনিটরিং করি। জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ের কর্মকর্তারাও এটি মনিটরিং করেন। আশা করছি, এপ্রিল মাসেই পুরুষদেরও প্রশিক্ষণের আওতায় আনা সম্ভব হবে।

 

নিউজটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © gtbnews24.com
Web Site Designed, Developed & Hosted By ALL IT BD 01722461335