বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ০৭:২৯ অপরাহ্ন

ক্যানসার আক্রান্ত ৮০ শতাংশ শিশুই চিকিৎসায় সুস্থ হয়

নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশে প্রতিবছর ক্যানসার আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা বাড়ছে। জিনগত পরিবর্তন ছাড়াও ভেজাল খাদ্য, খাদ্যে বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থের ব্যবহার, বায়ুদূষণ ও বিকিরণের মাত্রা বৃদ্ধি, অপরিকল্পিত শিল্পায়ন ও নগরায়ন শিশুদের ক্যানসার ঝুঁকিতে ফেলছে। এরমধ্যে ব্লাড ক্যানসারের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। তবে নাসিকাগ্রন্থি, কিডনি ও চোখের ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়া শিশুর সংখ্যাও কম নয়। বিশেষজ্ঞদের দাবি, বেশিরভাগ শিশুর ক্যানসার নিরাময়যোগ্য। এক্ষেত্রে শুরুতে শনাক্ত করা গেলে এবং প্রথম অবস্থাতেই উন্নত চিকিৎসা পেলে ৮০ শতাংশ রোগী সেরে ওঠে।

সরেজমিনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) পেডিয়েট্রিক হেমাটোলোজি অনকোলজি বিভাগ ঘুরে দেখা যায়, হাসপাতালের ৩০টি বেডেই ভর্তি আছে ক্যানসার আক্রান্ত শিশু। বেড না পাওয়ায় বিভাগের মেঝেতেও শুইয়ে রাখা হয়েছে অনেক শিশুকে।

মেঝেতে শুয়ে থাকা শিশুদের একজন সানজিদা। বয়স আড়াই বছর। ক্যানসারে আক্রান্ত সানজিদা প্রথমে জ্বরে আক্রান্ত হয়। সাধারণ জ্বর ভেবে বাবা-মা ফামের্সি থেকে ওষুধ কিনে খাওয়ান। কিন্তু থেমে থেমে আবারও জ্বর আসে। কদিন যেতে না যেতেই গলার নিচের অংশ ফুলে যায়। অবশেষে চিকিৎসকের কাছে যান তার মা শিমু আক্তার। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে স্থানীয় চিকিৎসক পরামর্শ দেন ঢাকায় আসার। ঢাকায় আরেক দফা পরীক্ষা করিয়ে শনাক্ত হয় সানজিদা ব্লাড ক্যানসারে আক্রান্ত। এরই মধ্যে মেয়ের চিকিৎসায় দেড় মাসে দুই লাখ টাকার বেশি খরচ হয়েছে বলে জানান শিমু আক্তার।

নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী থেকে ঢাকায় এসে চিকিৎসা নিচ্ছে সাত বছরের শিশু ইমাদ ইয়াসিন আরাফ। প্রথম অবস্থায় তিন বছর বয়সে হঠাৎ জ্বর এসেছিল। এরপর দাঁতের মাড়ি থেকে রক্ত পড়া শুরু হয়। ধীরে ধীরে সে অসুস্থ হয়ে পড়ে। পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ক্যানসার ধরা পড়ে। ইমাদের মা নিপু আক্তার  জানান, দীর্ঘদিন ধরে ছেলের চিকিৎসা করাচ্ছেন। চিকিৎসক ভরসা দিচ্ছেন, ছেলে সুস্থ হয়ে যাবে। তবে এজন্য আরও দুই বছর চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হবে।

দেশের শিশু ক্যানসার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের চিকিৎসাসেবায় শিশুদের ক্যানসার ৭০ থেকে ৮০ ভাগ নির্মূল হয়ে যায়। কিন্তু মানুষের মধ্যে আস্থা তৈরি হয়নি। এখনো অনেকে ঝাড়ফুঁক বা কবিরাজি চিকিৎসায় নির্ভর করেন। কেউ কেউ আবার হোমিওপ্যাথি ওষুধের ওপর নির্ভর করে বসে থাকেন। কিন্তু প্রথম অবস্থায় চিকিৎসা নিলে ৯৫ শতাংশ ক্যানসার নির্মূল করা সম্ভব।

তাদের মতে, শিশুদের ক্যানসার শনাক্তের হার বাড়লেও সে অনুযায়ী চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্প্রসারিত হচ্ছে না। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকও কম। সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে ৫০ জনের মতো ক্যানসার বিশেষজ্ঞ রয়েছেন। অভিজ্ঞ নার্স ও টেকনিশিয়ান এবং ঢাকার বাইরে শিশু ক্যানসার চিকিৎসাসেবা এখনো অপ্রতুল।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ক্যানসারে শিশুমৃত্যুর হার কমাতে গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ ঘোষণা করেছে। যেখানে বলা হয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে শিশুদের ক্যানসারে আক্রান্তের হার ৬০ ভাগ কমিয়ে আনতে হবে। প্রতিবেশী দেশ ভারত ও পাকিস্তানে শিশু ক্যানসার রোগীদের যথাযথ পরিসংখ্যান রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে এ বিষয়ে কোনো পরিসংখ্যান নেই।

ওয়ার্ল্ড চাইল্ড ক্যানসারের হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বে প্রতিবছর দুই লাখ শিশু ক্যানসারে আক্রান্ত হয়। এরমধ্যে মধ্যম আয়ের দেশগুলোতেই আক্রান্ত হয় শতকরা ৮০ ভাগ। এখানে ক্যানসার আক্রান্ত শিশুদের বেঁচে থাকার হার মাত্র ৫ ভাগ। অন্যদিকে উন্নত দেশগুলোয় বেঁচে থাকার এ হার শতকরা ৮০ ভাগ।

সংস্থাটির তথ্য মতে, বর্তমানে ক্যানসার আক্রান্ত শিশুদের মৃত্যুর হার আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। বাংলাদেশে প্রায় ১৩ থেকে ১৫ লাখ ক্যানসার আক্রান্ত শিশু রয়েছে। ২০০৫ সালেই ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে শিশুমৃত্যুর হার ছিল ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। আর সচেতন না হলে ২০৩০ সালে এ হার দাঁড়াবে ১৩ শতাংশে।

২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত বিএসএমএমইউ হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া ৪ হাজার ৫২৬ জন রোগীর ওপরে জরিপ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের হেমাটোলজি অ্যান্ড অনকোলজি বিভাগ। এতে দেখা যায়, ৩ হাজার ৬৫০ জন অর্থাৎ ৮০ শতাংশ শিশু ব্লাড ক্যানসারে আক্রান্ত। টিউমারজনিত ক্যানসারে আক্রান্ত ৩৫৩ জন বা ৭ দশমিক ৮ শতাংশ এবং অন্যান্য ক্যানসারে আক্রান্ত ৫২৩ জন বা ১১ দশমিক ৫৫ শতাংশ।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় শিশু হেমাটোলজি অ্যান্ড অনকোলজি বিভাগ চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. এ টি এম আতিকুর রহমান  বলেন, দেশে প্রতিবছর কত শিশু ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছে এর পূর্ণাঙ্গ কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে ২০২১ সালে বিএসএসএমইউ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসে রোগীদের ওপর এটা জরিপ হয়। এর ভিত্তিতে ধারণা করা হয়, বছরে ৬ থেকে ৮ হাজার শিশু বিভিন্ন ধরনের ক্যানসার রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।

তিনি বলেন, বড়দের মতো শিশুদের সব ধরনের ক্যানসার হতে পারে। তবে বেশি হচ্ছে লিউকেমিয়া বা ব্লাড ক্যানসার। এছাড়া ব্রেইন টিউমার, চোখের টিউমার, যকৃতের টিউমার, কিডনির টিউমার, হাড়ের টিউমার ও মাংসপেশীর টিউমারও হতে দেখা যাচ্ছে।

ডা. আতিকুর আরও বলেন, আমাদের দেশে শিশুদের ক্যানসার ৭০ থেকে ৮০ ভাগ সম্পূর্ণ নির্মূল করা সম্ভব। কিন্তু আমাদের চিকিৎসকরা মানুষের মধ্যে আস্থা তৈরি করতে পারেনি। ফলে এখনো অনেকে চিকিৎসা নিতে আসে না। অর্থাৎ মোট আক্রান্তের ৬০ ভাগ রোগী চিকিৎসা নেয়। এরমধ্যে ৭০-৮০ ভাগ ভালো হয়ে যায়। ৪০ ভাগ রোগী চিকিৎসা নেয় না। এর কারণ আস্থার সংকট। তারা মনে করেন, ক্যানসারের চিকিৎসা করে লাভ নেই। এটা নিরাময় হবে না। এক্ষেত্রে তারা হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় বেশি গুরুত্ব দেয়। অনেকে কবিরাজের দ্বারস্থ হয়। এক পর্যায়ে এসব রোগী খুবই খারাপ অবস্থায় চলে যায়। শেষ পর্যায়ে তারা ক্যানসার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়। কিন্তু তখন তাদের সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে মাত্র ১০-১৫ শতাংশ।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশু হেমাটোলজি ও অনকোলজি বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. মো. আনোয়ারুল করিম  বলেন, বয়স্কদের তুলনায় শিশুদের ক্যানসার তুলনামুলক কম হয়ে থাকে। দেশে মেডিকেল অনকোলোজিস্টের সংখ্যা কম। তবে বেশ কয়েকটি মেডিকেল কলেজে ক্যানসার বিশেষজ্ঞ পদ তৈরি হয়েছে। কিছু জায়গায় পদায়নও হয়েছে। বিএসএমএমইউতে বছরে ৪০০ থেকে ৫০০ জন ক্যানসার রোগী শনাক্ত হয়ে থাকে। যাদের অধিকংশই চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হচ্ছে।

নি বলেন, ক্যানসারের আধুনিক চিকিৎসা থাকলেও এটি এখনো শহরমুখী। চিকিৎসার ডিসেন্ট্রালাইজেশন (বিকেন্দ্রীকরণ) করা গেলে চাপ কমবে। তাছাড়া ক্যানসার চিকিৎসার মূল প্রতিবন্ধকতা রোগীদের আর্থিক সমস্যা। এতে অনেক রোগী মাঝপথে চিকিৎসা নেওয়া বন্ধ করে দেয়। চিকিৎসা ভোগান্তি কমাতে সরকারি-বেসরকারি ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পেডিয়াট্রিক অ্যান্ড অনকোলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. শাহ মো. রাশেদ জাহাঙ্গীর বলেন, জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউটে শিশুদের জন্য হাসপাতালে ৪০টি শয্যা রয়েছে। গত এক বছরে নতুন-পুরোনোসহ এক হাজার ৩০০ এর বেশি শিশু চিকিৎসা নিয়েছে। ক্যানসারের ধরন ভেদে ৫০ থেকে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়। তবে শিশুদের ক্যানসার হলে অনেকে শুরুতে বুঝতে পারে না। অনেকে বিশ্বাসও করতে চায় না।

তিনি আরও বলেন, দেশের আটটি বিভাগীয় পুরোনো মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রোগীদের চিকিৎসাসেবার কমবেশি ব্যবস্থা থাকলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসার ব্যবস্থা ও সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে। শিশু ক্যানসার বিষয়ে গণমাধ্যমসহ সব শ্রেণিপেশার মানুষকে জনসচেতনতা তৈরিতে ভূমিকা রাখতে হবে।

 

নিউজটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © gtbnews24.com
Web Site Designed, Developed & Hosted By ALL IT BD 01722461335