শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ০৯:০৯ অপরাহ্ন

৯০ প্লটে কারখানা পাঁচটি বেনারসিপল্লিতে দেড় যুগেও ফেরেনি প্রাণ

নিজস্ব প্রতিবেদক: পাবনার ঈশ্বরদীর বেনারসি তাঁত শিল্পের ইতিহাস শত বছরের। ব্রিটিশ শাসনামলে ঈশ্বরদী পৌরশহরের ফতেহমোহাম্মদপুর এলাকায় বসতি গড়ে তোলেন ভারতের উত্তর প্রদেশের বেনারসি কারিগররা। এরপর বেনারসি-কাতানসহ অভিজাত শাড়ি বুননের কাজ শুরু করেন। নানা সংকট ও সমস্যার মধ্যেও বর্তমানে দুই শতাধিক তাঁতি তাদের পূর্বপুরুষদের এ পেশা ধরে রেখেছেন।

এদিকে, ঈশ্বরদীর বেনারসি তাঁত শিল্প আরও আধুনিক ও যুগোপযোগী করতে সরকার ফতেহমোহাম্মদপুর এলাকায় বেনারসিপল্লি গড়ে তোলে। ২০০০ সালে বেনারসিপল্লির নির্মাণকাজ শুরুর পর ২০০৪ সাল থেকে তাঁতিদের মাঝে প্লট বরাদ্দ দেওয়া শুরু হয়। ১৯ বছর আগে প্লট বরাদ্দ পেলেও বেশিরভাগ তাঁতি এখন পর্যন্ত কারখানা নির্মাণ করেননি। ফলে এ বেনারসিপল্লি এখনো পূর্ণতা পায়নি। ৯০টি প্লটের মধ্যে মাত্র সাতটিতে কারখানা স্থাপন করা হয়েছে। এর মধ্যে চালু রয়েছে পাঁচটি। তার মধ্যে আবার দুটি কারখানা বছরের অধিকাংশ সময় বন্ধ থাকে।

জানা গেছে, ২০০৪ সালে ২ কোটি ১৫ লাখ টাকা ব্যয়ে বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড ফতেহমোহাম্মদপুরে সাড়ে পাঁচ একর জায়গায় গড়ে তোলে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বেনারসিপল্লি। ২০ বছরে প্লটের কিস্তি পরিশোধের সুবিধার্থে ৯০ তাঁতিকে প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৭০টি ৩ শতাংশের ও ২০টি ৫ শতাংশের প্লট। শর্ত ভঙ্গের অভিযোগে এরই মধ্যে একজনের প্লট বাতিল করা হয়েছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, প্লট বরাদ্দের শর্ত অনুযায়ী তিন মাসের মধ্যে কারখানা স্থাপনের নিয়ম থাকলেও ১৯ বছরে কারখানা নির্মাণ হয়েছে মাত্র সাতটি। আরও সাত-আটটি প্লটে কারখানা স্থাপনের জন্য ইটের দেওয়াল গাঁথুনি দেখা গেলেও সেগুলোর নির্মাণকাজ শেষ হয়নি। বেশিরভাগ প্লটে কারখানা গড়ে না ওঠায় পুরো পল্লি এখন ঝোপঝাড় ও জঙ্গলে পরিণত হয়েছে। বেনারসিপল্লির দেখভালের জন্য কেবল একজন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ছাড়া আর কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী নেই। ওই কর্মকর্তা পুরো বেনারসিপল্লির দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি আটঘরিয়া উপজেলার তাঁতিদের ঋণ বিতরণ ও আদায়ের কার্যক্রম দেখভালের বাড়তি দায়িত্বও পালন করছেন।

ফতেহমোহাম্মদপুর এলাকার বেনারসি তাঁত মালিকরা বলছেন, কিস্তিতে প্লট বরাদ্দ নিলেও বেনারসিপল্লিতে কারখানা নির্মাণের মতো পুঁজি তাদের নেই। বেনারসিপল্লির আশপাশে রেলের পরিত্যক্ত জায়গায় বাপ-দাদার আমল থেকেই কারখানা নির্মাণ করে ব্যবসা করে আসছেন। এখন ব্যবসার অবস্থাও খুব একটা ভালো নয়। সুতার মূল্যবৃদ্ধি, শ্রমিক সংকটসহ নানা কারণে বেনারসি তাঁতের ব্যবসা এখন মন্দা।

তারা আরও জানান, পাকিস্তান আমলে এখানে প্রায় ৪৫০টি বেনারসি তাঁত কারখানা ছিল। এ শিল্পে জড়িত ছিলেন প্রায় সাত হাজার মানুষ। ২০১৮ সালেও এখানে ৩০০-২৫০টি কারখানা ছিল। এখন মাত্র ৫০টি কারখানা চালু রয়েছে। ভারতীয় নিম্নমানের শাড়িতে দেশীয় বাজার সয়লাব। এছাড়া দফায় দফায় সুতা, চুমকিসহ সব তাঁত সামগ্রীর দাম বাড়ায় লোকসানে পড়ে ধীরে ধীরে অনেকেই নিজেদের গুটিয়ে নিচ্ছেন।

প্লট বরাদ্দ পাওয়া তাঁতিরা বেনারসিপল্লিতে কারখানা স্থাপন করতে না পারলেও এখানে সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলার কাপড়ের কারখানা জামান টেক্সটাইলের দুটি কারখানা চালু রয়েছে। কারখানার ম্যানেজার শরিফুল আলম বলেন, এখানে ১০ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা দামের শাড়ি তৈরি হয়। হাত দিয়ে চালানো তাঁতে তৈরি বেনারসি-কাতান বুননে শ্রমিকদের মজুরি খরচ দিতে হয় তিন থেকে আট হাজার টাকা। স্থানীয় বাজারে এসব শাড়ির ক্রেতা পাওয়া যায় না।

তিনি আরও বলেন, বেনারসিপল্লিতে সরকারিভাবে সুতা প্রসেসিং কারখানা স্থাপনের কথা থাকলেও তা হয়নি। শাড়িপ্রতি প্রায় এক হাজার টাকা খরচ করে ঢাকার মিরপুর থেকে সুতা প্রসেস করে আনতে হয়।

ফতেহমোহাম্মদপুর চেয়ারম্যানপাড়ার সানজিদা শাড়ি কারখানার স্বত্বাধিকারী মো. নাসিম উদ্দিন টুটুল বলেন, ৩০ বছর ধরে এ পেশায় আছি। বেনারসি তাঁতিদের এমন দুঃসময় আগে কখনো দেখিনি। ৩০০ কারখানা থেকে বন্ধ হতে হতে ৫০টিতে ঠেকেছে। ২০২০ সালের শুরুতে শাড়ি তৈরির সুতা ছিল দুই হাজার টাকা বান্ডিল (সাড়ে চার কেজি)। সেই সুতা এখন চার হাজার টাকা। দুই বছরের ব্যবধানে সুতার দাম দ্বিগুণ। কিন্তু শাড়ির দাম এক টাকাও বাড়েনি। একটি সাধারণ জামদানি শাড়ি তৈরিতে এখন খরচ হয় দুই হাজার ৭০০ টাকা। ২০২০ সালে খরচ হতো এক হাজার ৯০০ টাকা। মাত্র দুই বছরে একটি শাড়ি তৈরিতে খরচ বেড়েছে ৮০০ টাকা। কিন্তু সেই শাড়ি এখনো দুই হাজার ৯০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

তিনি বলেন, এমনিতেই আমরা চলতে পারছি না। বেনারসিপল্লিতে কারখানা নির্মাণের পুঁজি কোথায় পাবো? বরাদ্দ পাওয়া প্লটে কারখানা নির্মাণ করে অতিরিক্ত কোনো সুযোগ-সুবিধাও পাওয়া যাবে না। তাই তাঁতিরা বেনারসিপল্লিতে কারখানা স্থাপনের আগ্রহ দেখাচ্ছে না।

ঈশ্বরদী প্রাথমিক বেনারসি তাঁতি সমিতির সভাপতি ওয়াকিল আলম  বলেন, ফতেহমোহাম্মদপুরের বেশিরভাগ তাঁতিদের বেনারসিপল্লিতে প্লট রয়েছে। কিন্তু প্লটে কারখানা নির্মাণের পুঁজি নেই। সরকার যদি প্লট অনুযায়ী কারখানা নির্মাণ করে দিতো তাহলে সবাই বেনারসিপল্লির কারখানায় আসতে পারতো। অনেক তাঁতি ঝুপড়ি ঘরে তাঁত বসিয়ে কষ্ট করে কাজ করছেন। বেনারসিপল্লিতে কারখানা স্থাপনের সুবিধা পেলে তাঁতিদের কষ্ট লাঘব হতো। পাশাপাশিপল্লিও জমজমাট হয়ে উঠতো।

সেখানে উৎপাদিত বেনারসি ও কাতান শাড়ির গুণগত মান সম্পর্কে তিনি বলেন, এখানকার বেনারসি তাঁতের শাড়ি সবই হ্যান্ড লুম (হাতে বুনন করা হয়)। হ্যান্ড লুমে তৈরি শাড়ির কারুকাজ ও বুনন নিখুঁত হয়। ভারতীয় শাড়িগুলো পাওয়ার লুমে (মেশিনে) তৈরি। এখানকার একটি জামদানি শাড়ি তিন হাজার টাকার কমে দোকানিরা বিক্রি করতে পারবেন না। কিন্তু ভারতের পাওয়ার লুমের তৈরি শাড়ি দেড় হাজার টাকায় পাওয়া যায়। দামে সস্তা পেয়ে ক্রেতারা ভারতের জামদানি কিনছে। আর যারা প্রকৃত জামদানি চেনেন বা জানেন তারা কখনোই মেশিনে তৈরি ভারতীয় জামদানি কিনবেন না।

তিনি আরও বলেন, মজুরি কম হওয়ায় এ পেশায় নতুন প্রজন্মের আর কেউ আসতে চান না। নতুন কারিগর তৈরি হচ্ছে না। শ্রমিক সংকটের কারণে আমার নিজের ১০টি তাঁত বন্ধ। বেনারসি তাঁত শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে সরকারকে সুতার দাম কমানো, ভারতীয় জামদানি, কাতান শাড়ি আমদানি বন্ধ করতে হবে। পাশাপাশি কারখানার মালিকদের সুদমুক্ত পর্যাপ্ত ঋণ দিতে হবে। তা না হলে বেনারসি তাঁত শিল্প ধীরে ধীরে হারিয়ে যাবে।

ঈশ্বরদী বেনারসিপল্লির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা খন্দকার ওবাইদুর রহমান জিলানী  বলেন, তাঁতিরা কম দামে প্লট নিলেও অনেকেই কারখানা করেননি। বেনারসিপল্লিতে বর্তমানে পাঁচটি কারখানা চালু রয়েছে। বেশিরভাগ কারখানা স্থাপন না হওয়ায় এখানে সব ধরনের সুবিধা এখনো নিশ্চিত হয়নি।

তিনি বলেন, তাঁত বোর্ডের তালিকায় এ উপজেলায় ২০৬ তাঁতির নিবন্ধন রয়েছে। ২০২২ সালে ৫ শতাংশ সার্ভিস চার্জে সরকার তাদের ৪০ লাখ ৪০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়।

লোকবল সংকট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, অফিসে পিয়ন, নৈশপ্রহরী এমনকি একজন ঝাড়ুদার পর্যন্ত নেই। একাই এ প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। পাশাপাশি আটঘরিয়া উপজেলায় তাঁতিদের ঋণ দেওয়াসহ তাঁত বোর্ডের কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয়।

 

নিউজটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © gtbnews24.com
Web Site Designed, Developed & Hosted By ALL IT BD 01722461335