বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১২:৪৪ অপরাহ্ন

বিএনপি হঠাৎ সক্রিয় বছর শেষে

জিটিবি নিউজ ডেস্ক : ২০২২ সালে বছরের অনেকখানি সময়জুড়ে একরকম নিরুত্তাপ ছিল বিএনপির রাজনীতি। বছরের শেষার্ধে দলের বিভাগীয় গণসমাবেশ ঘিরে যে উত্তেজনা তৈরি হয়, রাজনৈতিকভাবে তা মোকাবেলায় ক্ষমতাসীন দলকেও মাঠে নামতে হয়েছিল। নানা ঘটনার পর ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় শান্তিপূর্ণ গণসমাবেশ হওয়ার মাধ্যমে রাজনৈতিক অঙ্গন ও জনমনে স্বস্তি ফিরে আসে। এর আগ পর্যন্ত বিভিন্ন ঘটনার পরিক্রমায় ১০ ডিসেম্বর ঘিরে নানা শঙ্কা তৈরি হয়। রাজনৈতিক মাঠে বিএনপির আলোচিত বিষয়গুলোর মধ্যে ছিল জাতীয় সংসদ থেকে দলের সাত সংসদ সদস্যের পদত্যাগ, দলের বিভিন্ন কর্মসূচি চলাকালে গুলি ও সংঘর্ষে তাদের একাধিক নেতাকর্মীর মৃত্যু এবং বছর শেষে প্রায় ৪৫০ জন নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার। এর মধ্যে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস রয়েছেন। বছরের শুরুতে রাজনৈতিক পরিবেশ ছিল বেশ শান্ত। মাঝামাঝি সময়ে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে বিক্ষোভে ভোলায় দুই নেতা নিহত হওয়ার পর রাজনীতির মাঠ গরম হয়ে ওঠে। তখন থেকে নির্জীব বিএনপি হঠাৎ রাজনীতির মাঠে ঘুরে দাঁড়াতে থাকে। বছরের প্রথম দিকে লিভার kalerkanthoসিরোসিসে আক্রান্ত বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার চিকিৎসা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন নেতাকর্মীরা। শারীরিক অবস্থার বেশ অবনতি হওয়ায় তাঁকে নিয়ে নানা শঙ্কা ও গুঞ্জন তৈরি হয়। কয়েক দফা তাঁকে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়। তাঁর ক্ষুদ্রান্ত্রে রক্তক্ষরণ বন্ধে অস্ত্রোপচারেও যেতে হয় চিকিৎসকদের। মূলত জানুয়ারি থেকে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসা এবং তাঁকে বিদেশে পাঠানোর দাবিতে বিক্ষোভ শুরু করে বিএনপি। এ দাবিতে জেলা পর্যায়ে সমাবেশ ও মিছিলের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল দলটির কর্মসূচি। নির্বাচন কমিশন গঠনে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপে বসতে গত ১২ জানুয়ারি বিএনপিকে বঙ্গভবনে আমন্ত্রণ জানানো হয়। সেই সংলাপে অংশ নেয়নি বিএনপি ও তার সমমনা কয়েকটি দল। জানুয়ারির শেষের দিকে দলের স্থায়ী কমিটির এক সভা থেকে বৃহৎ জোটের প্রক্রিয়া শুরু করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। ফেব্রুয়ারি থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু করে বিএনপি। এরপর ২৪ মে মাহমুদুর রহমান মান্নার নাগরিক ঐক্যের সঙ্গে বৈঠকের মাধ্যমে যুগপৎ আন্দোলনে বৃহৎ ঐক্য গড়ার আনুষ্ঠানিক সংলাপ শুরু করে দলটি। এরই মধ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি ও লোড শেডিংয়ের প্রতিবাদে কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে বিক্ষোভ করতে গিয়ে ৩১ জুলাই ভোলায় পুলিশের গুলিতে ছাত্রদল নেতা নূর আলম এবং স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা আবদুর রহিম নিহত হন। এ ঘটনার চার দিন পর গত ৫ আগস্ট জ্বালানি তেলের দাম এক ধাক্কায় ৪২ থেকে ৫১ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ে। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি জ্বালানি তেল ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে আন্দোলনে কর্মসূচি দেয়। তখন থেকে মূলত আন্দোলনে দানা বাঁধতে শুরু করে। আন্দোলনে গতি বাড়াতে ২২ আগস্ট থেকে ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ওয়ার্ড, ইউনিয়ন ও উপজেলায় টানা কর্মসূচি পালন করে বিএনপি। এতে ব্যাপক সাড়া পাওয়ার দাবি করে দলটি। এরপর জেলা পর্যায়ে বিক্ষোভে মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ ও যশোরে আরো তিন কর্মী নিহত হন। তৃণমূলের বিক্ষোভ কর্মসূচিতে পাঁচ কর্মী নিহত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে আন্দোলনের তীব্রতা বাড়তে থাকে। তৃণমূলে আন্দোলনে সফলতা পাওয়ার পর ১১ থেকে ২৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঢাকা মহানগরের ১৬ স্পটে সমাবেশ করে বিএনপি। এসব কর্মসূচির কয়েকটিতে ক্ষমতাসীনরা বাধা দেয়। বাধা উপেক্ষা করে সমাবেশ করতে গেলে দুই দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। ১৭ সেপ্টেম্বর মোমবাতি প্রজ্বালন কর্মসূচি পালনের সময় বনানীতে বিএনপি নেতাদের ওপর হামলা করা হয়। এতে কেন্দ্রীয় নেতা তাবিথ আউয়ালসহ বেশ কয়েকজন আহত হন। এর মধ্যে বৃহৎ ঐক্য গড়ে তুলতে ১ অক্টোবর থেকে দ্বিতীয় দফা অনানুষ্ঠানিক সংলাপ শুরু করে বিএনপি। সংলাপ চলাকালে বিএনপি ১০ সাংগঠনিক বিভাগে গণসমাবেশের ডাক দেয়। ১২ অক্টোবর চট্টগ্রামে গণসমাবেশের মাধ্যমে বিভাগীয় কর্মসূচি শুরু হয়। চট্টগ্রামের প্রথম গণসমাবেশে জেলায় জেলায় নেতাকর্মীরা বাধার মুখে পড়েন। ময়মনসিংহে দ্বিতীয় সমাবেশে অঘোষিত পরিবহন ধর্মঘট ডাকা হয়। এর পর থেকে বাকি বিভাগের সব সমাবেশের আগে বিএনপি নেতাকর্মীদের অংশগ্রহণ ঠেকাতে পরিবহন ধর্মঘট ডাকেন শ্রমিক ও মালিকরা। বিকল্প পথে বিভিন্নভাবে নেতাকর্মীরা সমাবেশে যোগ দিতে গিয়ে হামলার শিকার হন। এসব বাধা উপেক্ষা করতে সমাবেশ শুরুর দুই দিন আগে থেকে সমাবেশস্থলে হাজির হতেন নেতাকর্মীরা। এতে এক দিনের সমাবেশ মূলত তিন দিনের কর্মসূচিতে রূপ নিত। ঢাকার বাইরে সব বিভাগের সমাবেশের পর ১০ ডিসেম্বর ঢাকার গণসমাবেশ ঘিরে রাজনৈতিক অঙ্গন ব্যাপক উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। সারা দেশে গণগ্রেপ্তার শুরু করে পুলিশ। ঢাকায় সমাবেশস্থলের অনুমতি নিয়ে শুরু হয় নাটকীয়তা। বিএনপি নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনের সড়ক চাইলেও সরকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুমতি দেয়। এ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক ও পাল্টাপাল্টি বক্তব্যের মধ্যে পুলিশের সঙ্গে নানা বিকল্প স্থান নিয়ে আলোচনা করা হলেও তা সফল হয়নি। আলোচনার এক পর্যায়ে ৭ ডিসেম্বর সমাবেশকে কেন্দ্র করে নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে নেতাকর্মীদের অবস্থানে বাধা দিতে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে মকবুল হোসেন নামের এক কর্মী নিহত হন। আহত হন প্রায় ১০০ জন নেতা। পুলিশ নয়াপল্টনের কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে জ্যেষ্ঠ নেতাসহ প্রায় ৪৫০ জন নেতাকর্মীকে আটক করে তাঁদের নামে মামলা দেয়। সেই মামলায় এখনো নেতাকর্মীরা কারাগারে আছেন। এত নাটকীয়তার মধ্যে সমাবেশের এক দিন আগে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসকে নিজ নিজ বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তারপর নাটকীয়ভাবে সমাবেশের আগের দিন দুপুরে সমাবেশস্থল নিয়ে সমঝোতায় আসে পুলিশ ও বিএনপি। ৯ ডিসেম্বর দুপুরে বিএনপিকে নয়াপল্টনের বিকল্প হিসেবে গোলাপবাগ মাঠে সমাবেশের অনুমতি দেওয়া হয়। এই সমাবেশ ঘিরে নানা ধরনের শঙ্কা ছিল। বিএনপি সমাবেশ থেকে অবস্থান নিয়ে সরকার পতনের ডাকা দেবে—এমন নানা কথাও চাউর ছিল। শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচি শেষ হওয়ায় স্বস্তি পায় দেশবাসী। সমাবেশ শুরুর আগে বিএনপিদলীয় সাত সংসদ সদস্য ই-মেইলে পদত্যাগপত্র পাঠান স্পিকারকে। সমাবেশে অংশ নিয়ে সংসদ সদস্যরা পদত্যাগের ঘোষণা দেন। পরের দিন ছয় এমপি স্পিকারের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে পদত্যাগপত্র দেন। গত ২০ ডিসেম্বর দেশে ফিরে ২২ ডিসেম্বর হারুনুর রশিদ এমপি পদত্যাগপত্র স্পিকারের কাছে হস্তান্তর করেন। সমাবেশ থেকে বিএনপি ১০ দফা রূপরেখা ঘোষণা করে যুগপৎ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করে। এতে সমর্থন দেয় সমমনা বেশ কয়েকটি দল। শনিবার যুগপৎ আন্দোলনের প্রথম কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হবে। বছরের একেবারে শেষ সময়ে এসে ১৯ ডিসেম্বর জনাকীর্ণ এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে রাষ্ট্রব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনতে ২৭ দফার ‘রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের রূপরেখা’ ঘোষণা করে বিএনপি। এতে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার নির্বাহী ক্ষমতার ভারসাম্য আনা, পর পর দুই মেয়াদের বেশি কেউ রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন না করা এবং উচ্চকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা প্রবর্তনের বিষয়টি ছিল উল্লেখযোগ্য। দলটির রূপরেখায় বলা হয়েছে, সব মত ও পথের সমন্বয়ে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, বৈষম্যহীন ও সম্প্রীতিমূলক ‘রেইনবো নেশন’ প্রতিষ্ঠা করা হবে। যুগপৎ আন্দোলন করতে সরকারবিরোধী দলগুলোর বৃহৎ ঐক্য গড়ার পর বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের বিলুুপ্তি ঘটে। গত ২২ ডিসেম্বর বিলুপ্ত জোটের শরিকদের ১২ দল মিলে ‘১২ দলীয় জোট’ গঠন করে। দলগুলো বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনের জন্য এই জোট গড়েছে বলে নেতারা জানান।

নিউজটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © gtbnews24.com
Web Site Designed, Developed & Hosted By ALL IT BD 01722461335