বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৬:৫৪ পূর্বাহ্ন

আলবদর বাহিনীর ‘সেন্ট্রাল টর্চার সেল’ ডালিম হোটেল

নিজস্ব প্রতিবেদক: মহান বিজয় দিবস বাংলাদেশের এক রক্তাক্ত ইতিহাসের দলিল। সেই ইতিহাসের অংশ হিসেবে এখনো দাঁড়িয়ে রয়েছে চট্টগ্রাম মহানগরীর কোতোয়ালি থানাধীন টেলিগ্রাফ রোডের মহামায়া ডালিম ভবন। ডালিম হোটেল হিসেবেই বেশি পরিচিত ছিল। যেটিকে যুদ্ধকালীন চট্টগ্রামে আলবদর বাহিনী সেন্ট্রাল টর্চার সেল হিসেবে ব্যবহার করতো। মুক্তিযোদ্ধা, রাজনৈতিক নেতাকর্মী, বুদ্ধিজীবীদের ধরে এনে নির্যাতন চালানো হতো এই ডালিম হোটেলে।

চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লা নজির আহমদ চৌধুরী রোড থেকে দক্ষিণে সিনেমা প্যালেসের দিকে যাওয়ার রাস্তাটা টেলিগ্রাফ রোড নামে পরিচিত। ওই রাস্তার পূর্বপাশে একটি তিনতলা ভবন আছে। ভবনটি স্বাধীনতার আগে মহামায়া ভবন নামে পরিচিত ছিল। মালিক ছিলেন চন্দ্র মোহন নাথ নামে এক ব্যক্তি। ১৯৬৬ সালে মহামায়া ভবনটি নির্মাণ করা হয়। পরবর্তীসময়ে চন্দ্রমোহন নাথ তার আদুরে মেয়ে ডালিমের নামে ভবনটিতে একটি আবাসিক হোটেল খোলেন। নাম দেন ডালিম হোটেল। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে চন্দ্রমোহন নাথ পরিবার নিয়ে ভারতে পাড়ি জমান।

পরবর্তীসময়ে ওই ভবনে দখল নিয়ে আলবদর বাহিনী তাদের টর্চার সেল গড়ে তোলে। যেখানে আলবদর বাহিনীর নির্যাতনের শিকার হয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক নাসিরুদ্দিন চৌধুরী, যিনি বর্তমানে ‘দেশ বর্তমান নামে’ একটি পত্রিকা সম্পাদনা করছেন। লিখেছেন মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক অসংখ্য বই। ডালিম হোটেলে নির্যাতনের শিকার হন গণতন্ত্রী পার্টির নেতা মরহুম সাইফুদ্দিন খান। সাইফুদ্দিন খানের বাড়ি ছিল চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার বড়উঠান গ্রামে। স্বাধীনতা পরবর্তীসময়ে তিনি গণতন্ত্রী পার্টির চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলার সভাপতি হয়েছিলেন। তার কন্যা সুমি খান একজন সাংবাদিক।

ডালিম হোটেলে আলবদরের নির্যাতনের শিকার হন প্রয়াত হারুনুর রশিদ খান। তিনি এরশাদ আমলে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। প্রখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীর চৌধুরীও ডালিম হোটেলের টর্চার সেলে নির্যাতিত হন। জাহাঙ্গীর চৌধুরী প্রয়াত ক্রীড়া সংগঠক ও বিএনপি নেতা দস্তগীর চৌধুরীর বড় ভাই। তিনি মুক্তিযুদ্ধে সিইনসি স্পেশাল গ্রুপের সদস্য ছিলেন। আরেক নির্যাতিত ছিলেন তৎকালীন জেলা ন্যাপের তুখোড় নেতা অ্যাডভোকেট শফিউল আলম (বেবী শফি)। পরে তিনি চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন।

মঙ্গলবার (১৩ ডিসেম্বর) দুপুরে সরেজমিনে দেখা যায়, সেই মহামায়া ডালিম ভবনের নামটি এখনো খোদাই অবস্থা রয়েছে। জরাজীর্ণ ভবনটিতে লেখা, ‘মহামায়া ডালিম ভবন: টেলিগ্রাফ হিল রোড-চট্টগ্রামৎ, সন ১৩৭৩ বাং’। বিবর্ণ হয়ে যাওয়া ভবনটিতে বর্তমানে কম আয়ের কিছু মানুষ বসবাস করছেন। মূল সড়ক থেকে ভবনটিতে সরু প্রবেশ পথটি যেন ভূতের গলি। পাশের ভবনে উজ্জ্বল আটার মিল। প্রতিষ্ঠানটির মালিক ৭৬ বছর বয়সী হীরা লাল নাথ। বাবার পারিবারিক মরিচ, হলুদ, আটার মিলের ব্যবসা এখনো ধরে রেখেছেন তিনি।

কথা হলে হীরা লাল নাথ বলেন, ‘আমার জন্ম থেকে এই স্থানে আছি। আমার বয়স এখন ৭৬ বছর। এই আটার মিলটি ছিল আমার বাবার। আমি পৈতৃক সূত্রে এখনো এই ব্যবসা করছি। যুদ্ধের আগে-পরে এই স্থানে থাকলেও মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আমরা নিরাপত্তার জন্য অন্যত্র চলে যাই। যে কারণে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ডালিম হোটেলে কী ঘটেছিল তা আমার অজানা।’

তিনি বলেন, ‘ভবনটি হওয়ার আগে এখানে বাঁশের বেড়া ও টিনের ছাউনির ঘর ছিল। পরে ভবন হয়। চন্দ্র মোহন নাথ ভবনটির মালিক। ভবন করার পরে নিজের মেয়ের নামে ডালিম হোটেল খুলেছিলেন। তবে যুদ্ধের আগেই ডালিম হোটেল বন্ধ হয়ে যায়। যুদ্ধ শুরুর আগে ভবনটিতে ভাড়াটিয়া থাকতো।’

ডালিম হোটেলে নির্যাতনের শিকার মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক নাসিরুদ্দিন চৌধুরী  বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে টেলিগ্রাফ ভবন এলাকার এক গুন্ডা ডালিম হোটেলে আস্তানা গাড়েন। এলাকায় তাকে মইত্যা গুন্ডা নামে চিনতো। সিনেমার টিকিট কালোবাজারির সঙ্গে জড়িত ছিল। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে ডালিম হোটেল দখলে নিয়ে সেখানে যাবতীয় অপরাধ সংগঠিত করতো মইত্যা গুন্ডা। সে মানুষ ধরে এনে নির্যাতন করতো। নারীদের এনে শ্লীলতাহানি করতো। নানাবিধ অপরাধে লিপ্ত ছিল।’

এ মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ‘যুদ্ধ শুরুর আরও কিছুদিন পরে জামায়াতের ওই সময়ের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের নেতাকর্মীরা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সহযোগিতার জন্য আলবদর নামে একটি বাহিনী গঠন করে। চট্টগ্রামেও আলবদরের শাখা গঠিত হয়। চট্টগ্রামে আলবদর বাহিনীর প্রধান ছিলেন মীর কাশেম আলী। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মীর কাশেম আলীর মৃত্যুদণ্ড হয় এবং ফাঁসিতে তা কার্যকর করা হয়। এই মীর কাশেম আলীর নেতৃত্বে পরবর্তীসময়ে ডালিম হোটেল দখল করে চট্টগ্রামে আলবদর বাহিনীর হেড কোয়ার্টার স্থাপন করা হয়। বানানো হয় টর্চার সেল। এখানে শত শত মুক্তিযোদ্ধা, বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে ধরে এনে নির্যাতন চালানো হতো। অনেককে হত্যা করে কর্ণফুলী নদীতে ভাসিয়ে দিতো, লাশ গুম করে ফেলা হতো।’

‘চট্টগ্রামে আলবদর বাহিনীর আরও দুটি টর্চার সেল ছিল। একটি ছিল চাক্তাইয়ের চামড়া গুদাম। অন্যটির অবস্থান ছিল দেওয়ান হাটের ওই সময়ের দেওয়ান হোটেলে। সময়ের ব্যবধানে ওই দুই টর্চার সেলের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেলেও এখনো ডালিম হোটেল দাঁড়িয়ে আছে।’

এ মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ‘যেদিন দেশ স্বাধীন হয়, সেদিনও ডালিম হোটেলে শতাধিক লোক বন্দি ছিল ডালিম হোটেলে। দেশ স্বাধীন হওয়ার খবরে হাজারী গলির মানুষ ডালিম হোটেলে গিয়ে বিভিন্ন রুমের তালা ভেঙে বন্দিদের উদ্ধার করে। এর আগে দেশ স্বাধীন হওয়ার খবর পেয়ে আলবদর বাহিনীর সদস্যরা সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে যান। এতে তাদের চিহ্নিত করা সহজ ছিল না।’

আলবদর বাহিনীর হাতে আটকের বিষয়ে নাসিরুদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘নভেম্বর মাসের শেষ দিন কিংবা ডিসেম্বর মাসের প্রথম দিন নজির আহমদ চৌধুরী রোডে আমার গুপ্ত স্থান থেকে আলবদর বাহিনীর লোকজন আমাকে ধরে নিয়ে যায় ডালিম হোটেলে। আমার সেদিনের গুপ্ত স্থানটি ছিল বর্তমান নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দিনের বাড়ি। মূলত ওই সময়ে আমরা শহরে অপারেশনের জন্য অবস্থান করছিলাম।’

নিজের ওপর চালানো নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে বলেন, ‘আমাকে চোখ বেঁধে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে ডালিম হোটেলে নিয়ে লোহার রড, লাঠি দিয়ে পেটানো হয় এলোপাতাড়ি। আবার ছাদের সঙ্গে পা লটকিয়ে মাথা নিচের দিকে দিয়ে পেটানো হয়। গায়ে সিগারেটের আগুনের ছ্যাঁকা দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয় চামড়া। কারেন্টের শক দেওয়া হয়। প্রায় দুই সপ্তাহ আমার ওপর নির্যাতন চলে।’

তিনি বলেন, ‘আমার ওপর যখন নির্যাতন চালানো হতো, তখন পাশের অন্য রুমগুলো থেকেও চিৎকার, আর্তনাদের আওয়াজ আসতো। তখন জানা যায়, পাশের রুমের এক সহ-বন্দিকে নির্যাতন করে হত্যা করেছে আলবদর বাহিনী।’

 

নিউজটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © gtbnews24.com
Web Site Designed, Developed & Hosted By ALL IT BD 01722461335