বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৭:৫৯ অপরাহ্ন

হার্ডিঞ্জ ব্রিজের চারপাশ জুড়েই বধ্যভূমি, সংরক্ষণে নেই উদ্যোগ

নিজস্ব প্রতিবেদক: মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত পাকশী হার্ডিঞ্জ ব্রিজের চারপাশ জুড়ে রয়েছে বধ্যভূমি ও গণকবর। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনারা পাবনার বিভিন্ন এলাকা থেকে শতশত মুক্তিকামী মানুষকে ধরে এনে এখানে হত্যা করে।

তবে স্বাধীনতার ৫১ বছরেও হার্ডিঞ্জ ব্রিজের আশপাশের এলাকাসহ পাকশীজুড়ে থাকা গণকবর ও বধ্যভূমি চিহ্নিত করা হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের নৃশংসতার নীরব সাক্ষী এসব বধ্যভূমি সংরক্ষণে নেওয়া হয়নি কোনো উদ্যোগ।

একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকশী নর্থবেঙ্গল পেপার মিলের গেস্ট হাউজে পাকিস্তানি বাহিনী ক্যাম্প স্থাপন করে। এ সেনাক্যাম্প থেকে ঈশ্বরদী ও পাবনাজুড়ে অভিযান চালাতো হানাদার বাহিনী। প্রতিদিন স্বাধীনতাকামী নিরীহ বাঙালিদের ধরে এনে নৃশংসভাবে হত্যা করে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের পাদদেশ, আশেপাশের জঙ্গল ও পাকশী স্টেশনের পাশে গণকবর ও নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হতো। বীরমুক্তিযোদ্ধা ও নিরীহ মানুষদের নির্যাতন ও হত্যার জন্য পাকশীতে টর্চারসেল খুলেছিল পাকিস্তানি বাহিনী। ১৯৭১ সালের ১১ এপ্রিল থেকে ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত হানাদাররা যে নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিল তা আজও মনে পড়লে শিউরে ওঠেন পাকশীবাসী।

পাকশীর বীরমুক্তিযোদ্ধারা জানান, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি বাহিনী পুরো পাকশীজুড়ে হত্যাযজ্ঞ চালায়। পাবনা জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে বাঙালিদের ধরে এনে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ, পাকশী রেলওয়ে স্টেশন, পেপার মিল পাম্প স্টেশন, রেললাইনের দুই ধার, পদ্মা নদীর তীর, বাঘইল, পাকশী রেল কলোনিসহ আশপাশের এলাকায় বাঙালিদের হত্যা করে মাটি চাপা দিয়ে রাখা হতো। হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নিচে নিরীহ মানুষদের ধরে এনে হত্যা করে নদীতে ভাসিয়ে দিতো হানাদার বাহিনী। অনেক সময় ব্রিজের ওপরে গুলি করে হত্যা করে মরদেহ নদীতে ফেলে দিতো। ৭১’র দিনগুলোতে পাকশীজুড়ে চলে ভয়ানক হত্যাকাণ্ড। এখানে শত শত মানুষকে হত্যা করা হয়।

পাকশীর স্থানীয় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম খান  বলেন, বাবা-দাদা ও প্রতিবেশী মুরুব্বীদের কাছ থেকে শুনেছি, হার্ডিঞ্জ ব্রিজ এলাকায় মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনারা শতশত বাঙালিকে হত্যা করে গণকবর এবং মরদেহ নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছে। ব্রিজের উত্তর দিকে গাইড ব্যাংক এলাকা ও রেল স্টেশনের আশপাশের রেললাইনের দুই ধারে অসংখ্য গণকবর রয়েছে। এখন এসব জায়গা জঙ্গলে ভরে গেছে। শতশত মানুষকে পাকশীজুড়ে হত্যা করা হয়েছে কিন্তু একটি গণকবর ও বধ্যভূমিও এখনো পর্যন্ত সংরক্ষণ করা হয়নি।

শহীদ পরিবারের সন্তান ও ঈশ্বরদীর দাশুড়িয়া ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ শহিদুল ইসলাম  বলেন, ১৯৭১ সালের ১৭ আগস্ট আমার বাবা মকবুল হোসেনকে দাশুড়িয়া বাজার থেকে স্থানীয় রাজাকাররা ধরে তাদের ক্যাম্পে আটকে রাখে। রাতে পাকিস্তানি সেনারা বাবাকে গাড়িতে তুলে পাকশী হার্ডিঞ্জ ব্রিজের ওপর হত্যা করে পদ্মা নদীতে ফেলে দেয়। আমার বাবার লাশও আমরা খুঁজে পাইনি। পাকশী হার্ডিঞ্জ ব্রিজের কাছে গেলে আজও আমি বাবাকে খুঁজে বেড়াই। আমার বাবার মতো শত শত মুক্তিকামী বাঙালিকে এখানে হত্যা করা হয়। এখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হলে শহীদ পরিবারের সদস্যরা বীর শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে পারতো।

বীরমুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ রশিদুল্লাহ বলেন, ১৯৭১ সালে ১১ এপ্রিল বিকেলে হানাদার বাহিনী পাকশীতে এসে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ এলাকা দখল করে নেয়। অবাঙালি ও স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকারদের সহযোগিতায় তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী শতশত বাঙালিকে ধরে এনে এখানে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে।

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, পাকশী হার্ডিঞ্জ ব্রিজ মুক্তিযুদ্ধের অসংখ্য স্মৃতি বহন করে চলেছে। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাকিস্তানি সেনারা পালিয়ে পাকশী হার্ডিঞ্জ সেতু পার হয়ে দক্ষিণবঙ্গ থেকে উত্তরবঙ্গের দিকে এসেছিল। ওইদিন দলে দলে পাকিস্তনি সেনারা হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পার হতে থাকে। অবস্থা বেগতিক দেখে মুক্তিযোদ্ধারা ঈশ্বরদী-কুষ্টিয়া মহাসড়কের পাশে চরসাহাপুরে অবস্থান নিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণের জন্য আহ্বান জানান। কিন্তু পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর গুলিবর্ষণ করতে থাকে, মুক্তিযোদ্ধারাও পাল্টা গুলি ছোঁড়ে।

বীরমুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ রশিদুল্লাহ আরও বলেন, হার্ডিঞ্জ সেতুর ওপর দিয়ে ট্যাংক, কামান, জিপ নিয়ে পার হতে থাকে পাকিস্তানি সেনারা। এমন পরিস্থিতিতে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর কাছে ওয়্যারলেসের মাধ্যমে বিমানবাহিনীর সহযোগিতা চাওয়া হয়। তখন ১৪ ডিসেম্বর দুপুরে দিকে পাঁচটি ভারতীয় যুদ্ধবিমান হার্ডিঞ্জ সেতু এলাকায় বোমাবর্ষণ করতে থাকে। এসময় একটি বোমা হার্ডিঞ্জ ব্রিজের ওপর ফেলা হয়। বোমার আঘাতে সেতুর ১২ নম্বর স্প্যান ভেঙে যায়। এসময় পাকিস্তানি সেনারা ট্যাংক ও অস্ত্র হার্ডিঞ্জ ব্রিজের ওপর রেখে পালাতে শুরু করে।

মুক্তিযুদ্ধ গবেষক লেখক ও বীরমুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ বলেন, পাকশী হার্ডিঞ্জ ব্রিজ এলাকা পুরোটাই বধ্যভূমি। হার্ডিঞ্জ ব্রিজের অদূরে পাকশী নর্থবেঙ্গল পেপার মিলের গেস্টহাউজে পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্প ছিল। তারা হত্যাকাণ্ডের জন্য এ জায়গাটি বেছে নিয়েছিল। সবচেয়ে দুঃখের বিষয়, এখনো পর্যন্ত এটিকে বধ্যভূমি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়নি। এখানে অন্তত একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে এখনো পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

 

নিউজটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © gtbnews24.com
Web Site Designed, Developed & Hosted By ALL IT BD 01722461335