বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ০৪:১৭ অপরাহ্ন

ব্রি ধান৮৭: স্বল্প সময়ে বেশি ফলন

নিজস্ব প্রতিবেদক: নাটোর বাগাতিপাড়ার বাঁশবাড়িয়া গ্রাম। সেখানে ডিগ্রি কলেজের আশেপাশের মাঠগুলো একসময় ভরা থাকতো আখক্ষেতে। কিন্তু বেশ কয়েক বছর লোকসানের কারণে এখন আর খুব একটা আখ চাষ করেন না চাষিরা। কয়েক বছরে তারা আম বাগানে ঝুঁকেছে। এসব বাগানে মৌসুম ছাড়া বাকি সময়গুলো ক্ষেত একদম অনাবাদি থাকতো। কিন্তু চলতি বছর থেকে ওইসব ক্ষেতের ফসলবিন্যাসে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। বাগান ও আশপাশের জমিতে এখন আমন মৌসুমে ব্রি ধান৮৭ চাষ হচ্ছে। তাতে এ বছর আশাতীত ফলনও পেয়েছেন চাষিরা।

সরেজমিনে এ এলাকায় দেখা গেছে, আগে যেখানে আখক্ষেত ছিল, এখন সেই মাঠগুলো দিগন্ত বিস্তৃত হলুদ ধানের শীষে পূর্ণ। পাকা ধান মুখে তুলে উড়ে যাচ্ছে পাখির ঝাঁক। এরমধ্যে রাস্তার দুই পাশে আম বাগানও রয়েছে। বাগানের গাছের ফাঁকেও উঁকি দিচ্ছে সোনালি ধান। যেদিকে চোখ যায়, সেদিকেই নজরকাড়া ফসলের মাঠ। মাঠের প্রায় সবগুলো ব্রি ধান৮৭ এর জাত।

মাহফুজ হোসেন নামে এক চাষি চার বিঘা জমিতে ব্রি ধান৮৭ চাষ করেছেন। তিনি বলেন, আগে এসব মাঠে আখ হতো। এরপর তিন-চার বছর আমন মৌসুমে স্বর্ণা ধান চাষ করতাম। কিন্তু স্বর্ণা ধান বেশ মোটা। ফলনও কম। পরে কৃষি বিভাগের পরামর্শে গ্রামের তিন-চারজন ব্রি ধান৮৭ জাতের ধানের আবাদ শুরু করি গত বছর। ওই বছর আমরা বাম্পার ফলন পাওয়ার কারণে এ বছর বেশিরভাগ চাষি এ জাত রোপণ করেছে। কেউ কেউ ধান কেটেছেও। খুব ভালো ফলন হয়েছে।

মাহফুজ বলেন, গ্রামের মানুষ ভালো ফলন পেয়ে খুশি। বিঘায় প্রায় ২২ থেকে ২৪ মণ ধান হয়েছে। এ জাতের চালও বেশ চিকন। স্বর্ণা বা যে কোনো জাতের চেয়ে ধানের দামও বেশি। গত বছর প্রতি মণ ধান ১ হাজার ৩০০ টাকায় পাওয়া গেছে। এ বছর আরও ভালো দাম মিলবে বলে আশা করছি।

কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, ব্রি ধান৮৭ ব্লাস্ট প্রতিরোধী। গাছগুলো শক্ত, শীষ বড়। সে কারণে বাতাসে হেলে পড়ে না। সেজন্য ওই এলাকায় ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ে কোনো ক্ষতি হয়নি ধানের। পোকার আক্রমণ নেই। জীবনকালও কম। হেক্টরপ্রতি সাড়ে ৭ টন ফলন পাওয়া যাচ্ছে। সবমিলে এখন কৃষকের কাছে জনপ্রিয় হয়েছে জাতটি।

এ ধানের জাত অবিষ্কার করেছে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি)। সংস্থাটি বলছে, হোমোজাইগাস কৌলিক সারি নির্বাচনের পর তিন বছর ফলন পরীক্ষা করে পরে ওই কৌলিক সারিটি আমন ২০১৬ মৌসুমে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় কৃষকের মাঠে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করা হয়, যা ২০১৮ সালে জাতীয় বীজ বোর্ড কর্তৃক আমন মৌসুমে চাষের জন্য ছাড়করণ করা হয়েছে। এরপর গত বছর থেকে জাতটির বাণিজ্যিক চাষাবাদ জোরদার হয়েছে।

ব্রি বলছে, পূর্ণ বয়স্ক ব্রি ধান৮৭ এর গাছের গড় উচ্চতা ১২২ সেন্টিমিটার। এ জাতের গাছের কাণ্ড শক্ত তাই গাছ লম্বা হলেও ঢলে পড়ে না। চালের আকার আকৃতি লম্বা ও চিকন। ভাত ঝরঝরে। এ ধানের ১ হাজার পুষ্ট ধানের ওজন প্রায় ২৪.১ গ্রাম। এ চাল রপ্তানিযোগ্য। গাছ বড় বলে এ ধানের খড় থেকেও ভালো লাভবান হয় চাষিরা।

বাঁশবাড়িয়া গ্রামের আরেক কৃষক মজিবুর রহমান আমবাগানে ব্রি ধান৮৭ চাষ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তিনি বলেন, এক সময় আম বাগান সারা বছর খালি পড়ে থাকতো। ব্রি ধান৮৭ এর গাছ বেশ শক্ত হওয়ায় কোনো ক্ষতি হচ্ছে না। আমের পাশাপাশি ধানও পাওয়া যাচ্ছে। ফলনও ভালো। রোগমুক্ত। একটি ধানও নষ্ট হয়নি। তার দেখাদেখি গ্রামের অন্য আম বাগানের মালিকরাও একই পথে হাঁটছেন।

কৃষক আব্দুর রহিম গত ১০ বছর ধরে ১০ বিঘা জমিতে আমন মৌসুমে ভারতীয় উচ্চ ফলনশীল (উফশী) জাতের ধান স্বর্ণা চাষ করছেন। কিন্তু কয়েক বছর ধরে এ ধানের ফলন কমছে। প্রতিবিঘায় পাঁচ টনের বেশি ধান পান না। পোকার আক্রমণ হয় বেশি। চাল মোটা হওয়ায় দামও বেশি পাওয়া যায় না। ফলে স্বর্ণা ছেড়ে এখন ব্রি ধান৮৭ চাষে ঝুঁকেছেন তিনি।

ধান চাষিরা জানান, স্বর্ণা ধানের জীবনকাল ১৪৫ দিন আর ব্রি ধান৮৭ চিকন আমন ধানের জীবনকাল ১২৭ দিন। স্বর্ণা ধান পাকার ১৫ দিন আগেই কাটা যায় ব্রি ধান৮৭ জাতের চিকন আমন ধান। মোটা জাতের স্বর্ণা ও গুটি স্বর্ণা ধান বাজারে বিক্রি করতে গেলে মহাজনরা কথাই বলতে চান না। তবে চিকন আমন ধান আড়তদার, চাতাল মালিক ও মহাজনরা আগ্রহ করে কিনছেন।

কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এ জাতের ধানে চিটা নেই বললেই চলে। আগাম ফসল কাটতে পারায় ওই জমিতে এখন সরিষা, আলুসহ অন্যান্য রবিশস্য চাষ করার উৎসাহ পেয়েছেন কৃষকরা। বাম্পার ফলনের খবরে প্রতিদিনই আশপাশের বিভিন্ন এলাকার কৃষকরা দেখতে আসছেন নতুন জাতের ধান। তারাও আগামীতে উচ্চফলন পেতে এই ধান চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন।

ব্রি বলছে, শুধু নাটোর নয়, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এখন ব্রি ধান৮৭ ধন্য ফলন। ফলনে আমনের অন্যান্য সব ধানের জাতকে পেছনে ফেলেছে এটি। সারাদেশে জাতটি ছড়িয়ে দিতে কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি। আমন মৌসুমের জাত কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করতে মাঠে আছেন ব্রির কর্মকর্তারা। নিচ্ছেন নানা পদক্ষেপ।

ব্রি রাজশাহী আঞ্চলিক কার্যালয়ের প্রধান ও মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. ফজলুল ইসলাম বলেন, রাজশাহী অঞ্চলে ৮৩৭টি ব্লক আছে। প্রতিটি ব্লকে এক বিঘা করে প্রদর্শনীর জন্য বীজ সহায়তা দিয়েছি। কৃষকদের প্রশিক্ষণ ও সার দেওয়া হয়েছে। ব্রি৮৭ ধান কেটে সরিষা, মসুর ডাল, ছোলাসহ বিভিন্ন ডালজাতীয় ফসল আবাদ করা যাবে। নির্ধারিত মৌসুমের সময় অনুসারে এবং সরিষা তুলে বোরো চাষ করা যাবে অতি সহজে।

ব্রির মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবীর বলেন, ব্রি উদ্ভাবিত নিত্যনতুন এ জাতগুলো খাদ্যসংকট মোকাবিলায় সহায়ক হবে। আমাদের উদ্ভাবিত ১০৮টি জাতের মধ্যে অনেকগুলো উচ্চ ফলনশীল। এসব জাত চাষের কারণে আগামীতে খাদ্য সংকটের কোনো শঙ্কা নেই।

তিনি বলেন, খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতে উচ্চ ফলনশীল ব্রি ধান৮৭ আবাদ সম্প্রসারণে কাজ করছে কৃষি বিভাগ। অল্প দিনের মধ্যেই ব্রি ৮৭ ধান আমন মৌসুমের প্রধান শস্যে পরিণত হবে।

নিউজটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © gtbnews24.com
Web Site Designed, Developed & Hosted By ALL IT BD 01722461335