বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১:১১ পূর্বাহ্ন

ক্ষতিপূরণের আশ্বাস ছাড়া নেই কোনো অর্জন

নিজস্ব প্রতিবেদক: এবারের বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে (কপ-২৭) অপূরণীয় ক্ষয়ক্ষতি পূরণের ঐতিহাসিক তহবিল গঠনে সম্মত হয়েছে ধনী দেশগুলো। এ তহবিল থেকে জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্ত দরিদ্র দেশগুলোকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে।

তবে ২০২৫ সালে অর্থাৎ আগামী সম্মেলনে এর কাঠামো উপস্থাপন করা হবে। ২০২৬ সাল থেকে প্রদান করা হবে অর্থ। এদিকে দরিদ্র দেশগুলোর জন্য ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ’ তহবিল দিতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন সম্মত হলেও যুক্তরাষ্ট্র মুখ ঘুরিয়ে নেওয়ায় তা এবার প্রস্তাব থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।

দেখা গেছে, গত শুক্রবার কপের আয়োজন শেষ হওয়ায় কথা থাকলেও এর সময় বৃদ্ধি করে শনিবার পর্যন্ত টেনে নেওয়া হয়। শনিবার জলবায়ু সম্মেলনে একটি আপস চুক্তির খসড়া উপস্থাপন করা হলে সারা রাত ধরে শার্ম আল শেখে আলোচনার পর জাতিসংঘের বিধান অনুযায়ী ঐকমত্য পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে চুক্তিতে উপনীত হওয়ায় সভাপতির হাতুড়ির শব্দ ধ্বনিত করে কয়েকটি চুক্তি পাস হয়।

সভায় উপস্থিত বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা জানান, দুই সপ্তাহব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলন শুক্রবার রাতের সময়সীমার ৩৬ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে চলেছিল। অধিক দর–কষাকষিতে ধনী ও দরিদ্র দেশগুলোর মধ্যে বড় বিভাজন ছিল। অনেক সময় চুক্তিতে পৌঁছানো অসম্ভব বলে মনে হয়েছিল। শেষ ঘণ্টাগুলোতে বিশ্বের তাপমাত্রা এই শতাব্দীর মধ্যে যাতে আর দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াস না বাড়ে, অর্থায়ন, অভিযোজন তহবিল, অপূরণীয় ক্ষয়ক্ষতি তহবিল, বিশ্বব্যাংক সংস্কার ও আফ্রিকার গ্যাস উত্তোলন ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়।

এদিকে ২০৩০ সালের মধ্যে গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন কমানোর জন্য যে জাতীয় পরিকল্পনা পেশ করেছে, তা বৈজ্ঞানিক পরামর্শের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি প্রাক-শিল্প স্তরের ওপরে দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমাবদ্ধ করার গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য পূরণের জন্য যথেষ্ট নয়।

জীবাশ্ম জ্বালানি বন্ধ করে রূপান্তর জ্বালানি ব্যবহারের বিষয়সহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত এবারের কপে বাতিল হয়েছে। অপূরণীয় ক্ষয়ক্ষতি অর্থায়ন তহবিল গঠন ও অভিযোজনের তহবিল সংকট প্রত্যাশিত কারণেই কপ-২৭-এ দরিদ্র দেশগুলোর জন্য জলবায়ু ক্ষতিপূরণ তহবিলের বিষয়ে আলোচনা প্রাধান্য পেয়েছে। উন্নত দেশগুলোর জন্যই বৈশ্বিক উষ্ণতা বেড়েছে। নিজেদের সমৃদ্ধ করতে লাগামহীন জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী  বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে ক্ষতিপূরণ বিষয়ে জোরালো চাপ প্রয়োগ করতে সক্ষম হয়েছে। সে কারণে ক্ষতিপূরণে ১০০ বিলিয়ন ডলাল পরিশোধে সবাই একমত। এটি ২০২৫ সালের মধ্যে দেওয়ার কথা থাকলেও আগামী বছর এর কাঠামো তৈরি করে ২০২৬ সালে প্রধান করা হবে।

তিনি বলেন, এই কপের শুরু থেকে পশ্চিমা বিশ্ব তথা ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্র অপূরণীয় ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় একটি নতুন তহবিলের দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা যুক্তি দেখিয়েছিল যে বিদ্যমান তহবিল থেকেই এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করা উচিত। গত শুক্রবার সকালে ইউরোপীয় ইউনিয়ন শর্ত সাপেক্ষে একটি তহবিল গঠনে সম্মতি দিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষে কমিশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট ফ্রান্স টিমারম্যানস অপূরণীয় ক্ষয়ক্ষতি অর্থায়ন তহবিল প্রতিষ্ঠা করতে সম্মতিসূচক একটি প্রস্তাব দেন। সমান্তরালভাবে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ২০২৫ সালের মধ্যে দেড় ডিগ্রি লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কার্বন নিঃসরণ কমানোর জন্য জাতীয় পরিকল্পনাগুলোকে আরও শক্তিশালী বিধানসহ নির্গমন কমানোর বিষয়ে জোর দিয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, উন্নত দেশগুলো শিল্পবিপ্লবের পর থেকে তাদের প্রচুর গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমনের মাধ্যমে জলবায়ু সংকটের বেশির ভাগই তৈরি করেছে। এরইমধ্যে স্বল্পোন্নত দেশগুলো বৈশ্বিক নির্গমনের একটি ক্ষুদ্র অংশের জন্য দায়ী হলেও সবচেয়ে বেশি অভিঘাতে ভুগছে। তাদের খাপ খাইয়ে নিতে অর্থায়ন ও প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান প্রয়োজন এবং ন্যায্যতার বিচারে তারা তা প্রাপ্য।

তারা আরও বলেন, জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলনে জলবায়ু ন্যায়বিচারের ধারণাটি নাগরিক সমাজের আন্দোলনের মধ্যে বিকশিত হয়েছে। উন্নত বিশ্ব উন্নয়নশীল দেশগুলোর কাছে জলবায়ু ঋণে ঋণী। ক্ষতিপূরণের ধারণা জলবায়ু ন্যায়বিচারের একটি কেন্দ্রীয় নীতিতে পরিণত হয়েছে। ঋণ বাতিলও একটি প্রধান বিষয় হয়ে উঠেছে। জলবায়ু জরুরি অবস্থার সঙ্গে সঙ্গে জলবায়ু ন্যায়বিচার এবং ক্ষতিপূরণের দাবি তীব্রতর হয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে অভিযোজনের জন্য মোট তহবিল প্রয়োজন কমপক্ষে আড়াই ট্রিলিয়ন। কিন্তু এ লক্ষ্যমাত্রা সম্পর্কে কোনো দৃশ্যমান প্রতিশ্রুতি নেই।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান কারণ কয়লা, গ্যাস এবং তেল পোড়ানোর ক্ষেত্রে হ্রাসবিষয়ক সিদ্ধান্ত হয়নি উল্লেখ করে বিশেষজ্ঞরা বলেন, জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর জন্য ভারতের আহ্বান থেকে এ আশাবাদ জন্মেছিল। যদিও প্রস্তাবটিতে ঘাটতি ছিল বড়। প্রস্তাবে ফেজ আউট নয়; ফেজ ডাউন বা পর্যায়ক্রমে হ্রাস বলা হয়েছিল। কিন্তু প্রস্তাবটি বড় ধরনের আলোচনার দিকে ধাবিত করেনি এবং সংকটময় মূল সমস্যা রয়েই গেল।

বিজ্ঞানীদের মতে, অনুমোদনপ্রাপ্ত নতুন তেল ও গ্যাসক্ষেত্র বাস্তবায়িত হলে দেড় ডিগ্রির বেশি বৈশ্বিক তাপমাত্রা প্রতিরোধের আর কোনো সম্ভাব্য উপায় নেই। তবু জীবাশ্ম জ্বালানি কোম্পানিগুলো সরকারের উৎসাহে বড় বিনিয়োগ বৃদ্ধির পরিকল্পনা করে চলেছে।

শার্ম আল শেখের সম্মেলনে তেল ও গ্যাসশিল্পের ৬৩৬ জন প্রতিনিধি ছিলেন। আগের বছরের তুলনায় ২৫ শতাংশ বেশি। গ্লাসগোতে এ সংখ্যা ছিল ৫০৩। দূষণকারী লবিস্টদের নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ায় নিরবচ্ছিন্ন অধিকার দেওয়া হলে জলবায়ু সংকটের অর্থপূর্ণ মোকাবিলা ব্যাহত হবে। জাতিসংঘের (ইউনাইটেড নেশনস ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জ বা ইউএনএফসিসি) ক্রিটিক্যাল বা গুরুত্বপূর্ণ কাজকে প্রভাবিত করে কার্যকারিতাকে দুর্বল করে দেবে।

কার্বন নিঃসরণ সীমিত করার প্রচেষ্টার মাধ্যমে গ্রহের উত্তাপকে কমিয়ে আনা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার একমাত্র উপায় বলে মনে করেন বিজ্ঞানীরা।

তারা জানান, গ্রহের উত্তাপে বিশ্বজুড়ে আবাসস্থল ধ্বংসের হুমকিতে রয়েছে। হাজার হাজার প্রজাতিকে বিলুপ্তির ঝুঁকিতে ফেলেছে। মেরু অঞ্চলের ভালুক এবং বাঘ থেকে শুরু করে প্রজাপতি এবং সামুদ্রিক কচ্ছপ বিলুপ্তির ঝুঁকিতে। প্রবাল প্রাচীর সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। প্রবাল প্রাচীর হাজার হাজার প্রজাতির জন্য বাসস্থান প্রদান করে থাকে। দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াস গ্রহের উত্তাপে প্রবাল প্রাচীরের ৭০-৯০ শতাংশ অদৃশ্য হয়ে যাবে।

নিউজটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © gtbnews24.com
Web Site Designed, Developed & Hosted By ALL IT BD 01722461335