বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ০৭:৪৮ অপরাহ্ন

শুধু বেগুনে নয়, চাষের মাটিতেই ভারী ধাতু: গবেষণা

নিজস্ব প্রতিবেদক: বেগুনে ভারী ধাতুর উপস্থিতি ও তা থেকে ক্যানসারের ঝুঁকি নিয়ে গবেষণা করছিলেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) একদল গবেষক। গবেষণার প্রাথমিক ফলাফলে দেখা গেছে, শুধু বেগুনে নয়, যে মাটিতে ফসল উৎপাদন হচ্ছে তাতেই রয়েছে ক্ষতিকর ভারী ধাতু লেড, ক্যাডমিয়াম ও নিকেলের উপস্থিতি। অন্য সবজি বা ধান-গমেও মিলতে পারে এসব ক্ষতিকর ধাতু।

সম্প্রতি জামালপুরের ইসলামপুর ও মেলান্দহ উপজেলার মাটিতে চাষ হওয়া বেগুন নিয়ে বাকৃবির গবেষকরা একটি গবেষণা করেন। সেখানে দেখা গেছে, বেগুনে ভারী ধাতুর উপস্থিতি সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি। পরে এর কারণ খুঁজতে ফসলের মাটি পরীক্ষা করা হয়। মাটি পরীক্ষা করে দেখা যায়, মাটিতেও রয়েছে সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি ক্ষতিকর ভারী ধাতুর (লেড, ক্যাডমিয়াম ও নিকেল) উপস্থিতি।

এই মাটিতে ফলানো অন্য ফসলেও এসব ভারী ধাতুর উপস্থিতি থাকতে পারে। তবে কী কারণে মাটিতে লেড, নিকেল ও ক্যাডমিয়ামের পরিমাণ বাড়ছে তা জানতে এবং এর প্রতিকারে আরও গবেষণা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া দরকার বলে মনে করেন গবেষকরা। কারণ এসব ভারী ধাতু খাবারের সঙ্গে বছরের পর বছর নিয়মিত গ্রহণ করলে ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. জাকির হোসেনের নেতৃত্বে অধ্যাপক ড. কাজী ফরহাদ কাদির, অধ্যাপক ড. হারুনুর রশিদের সমন্বয়ে বেগুন ও মাটির নমুনা নিয়ে গবেষণা করা হয়। জামালপুরের ইসলামপুর ও মেলান্দহ উপজেলার কৃষকদের কাছ থেকে বেগুন ও মাটির নমুনা নিয়ে দুই বছর ধরে গবেষণা করা হয়। সম্প্রতি ওই গবেষণার ফলাফল প্রকাশিত হয় আন্তর্জাতিক জার্নাল ‘সায়েন্টিফিক রিপোর্টে’।

এ বিষয়ে বেগুন চাষি মো. শহিদুল্লাহ বলেন, বেগুন ক্ষেতের পোকা মারতে চার ধরনের বিষ দিতে হয়। এই চার জাতের বিষ একসঙ্গে মিশিয়ে ক্ষেতে দিলে পোকা মরে, না হলে মরে না। আমার এক বিঘা জমিতে ৯ মাসে প্রায় ৩৬ হাজার টাকার বিষ দিতে হয়েছে।

তিনি বলেন, তবে আগামীতে বেগুন ক্ষেতে বিষ না দিয়ে নেট হাউজ তৈরি করে ফেলবো। এতে নিজের ক্ষতি, ফসলের ও মাটি ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। আর এসব বিষ স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতির। কারণ, এই বছর বেগুনক্ষেতে দুই প্রকার বিষ দিয়ে পোকা মারলাম। কিন্তু, পরের বছর চার প্রকার বিষ দিয়ে পোকা মারতে হবে, না হলে বেগুন ক্ষেতের পোকা মরবে না। প্রতিবছর এভাবে বেগুন ক্ষেতে বিষ প্রয়োগ বাড়াতে হয়।

বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে বাকৃবির রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক কাজী ফরহাদ কাদির  বলেন, গবেষণাটা শুরু হয় ২০২০ সালে বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের একটি ফান্ডে এবং পরবর্তীকালে একই দাতা সংস্থার আরেকটি ফান্ডে মোট দুই বছর আমাদের গবেষণা চলে। গবেষণায় আমরা জামালপুর জেলার ইসলামপুর ও মেলান্দহ উপজেলা থেকে বেগুন এবং যে মাটিতে বেগুন হচ্ছে সেই মাটি সংগ্রহ করে নিয়ে আসি। সেখানে ভারী ধাতুর পাশাপাশি অন্য কিছু পুষ্টি উপাদানের মাত্রা কতখানি আছে তা দেখি।

তিনি বলেন, আমাদের গবেষণার মূল উদ্দেশ্য ছিল, আমরা যে পরিমাণ বেগুন খাই সেখানে যে আয়রন, জিংক আছে তা আমাদের জন্য যথেষ্ট কি না তা দেখা। পাশাপাশি ক্ষতিকর উপাদান ভারী ধাতু আছে কি না তা জানার চেষ্টা করি। ভারী ধাতু লেড, নিকেল, ক্যাডমিয়াম ও কপার কতখানি আছে তা সহনীয় মাত্রার চেয়ে কম না বেশি; সেটা ক্ষতিকর হলে কতখানি ক্ষতি হতে পারে, তাও জানার চেষ্টা করেছি।

কাজী ফরহাদ কাদির বলেন, পাশাপাশি আমরা দেখেছি যে লেড, নিকেল ও ক্যাডমিয়াম পেলাম তা কোথা থেকে এলো। সেজন্য আমাদের মাটির সঙ্গে একটা যোগসূত্র স্থাপন করার চেষ্টা করেছি। সেক্ষেত্রে গবেষণা করে করে দেখেছি লেড, নিকেল, ক্যাডমিয়াম ও কপার চারটি ধাতু মাটি থেকেই এসেছে। পরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেছি মাটিতে এই চারটি ধাতু সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি আছে।

বাকৃবির কৃষি রসায়ন বিভাগের আরেক অধ্যাপক জাকির হোসেন  বলেন, মাটিতে লেড, ক্যাডমিয়াম, নিকেল ও কপারের উপস্থিতি সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি। এর কারণে এসব শুধু বেগুন নয়, অন্যান্য সবজি এমনকী ধান-গমেও আসতে পারে। এটা আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য হতে পারে বড় ঝুঁকির কারণ। এসব ধাতু শুধু জামালপুরের ইসলামপুর ও মেলান্দহের মাটিতে বেশি আছে বিষয়টি এমন না। আমরা ভালুকা ও গাজীপুরের মাটিতেও এসব ধাতুর উপস্থিতি পেয়েছি। আমরা যদি মনে করি, গাজীপুর ও ভালুকায় কলকারখানা বেশি এই কারণে এসব জায়গার মাটিতে লেড, ক্যাডমিয়াম, নিকেলের উপস্থিতি বেশি। তা ঠিক নয়, কারণ, জামালপুরে তো কলকারখানা নেই। তাহলে সেখানে এসব ভারী ধাতু এলো কীভাবে?

তিনি আরও বলেন, মাটিতে ভারী ধাতুর যে উপস্থিতি পাওয়া গেছে, এর উৎস কী- রাসায়নিক সার, কীটনাশক, সেচের পানি নাকি অন্য কোনো উপায়ে মাটি নষ্ট হচ্ছে- এ বিষয়ে বিস্তর গবেষণা প্রয়োজন। যে সমস্ত উৎস থেকে ভারী ধাতুগুলো আসছে সেগুলো যদি আমরা বন্ধ করে দিতে পারি, তাহলে মাটিতে ভারী ধাতুর পরিমাণ কমে যাবে এবং খাদ্যে কম অনুপ্রবেশ করতে পারবে। এ বিষয়ে গবেষণার ওপর ভিত্তি করে নেওয়া পদক্ষেপে নিরাপদ ফসল উৎপাদন করা সম্ভব হবে।

নিউজটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © gtbnews24.com
Web Site Designed, Developed & Hosted By ALL IT BD 01722461335