শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১০:০২ অপরাহ্ন

ডেঙ্গু ‘নেই’ বস্তিতে!

নিজস্ব প্রতিবেদক: রাজধানীসহ সারাদেশের হাসপাতালগুলোতে প্রতিদিনই বাড়ছে ডেঙ্গুরোগীর সংখ্যা। বড় হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। রোববার (২৩ অক্টোবর) এবছর একদিনে সর্বোচ্চ ১ হাজার ৩৪ জন ভর্তির রেকর্ড। আক্রান্ত ও মৃত্যুর দিক থেকে এগিয়ে থাকা ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে নানান পদক্ষেপের পাশাপাশি ক্রাশ প্রোগ্রামেও কমেনি ডেঙ্গু। প্রতিষ্ঠান দুটির বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। হাসপাতালগুলো বাড়তি ব্যবস্থা নিয়েও রোগীর সংকুলান করতে পারছে না। তবে কিছুটা অবাক করা হলেও রাজধানীর বস্তিগুলোতে ডেঙ্গুর উপস্থিতি নেই বললেই চলে।

সরেজমিনে রাজধানীর কয়েকটি বস্তি ঘুরে সেখানে বসবাসকারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বস্তিতে জ্বর, ঠান্ডা হলেও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন কি না তারা জানেন না। ডেঙ্গুতে বা জ্বরে কেউ মারা গেছে বলেও তারা শোনেননি। ফার্মেসি থেকে ওষুধ এনে খেয়েই সুস্থ সবাই। একজন শুধু বলেছেন তিনি এক শিশুর ডেঙ্গু হয়েছিল বলে শুনেছেন। বস্তির পাশেই গড়ে ওঠা বড় বড় বিল্ডিংয়ে যারা থাকেন তাদের যদি বস্তিবাসীর তুলনায় ‘অভিজাত’ বলা যায় তাহলে তাদের মধ্যে আবার আক্রান্ত কম নয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঘনবসতি হওয়ায় বস্তি এলাকায় ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার ঘনত্ব কম। এ কারণে সেখানে ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার হারও কম। আবাসিক ভবনেই ডেঙ্গুর লার্ভা জন্মানোর সুযোগ বেশি।

রাজধানীর মিরপুর-১২ নম্বর সেকশনে মোল্লা বস্তিতে থাকেন রিকশাচালক মোহাম্মদ বশির হাওলাদার। তার এলাকায় সিটি করপোরেশনের লোকজন এখনো মশা নিধনের কোনো কর্মসূচি নিয়ে যায়নি।

তিনি বলেন, সিটি করপোরেশনের লোকজন কোনো ওষুধ দেয়নি। বিকেলের পর মশার জ্বালায় কোথাও বসার অবস্থা থাকে না। কয়েল দিয়েও কোনো কাজ হয় না। মশার কামড়ে হাত-পা ফুলে যায়।

১২ নম্বর সেকশনের মোল্লা মার্কেটের পেছন থেকে পাঁচ মিনিটের দূরত্বে বস্তির অবস্থান। মার্কেট সংলগ্ন রাস্তায় অভিজাত শপিং সেন্টার, খাবার ও ফ্যাশন ব্র্যান্ডের দোকান। সামান্য দূরত্বে মোল্লা বস্তির ঘিঞ্জি পরিবেশে প্রায় এক হাজার ঘরে বসবাস কয়েক হাজার পরিবারের।

বশির বলেন, ‘চারদিকে শুনি ডেঙ্গু হইছে। আমাদের এখানে একটা ছেলের ডেঙ্গু হইছিল গত মাসে। সিরিয়াস অবস্থা হয়ে গেছিল, পরে হাসপাতালে নিয়ে গেছে। এখন সুস্থ। এছাড়া কারও হইছে বলে শুনিনি। আমরা যে পরিবেশে থাকি, এডিস মশা এখানে নেই। করোনা, ডেঙ্গু কোনো কিছুই বস্তিতে নেই।’

একই অভিজ্ঞতা বস্তির চা দোকানদার মোহাম্মদ সাগরের। তিনি বলেন, আমাদের এলাকায় ডেঙ্গু মশা হয় না। কেউ এখনো ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়েছে শুনিনি। তবে বস্তির উপরে আবাসিকে কয়েকজনের ডেঙ্গু হয়েছে বলে শুনেছি।

পুরো বস্তিতে ডজনখানেক চা দোকানের অধিকাংশই চালান নারীরা। চায়ের দোকানগুলোতে কথা বলেও জানা যায়, ডেঙ্গুর প্রকোপ নেই বস্তিতে। সামান্য জ্বর, ঠান্ডা অনেকের হয়েছে তবে খরচের ভয়ে কেউ হাসপাতালে যায়নি। দোকান থেকে ওষুধ এনে খেয়েছে।

বস্তিবাসীর কথার সঙ্গে মিল পাওয়া যায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশারের বক্তব্যে।

তিনি বলেন, বস্তিতে ঘনবসতি। সেখানে পানি জমার সুযোগ থাকে কম। একটা ভবন বা আবাসিক এলাকায় অনেক খালি পাত্র পড়ে থাকে, কিন্তু বস্তিতে জনবসতি বেশি থাকায় সেখানে কনটেইনার বা পানি জমার পাত্র পড়ে থাকে না। এসব কারণে বস্তিতে এডিস মশার বংশবৃদ্ধি কম।

রাজধানীর হেলথ অ্যান্ড হোপ স্পেশালাইজড হাসপাতালের পরিচালক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী  বলেন, সাধারণ পরিস্থিতিতে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ার কারণ হচ্ছে আবাসিক এডিস মশা। যেটাকে এডিস ইজিপ্টাই বলা হয়। ২০১৯ সালে যখন ডেঙ্গু মহামারি হয় তখন বুনো ধরনের এডিস এলবোপিক্টাস (এডিসের আরেকটি প্রজাতি) হয়ে যায়। এখন ঢাকায় বুনো ও আবাসিক দুই ধরনের এডিসই ডেঙ্গু ছড়াচ্ছে। বস্তিতে সাধারণত গাছপালা, ঝোপঝাড় থাকে না। বুনো এডিস মশা যেহেতু ঝোপঝাড়ে বংশবিস্তার করে, তাই বস্তিতে এর প্রকোপ কম। অন্যদিকে আবাসিক এডিস মশা স্বচ্ছ টব, চৌবাচ্চার স্বচ্ছ পানিতে বংশবিস্তার করে। বস্তিতে স্বচ্ছ পানির উৎস কম, এসব কারণে সেখানে ডেঙ্গুর প্রকোপও কম।

মোল্লা বস্তি ছাড়াও বাউনিয়া বাঁধ বস্তি, মিরপুর-১১ নম্বরের মিল্লাত ক্যাম্প এলাকার বাসিন্দারাও জানিয়েছেন ডেঙ্গুরোগী একেবারেই কম দেখছেন তারা।

মিল্লাত ক্যাম্পের বাসিন্দা মান্না বলেন, অনেক শিশুর জ্বর, ঠান্ডা হয়েছে। দোকান থেকে ওষুধ কিনে খেয়ে সুস্থ হয়েছে। কারও ডেঙ্গু হয়েছে শুনিনি। হলেও তো বোঝা যাবে না, কারণ টেস্ট করায় না কেউ। ডাক্তারের ভিজিট ৮শ টাকার বেশি। ডেঙ্গু চিকিৎসায় অনেক খরচ।

বাউনিয়া বাঁধ বস্তির বাসিন্দা আঞ্জুমান আরা জানান, তার ৭ বছরের মেয়ের জ্বর হয়েছিল গত মাসে। তবে হাসপাতালে তাকে ভর্তি করানো লাগেনি। সেটা ডেঙ্গু কি না তার জানা নেই।

ডেঙ্গুর চিকিৎসায় প্রচুর খরচ হয় এমন ধারণা সঠিক নয় জানিয়ে লেলিন চৌধুরী বলেন, ডেঙ্গু হলেই যে চিকিৎসাটি খরচসাধ্য হবে সেটা সঠিক নয়। ডেঙ্গুর একটি অংশ কোনো লক্ষণ তৈরি করে না। যাদের তৈরি হয় তাদের অধিকাংশই সামান্য প্যারাসিটামলজাতীয় ওষুধ ও পানি খেয়ে সুস্থ হয়ে যেতে পারেন। রোগের জটিলতা বা তীব্রতা বাড়লে তখন রোগীকে হাসপাতালে নিতে হয়। তখন খরচের কথা ভাবার সময় থাকে না। সাধারণত ডেঙ্গুর জন্য রোগীদের তেমন কোনো খরচ হয় না। তবে জটিলতা বাড়লে সে অনুযায়ী রোগীর চিকিৎসার খরচ ওঠানামা করে। ডেঙ্গু চিকিৎসায় খরচের কথা যারা বলেন তারা দৃশ্যপটের ক্ষুদ্র একটা অংশ।

নিউজটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © gtbnews24.com
Web Site Designed, Developed & Hosted By ALL IT BD 01722461335