শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৫:০৪ অপরাহ্ন
নিজস্ব প্রতিবেদক: ঐতিহ্য হারাচ্ছে মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার খাতিয়াল গ্রামের সেনাপতির দিঘি। হারাচ্ছে সৌন্দর্যও। প্রভাবশালীরা কৌশলে দিঘিটি একটু একটু করে দখল করে নিচ্ছেন। এখনই দিঘিটি রক্ষা না করলে আস্তে আস্তে প্রভাবশালীদের দখলে চলে যাবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সুবেদার শায়েস্তা খানের জ্যেষ্ঠপুত্র উমেদ খানের নেতৃত্বে ২৮৮জন নদী পথে যাত্রা করেন। চট্টগ্রাম বিজয়ের পর কিছু উৎসাহী সৈন্য বরিশাল ও পটুয়াখালী থেকে মগ সৈন্যদের বিতাড়নের নৌ-অভিযান করেন। সেখান থেকে ফেরার সময় মাদারীপুরের কালকিনির খাতিয়ালে বিশ্রাম নেন। এ সময় তাদের পানির সমস্যা দেখা দেয়। তখন এ দীঘিটি খনন করা হয়।
ধারণা করা হয়, ১৬৬৫ খৃষ্টাব্দে ২৪ ডিসেম্বর প্রায় ৬ একর জমির ওপর দিঘিটি খনন করা হয়। বর্তমানে এর গভীরতা প্রায় ১০ ফুটে এসে থেমেছে। দিঘির চারদিকে গাছ-গাছালি ছিল। মানুষের ঘন বসতির কারণে অধিকাংশ গাছপালা ধ্বংস হয়ে গেছে। প্রভাবশালীরা জায়গা দখল করে নিয়েছে। ফলে এ মূল্যবান জায়গা পতিত অবস্থায় পড়ে আছে।
এক সময় দিঘির চারপাশ পাখ-পাখালির কলরবে মুখরিত থাকতো। বানর, হনুমানসহ বিভিন্ন জীবজন্তু অবাধে ঘোরাফেরা করতে দেখা যেত দিঘির চারপাশে। দীঘির পাড়ের বড় বট গাছের গোঁড়ায় প্রতিদিন শত শত মানুষ টাকা পয়সা, গরু-ছাগল, হাস-মুরগীসহ নতুন কাপড় রেখে যেতেন মনের আশা পূরণ হবার আশায়। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা প্রতিদিন সকাল-বিকেল পূজা করতে এখানে। আমাবস্যা-পূর্ণিমায় ধ্যান মগ্ন থাকতেন অনেকে।
এ দীঘি নিয়ে রয়েছে অনেক রূপকথা। প্রবীণদের মুখে ভিন্ন রকম গল্প শোনা যায়। মো. আয়নাল হোসেন (৮২) নামের এক বৃদ্ধ বলেন, ভিন দেশে থেকে এখানে বেড়াতে আসেন মামা-ভাগনে। তারা এক রাতে অলৌকিকভাবে খনন করে এ দীঘি। কিন্তু দীঘিতে কোনো পানি ওঠেনি। তখন তারা স্বপ্ন দেখলো দীঘির বুকে ঘোড়া দৌড়ালে পানি আসবে। পরদিন মামা-ভাগনে ঘোড়া নিয়ে দিঘির মধ্যে নামতেই পানিতে ভরে যায়। সঙ্গে মামা-ভাগনেও পানিতে তালিয়ে যান।
আইয়ুব আলী (৯০) নামের আরেক বৃদ্ধা বলেন, দিঘির পশ্চিম পাশে বড় একটা বট গাছের ওপর থেকে শোনা যেত মোরগের ডাক। তখনকার সময়ের সবাই শুনতেন এ ডাক। কিন্তু কেউ কোন দিন মোরগটি দেখেনি।
আমেনা বিবি (৮৭) বলেন, এ গ্রামের কারো বিয়ে বা কোনো ধরণের অনুষ্ঠান হলে তাদের প্রয়োজন মতো রাতের বেলায় দীঘির পাড়ে গিয়ে থালা-বাসন, হাঁড়ি-পাতিলসহ বিয়ের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র চাইলে ভোরে দিঘিতে ভেসে উঠতো। অনুষ্ঠান শেষে দিঘির পাড়ে রেখে গেলে রাতের অন্ধকারে তা মিলিয়ে যেত। একবার এক লোক একটি থালা চুরি করে রাখার পর থেকে আর কেউ দিঘি থেকে থালা-বাসন চাইলেও ভেসে উঠেনি। দিঘিকে ঘিরে এমন অনেক চমৎকার রূপকথা রয়েছে।
এ ব্যাপারে পরিবেশবাদী সংগঠন ফ্রেন্ডস অব নেচারের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক রাজন মাহমুদ বলেন, প্রভাবশালীরা রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে দিঘিটি দখল করে ইচ্ছে মতো ব্যবহার করছে। ফলে এ বিশাল সম্পত্তি কোনো কাজেই আসছে না। জীববৈচিত্র সংরক্ষণের জন্য জায়গাটি ব্যবহার করতে পারবে।
মাদারীপুরের ইতিহাস গবেষক সুবল বিশ্বাস বলেন, সেনাপতির দিঘিটি মাদারীপুরের ঐতিহ্য বহন করে। তা এটি রক্ষণাবেক্ষণ আমাদের সকলের দায়িত্ব।