বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ০২:২৬ অপরাহ্ন

বকশিশ ছাড়া তারা মুখও খোলেন না, নথিও নড়ে না

নিজস্ব প্রতিবেদক: কেউ অন্যায় বা অবিচারের শিকার হলে আইনি উপায়ে বিচার পেতে মামলা করেন। থানায় মামলা হলে এজাহার পাঠিয়ে দেওয়া হয় আদালতে। আসামি গ্রেফতার হলে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা প্রতিবেদনসহ ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আসামিকে আদালতে হাজির করেন। শুরু হয় আইনি লড়াই। এখান থেকেই শুরু হয় বিচার পাওয়া-না পাওয়ার মূল চ্যালেঞ্জ। জায়গায় জায়গায় বকশিশের নামে ঢালতে হয় টাকা। মামলা চলতে থাকে বছরের পর বছর। বকশিশও দিতে হয় মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত।

বিচারপ্রার্থীদের মতে, বকশিশের চাপেই মামলার ব্যয় পাহাড় সমান হয়ে যায়। এ ব্যয়ের পাহাড় অনেককে নিঃস্ব করে দেয়। মামলা লড়তে লড়তে প্রায় সর্বস্ব খোয়াতে হয় বাদী ও বিবাদী উভয়পক্ষকে। মূলত মামলার কপি নেওয়া, হাজিরা দেওয়া, ওকালতনামায় সই করা, রিমান্ড বাতিলের শুনানি, জামিননামা দেওয়া, জামিনের শুনানি করা, মামলার নকল তোলাসহ মামলা সংক্রান্ত যে কোনো সেবায় বকশিশ বা খরচাপাতি ছাড়া এখন যেন চলেই না।

ব্রিটিশ আমল থেকে আদালতপাড়ায় বকশিশের রেওয়াজ। ঘুস হিসেবে নয়, বকশিশ হিসেবে এটা প্রচলিত। খুশি হয়ে অনেকে বকশিশ দেন। চাপ প্রয়োগ করে যারা বকশিশ নেন তারা অন্যায় করেন। তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। নিয়মের বাইরে কেউ নয়। সবাইকে নিয়মের মধ্যে চলতে হবে।

বিচার চাইতে এসে লাগামহীন খরচের পাল্লায় পড়ার অভিযোগ প্রায়ই পাওয়া যায় নিম্ন আদালতে। এমন অনেক মানুষ কথা বলেছেন জাগো নিউজের সঙ্গে। তাদের অভিযোগ, বখশিশ বা খরচাপাতি দিতে হয় নিম্ন আদালতের ফাইলিং শাখা, সেরেস্তা, জিআর শাখা, আদালতের পেশকার, উমেদার, মামলার জিআরও, আদেশ লিখতে সংশ্লিষ্ট কম্পিউটার অপারেটর, বিচারকদের আরদালি (যিনি বিচারকের চেয়ার ঠিক করে দেন), আদালতের পিয়ন, সমন জারিকারক, আইটি সেকশন ও ডিসপাস শাখায়। এসব জায়গায় কতিপয় কর্মচারী অনিয়মের সঙ্গে জড়িত। টাকা না দিলে ফাইল নড়ে না। টাকা দিলে কাজ হয় দ্রুতগতিতে। আদালত অঙ্গনে নিয়মবহির্ভূতভাবে এ ধরনের লেনদেনকে বলা হয় খরচাপাতি। আবার যারা নিচ্ছেন, তারা এটাকে ‘ঘুস’ বলতে নারাজ। তাদের ভাষ্য— নির্বিঘ্নে কাজ শেষ করতে ‘বকশিশ’ দিতে হয় অনেককে।

জাগো নিউজের অনুসন্ধানে দেখা যায়, ওকালতনামার জন্য আসামিপক্ষ থেকে ৫০০ থেকে ৫ হাজার টাকা আদায় করা হয়। জামিন শুনানির পুটআপ নিতে সংশ্লিষ্ট আদালতের কর্মচারী, পিয়ন, উমেদারদের ৫০ থেকে ১০০ টাকা দিতে হয়। এছাড়া রিলিজ অর্ডার বা মুক্তিনামা কারাগারে পাঠানোর আগে জামিননামা যাচাই করতে পুলিশের জিআর শাখায় দিতে হয় ৫০০ থেকে দুই হাজার টাকা। কারাগার থেকে বের হতে দ্রুত রিলিজ অর্ডার কারাগারে পাঠাতে দিতে হয় এক থেকে দুই হাজার টাকা। আসামির জামিন হওয়ার পর প্রতি মাসে দু-একবার বা আদালত নির্ধারিত তারিখে আসামিকে হাজির হতে হয়। প্রতি হাজিরায় জিআর শাখায় সংশ্লিষ্ট থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশকে ৫০ থেকে ১০০ টাকা বা তারও বেশি দিতে হয়।

অধিকাংশ সময় আইনজীবীরা এসব বকশিশ বা খরচাপাতি নেন সহকারীদের মাধ্যমে। আবার কখনো নিজেরাই নেন।

বিচারপ্রার্থীদের অভিযোগ, দিনের পর দিন এভাবে চললেও আদালতকেন্দ্রিক দুর্নীতি ঠেকানোর কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেই। এ বিষয়ে কোনো নজরদারিও নেই। সবার চোখের সামনেই ঘটছে এসব বকশিশ-বাণিজ্য। যদিও এ ধরনের চর্চা চরম দুর্নীতির বহিঃপ্রকাশ বলে মনে করেন আইনবিদরা।

বিচারপ্রার্থী ভুক্তভোগী মানুষ ন্যায়বিচারের আশায় আদালতে আসেন। অথচ এখানে এসে পদে পদে হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে তাদের। আদালতের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দিতে হচ্ছে বাড়তি টাকা। এ টাকা আমাদের নিতে হচ্ছে মক্কেলের কাছ থেকে। এজন্য মক্কেলের কাছে আমাদের জবাবদিহিও করতে হচ্ছে। আদালতের ইট, বালু ও সিমেন্ট টাকা খায়। আমরা বকশিশ-বাণিজ্যের অবসান চাই। আদালত হচ্ছে ন্যায়বিচারের জায়গা। আমরা সব সময় ন্যায়বিচার চাই।

রাব্বী শেখের অভিজ্ঞতা

রাব্বী শেখ (৩৩)। পেশায় একজন মুদি দোকানি। ভাই রহমতের গ্রেফতারের খবর পেয়ে রাজধানীর রামপুরা থেকে আসেন ঢাকার নিম্ন আদালতে। রহমত মির্জা (২২) বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্সে অধ্যয়নরত। প্রতিবেশীর সঙ্গে মারধরের এক মামলায় গ্রেফতার হয়ে সাতদিন ধরে কারাগারে। রাব্বীর আদালতে আসার উদ্দেশ্য তার ভাই রহমতকে জামিন করানো। এজন্য আদালতে এসে তার পরিচিত আইনজীবী জি এম মিজানুর রহমানের সঙ্গে দেখা করেন। তখন আইনজীবী মিজান তাকে বলেন, ‘আগে মামলার কাগজ তুলতে হবে। এজন্য যেতে হবে আদালতের সাধারণ নিবন্ধন (জিআর) শাখায়। মামলার কাগজ দেখে সিদ্ধান্ত নিতে হবে কীভাবে জামিন করানো যাবে। মামলার কাগজ তুলতে জিআর শাখায় চা-নাস্তা বাবদ কিছু খরচাপাতি দিতে হয়। আপনি চাইলে আমার সঙ্গে যেতে পারেন।’

এরপর রাব্বী আইনজীবীর সঙ্গে যান জিআর শাখায়। সেখানে এক কর্মচারীকে বলেন, রহমতের নামে মারামারির কোনো মামলা আছে কি না। জিআর শাখার ওই কর্মচারী বললেন, এ নামে একটা মারামারির মামলা আছে। আসামি সাতদিন ধরে কারাগারে। তখন আইনজীবী বলেন, এ মামলার এজাহারসহ যাবতীয় কাগজ লাগবে। ওই সময় জিআর শাখার সেই কর্মচারী বলেন, ২০০ টাকা চা-নাস্তা বাবদ খরচাপাতি দিতে হবে। আইনজীবী রাব্বীকে তাদের দাবি মোতাবেক টাকা দিতে বলেন। রাব্বী ২০০ টাকা ওই কর্মচারীর হাতে ধরিয়ে দিয়ে মামলার কাগজ ফটোকপি করে নেন।

মামলার কাগজ দেখে আইনজীবী মিজান বলেন, এ মামলায় জামিন আবেদন করতে হবে। জামিন আবেদন করলে আদালত তার জামিন মঞ্জুর করবেন। এজন্য আগে ওকালতনামা কিনতে হবে। এরপর জামিনের জন্য আবেদন করতে হবে। রাব্বী আইনজীবীর সঙ্গে গিয়ে ওকালতনামা কেনেন। এরপর ওকালতনামাটি তার ভাইয়ের স্বাক্ষরের জন্য আদালতের মাধ্যমে পাঠিয়ে দেন কারাগারে। পরদিন কারাগার থেকে ওকালতনামা স্বাক্ষর হয়ে আসে। আইনজীবী জামিনের আবেদন করলে বিচারক দুদিন পর আসামির উপস্থিতিতে জামিন শুনানির জন্য দিন ধার্য করেন। এদিন রহমতকে আদালতে হাজির করা হয়। তার উপস্থিতিতে জামিন শুনানি করেন আইনজীবী। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষ তার জামিনের বিরোধিতা করে। এসময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন রাব্বী ও তার পরিবার। শুনানি শেষে ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত রহমতের জামিন মঞ্জুর করেন।

আদালত হলো মানুষের বিচার প্রাপ্তির সর্বশেষ স্থান। বিভিন্ন গবেষণায় আদালতের দুর্নীতির বিষয়টি উঠে এসেছে। বর্তমান প্রধান বিচারপতি বিভিন্ন বক্তব্যে বারবার বলেছেন, দুর্নীতি সহ্য করা হবে না। দুর্নীতি আছে বলেই তিনি এসব কথা বলেছেন। বিচারাঙ্গনের সঙ্গে যারা জড়িত, সবারই দুর্নীতির বিষয়টি জানা আছে। দুর্নীতির কারণে বিচারপ্রার্থীরা প্রতিদিন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। অবৈধ লেনদেনের কারণে বিচারের দীর্ঘসূত্রতা বাড়ছে।

এরপর আইনজীবী রাব্বীকে বলেন, জামিননামা কিনতে হবে। এটা কিনে জমা দিতে হবে সংশ্লিষ্ট জিআর শাখায়। রাব্বী আইনজীবীর সঙ্গে গিয়ে জামিননামা কেনেন। আইনজীবী জামিননামাটি পূরণ করে জিআর শাখায় জমা দেন। জিআর শাখার কর্মকর্তা তার কাছে মিষ্টি খাবার জন্য এক হাজার টাকা বকশিশ চান। রাব্বীকে আইনজীবী বলেন, এখানকার নিয়ম এমনই। তাকে বকশিশের টাকা দিয়ে দেন। রাব্বী পকেট থেকে ৭০০ টাকা বের করে দিলে জিআর শাখার মুন্সি চা-পান খাওয়ার জন্য টাকা চান। আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলে তাকেও ১০০ টাকা দেন। রিলিজ অর্ডার বা মুক্তিনামা কারাগারে দ্রুত পাঠানোর জন্য আরও দেড় হাজার টাকা দাবি করেন জিআর শাখার এক কর্মী। রাব্বী নিরুপায় হয়ে আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলে সেখানে এক হাজার টাকা দেন। এরপর রাব্বী আইনজীবীকে বলেন, আপনাকে ফি কত দেবো। আইনজীবী বলেন, সব খরচ আপনি করেছেন। আপনি খুশি হয়ে যা দেন। এরপর রাব্বী আইনজীবীকে ফি দিয়ে চলে যান। ওইদিন রাতে কারাগার থেকে মুক্তি পান রাব্বীর ভাই রহমত।

এ বিষয়ে আইনজীবী জি এম মিজানুর রহমান  বলেন, মামলার প্রতি ধাপে টাকা দিতে হয় সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। টাকা ছাড়া আদালতে কোনো কাগজ পাওয়া যায় না। এ থেকে আমরা পরিত্রাণ চাই। এ ঘুস-বাণিজ্য থেকে পরিত্রাণ চান মক্কেলরাও।

ভুক্তভোগী রাব্বী শেখ বলেন, আদালত হলো ন্যায়বিচারের সর্বশেষ আশ্রয়স্থল। কিন্তু এখানে এসে দেখি উল্টোচিত্র। টাকা ছাড়া কোনো কাজই হয় না আদালতের সেকশনগুলোতে। আমরা সাধারণ মানুষ এ থেকে মুক্তি চাই।

কানাডাপ্রবাসী সামী বকশিশ দিতে দিতেই হয়রান

সিলেটের কানাডা প্রবাসী সামী (৩২) সম্প্রতি দেশে ফিরলে বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশনে তাকে আটকায় পুলিশ। পাঁচ ঘণ্টা বিমানবন্দরে বসিয়ে রাখা হয়। আটকে রাখার কারণ জানতে চাইলে এক কর্মকর্তা সামীকে বলেন, আপনার নামে আদালতে মামলা আছে। আপনি আদালতে গিয়ে খবর নিয়েন। এ কথা শুনে সামীর মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। বিমানবন্দর থেকে বের হয়ে সামী তার পরিচিত আইনজীবী আনোয়ারুল ইসলামকে ফোন করে বিষয়টি জানান।

ওই আইনজীবী তখন সামীকে বলেন, আপনি আদালতে আসেন। আমি বিষয়টির খবর নেবো। সামী আদালতে গিয়ে আইনজীবীর সঙ্গে দেখা করেন। এরপর সংশ্লিষ্ট জিআর শাখায় সামীকে নিয়ে যান আইনজীবী। জিআর শাখায় এক কর্মচারীকে মামলার নম্বর বলেন। কর্মচারী কাগজ বের করে দেন। তখন ওই কর্মচারী কিছু খরচাপাতি দাবি করলে আইনজীবী আনোয়ারুল ২০০ টাকা বের করে দেন। ২০০ টাকা নিতে রাজি না হলে শেষ পর্যন্ত দিতে হয় ৩০০।

এরপর আইনজীবী মামলার কাগজ ফটোকপি করে নিয়ে আসেন এবং সামীর জামিনের জন্য আবেদন করেন। জামিন আবেদনের সময় জিআর শাখায় দিতে হয় আরও ১০০ টাকা। পরদিন জামিন শুনানি করলে আদালত তার জামিন মঞ্জুর করেন। জামিন মঞ্জুর হওয়ার পর জিআর শাখায় জামিননামা জমা দিতে খরচাপাতির নামে সামীর কাছ থেকে নেওয়া হয় ৫০০ টাকা। একইদিন সামীর নামে সিআর আরও একটা মামলার জামিন শুনানি করেন আইনজীবী। শুনানি শেষে আদালত জামিন মঞ্জুর করেন। এ মামলার কাগজ তোলার জন্য আদালতের কর্মচারীকে দিতে হয় দুইশো টাকা আর জামিননামা দাখিলের পেশকারকে চা-নাস্তা বাবদ দিতে হয় পাঁচশো টাকা।

তরুণ আইনজীবী আনোয়ারুল ইসলাম  বলেন, আদালত অঙ্গনে ঘাটে ঘাটে টাকা দিতে হয়। আমরা যারা নতুন আইনজীবী তাদের স্বচ্ছতার সঙ্গে আইন প্র্যাকটিস করা কঠিন হয়ে পড়েছে। ঘাটে ঘাটে টাকা দিয়ে আমাদের তেমন কিছু থাকে না। টাকা না দিলে কাজও হয় না। আদালতে টাকা দিয়ে কাগজপত্র নেওয়া একটা রেওয়াজ হয়ে গেছে। আমরা তরুণ আইনজীবীরা এ থেকে মুক্তি চাই।

ভুক্তভোগী সামী বলেন, আমরা ন্যায়বিচার পেতে আদালতে ছুটে আসি। এখানে কিছু অসাধু লোক দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যাচ্ছেন। তাদের আইনের আওতায় এনে বিচারের জন্য কাঠগড়ায় দাঁড় করানো উচিত। তাহলে দুর্নীতি কিছুটা কমে আসবে।

রাব্বী শেখ ও সামীর মতো এমন অসংখ্য ভুক্তভোগী প্রতিদিন ঢাকার আদালতপাড়ায় আসেন। বকশিশের নামে এভাবেই প্রতিদিন তাদের পকেট কাটা যায়।

জিম্মি আইনজীবীরাও

এভাবে বিভিন্ন জায়গায় খরচাপাতি নেওয়ার যে প্রহসন, এতে খোদ আইনজীবীরাও জিম্মি। অনেক সময় মক্কেলরা তাদের ওপরই চটে যান। এ বিষয়ে আইনজীবী মশিউর রহমান  বলেন, মানুষ ন্যায়বিচার পাওয়ার জন্য আদালতে ছুটে আসেন। এখানে ঘাটে ঘাটে টাকা গুনতে হয়। আমরা এ থেকে মুক্তি চাই।

আরেক আইনজীবী সুমন কর্মকার বলেন, আইন পেশা একটি মহৎ ও সেবামূলক পেশা। এখানে মানুষ সেবা নিতে এসে প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হচ্ছেন। আদালত সংশ্লিষ্টদের বকশিশ দেওয়া রেওয়াজ হয়ে গেছে। আমরা এ বকশিশ-বাণিজ্য থেকে মুক্তি চাই। দুর্নীতিমুক্ত আদালত দেখতে চাই।

বকশিশবাণিজ্য বন্ধে কঠোর নির্দেশনা চান বিচারপ্রার্থীরা

আদালত হলো বিচারের শেষ আশ্রয়স্থল। বিচারের জন্য এসে এভাবে ব্যয়ের বোঝা চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে বিচারপ্রার্থী জামিউল আলম শিহাব  বলেন, দুই বছর আগে থেকে ঢাকার আদালতে আসা-যাওয়া আমার। প্রতারণার অভিযোগে এক ব্যক্তির নামে মামলা করেছি। মামলার প্রতিটি ধাপে আমাকে দিতে হয় বকশিশ। অন্যথায় আদালতের কর্মচারী বা জিআর শাখার কর্মকর্তারা কথা বলতে চান না। বাধ্য হয়ে বকশিশ দেই। এই বকশিশ-বাণিজ্যের একটা সমাধান হওয়া দরকার।

হাসান হাওলাদার নামের এক বিচারপ্রার্থী বলেন, মামলার খবর নিতে গেলে তারা বলেন খরচাপাতি দেন। খরচাপাতি ছাড়া তারা কথাই বলতে চান না। আমরা সাধারণ মানুষ কোথায় যাবো? একদিকে আইনজীবীর ফি অন্যদিকে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চা-নাস্তার খরচ। বকশিশ ছাড়া আদালতে মামলার নথি নড়েই না।

অভিযোগ পেলে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অপরাধ তথ্য ও প্রসিকিউশন বিভাগের ডিসি জাফর হোসেন  বলেন, কেউ অনৈতিক কাজ করলে দায়ও তাকে নিতে হবে। কারও বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ পেলে আমরা আইনগত ব্যবস্থা নেবো।

ঢাকা আইনজীবী সমিতির সভাপতি মাহবুবুর রহমান বলেন, কেউ হয়তো ইচ্ছাকৃতভাবে পারিশ্রমিক দিচ্ছেন বা খুশি হয়ে কিছু দিচ্ছেন। কিন্তু আদালতে অনৈতিক অর্থ লেনদেনের কোনো অভিযোগ শুনিনি। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেব।

বিশেষজ্ঞ মতামত

এ বিষয়ে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ  বলেন, যারা এ ধরনের দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে। জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনলে আদালত অঙ্গন থেকে দুর্নীতি কমে আসবে।

আদালতপাড়ায় ঘাটে ঘাটে বকশিশ দিয়ে বিপাকে মানুষছবি জাগো নিউজ

দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান  বলেন, আদালত হলো মানুষের বিচার প্রাপ্তির সর্বশেষ স্থান। বিভিন্ন গবেষণায় আদালতের দুর্নীতির বিষয়টি উঠে এসেছে। বর্তমান প্রধান বিচারপতি বিভিন্ন বক্তব্যে বারবার বলেছেন, দুর্নীতি সহ্য করা হবে না। দুর্নীতি আছে বলেই তিনি এসব কথা বলেছেন। বিচারাঙ্গনের সঙ্গে যারা জড়িত, সবারই দুর্নীতির বিষয়টি জানা আছে। দুর্নীতির কারণে বিচারপ্রার্থীরা প্রতিদিন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। অবৈধ লেনদেনের কারণে বিচারের দীর্ঘসূত্রতা বাড়ছে।

তিনি বলেন, বিচারাঙ্গনের মধ্যে একটা দুষ্টচক্র দাঁড়িয়ে গেছে, যা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে। প্রধান বিচারপতি যদি দুর্নীতির বিষয়ে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেন তাহলে দুর্নীতি অনেকটা কমে আসবে। যারা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত তাদের চিহ্নিত করে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। জাতীয় শুদ্ধাচার নীতি অনুযায়ী, বিচার বিভাগের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের সবার আয়-ব্যয়ের হিসাব প্রতিনিয়ত হালনাগাদ করতে হবে। তাহলে দুর্নীতির প্রবণতা কমে আসবে।

ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) আব্দুল্লাহ আবু  বলেন, ব্রিটিশ আমল থেকে আদালতপাড়ায় বকশিশের রেওয়াজ। ঘুস হিসেবে নয়, বকশিশ হিসেবে এটা প্রচলিত। খুশি হয়ে অনেকে বকশিশ দেন। চাপ প্রয়োগ করে যারা বকশিশ নেন তারা অন্যায় করেন। তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। নিয়মের বাইরে কেউ নয়। সবাইকে নিয়মের মধ্যে চলতে হবে।

বকশিশবাণিজ্যের বিষয়ে যা বলছেন আইনজীবীরা

ঢাকা আইনজীবী সমিতির সদস্য অ্যাডভোকেট নাজনীন আক্তার বলেন, মামলার কাগজ পাওয়া আমাদের অধিকার। কিন্তু এ অধিকারকে খর্ব করেছেন আদালতের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী। টাকা ছাড়া তারা মামলার কোনো কাগজ দেন না। মামলার এজাহার ফটোকপি নেওয়ার জন্য ২০০ টাকা, চার্জশিটের ফটোকপি নেওয়ার জন্য কমপক্ষে ৩০০ টাকা নেন আদালতের সাধারণ নিবন্ধন শাখার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এছাড়া জিআর মামলায় আসামির জামিননামা দাখিলের সময় ৫০০ থেকে ১০ হাজার টাকা ও সিআর মামলায় ৩০০ টাকা নেন সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এছাড়া আদালতের হাজতখানা ও জেলখানায় ওকালাতনামা স্বাক্ষরের জন্য ৫০ টাকা নেওয়া হয়। জেলখানার দ্রুত রিলিজের আদেশ পাঠাতেও দিতে হয় অতিরিক্ত টাকা। টাকা ছাড়া কোনো কাজ করতে চায় না তারা।

আদালতের নানা ভোগান্তির অবসান চায় সবাইছবি জাগো নিউজ

তিনি আরও বলেন, বিচারপ্রার্থী ভুক্তভোগী মানুষ ন্যায়বিচারের আশায় আদালতে আসেন। অথচ এখানে এসে পদে পদে হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে তাদের। আদালতের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দিতে হচ্ছে বাড়তি টাকা। এ টাকা আমাদের নিতে হচ্ছে মক্কেলের কাছ থেকে। এজন্য মক্কেলের কাছে আমাদের জবাবদিহিও করতে হচ্ছে। আদালতের ইট, বালু ও সিমেন্ট টাকা খায়। আমরা বকশিশ-বাণিজ্যের অবসান চাই। আদালত হচ্ছে ন্যায়বিচারের জায়গা। আমরা সব সময় ন্যায়বিচার চাই।

আইনজীবী মাহবুব হাসান রানা বলেন, আদালতের সাধারণ নিবন্ধন শাখার (জিআর) কর্মকর্তারা বদলি হয়ে কোর্টে আসতে মোটা অঙ্কের টাকা লাগে। এছাড়া প্রতি সাপ্তাহে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে দিতে হয় মোটা অঙ্কের টাকা। পেশকার ও পিয়নদের অনেকে মোটা অঙ্কের টাকা ঘুস দিয়ে চাকরি নেন। চাকরিতে এসে তারা যত দ্রুত সম্ভব ঘুসের টাকা তুলতে দুর্নীতির আশ্রয় নেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা জজ কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট ইস্কান্দার বাপ্পী  বলেন, বকশিশ প্রক্রিয়াটি পুরোপুরি অবৈধ। আইনগতভাবে বকশিশ দেওয়া বা নেওয়ার বিধান নেই। তবুও এ বিষয়টি আদালতপাড়ায় অঘোষিত নিয়মে পরিণত হয়েছে। বাস্তবে দ্রুত সেবা পেতে বিচারপ্রার্থীদের বকশিশ না দিয়েও উপায় থাকে না। সাধারণ প্রক্রিয়ায় একটি মামলার কাগজ তোলা বা জামিননামা দাখিল করতে অনেক সময় লেগে যায়। তখনই বিষয়টি দ্রুত করতে বকশিশ বা কিছু খরচাপাতি গুনতে হয়। বিষয়টি এখন এমন পর্যায়ে গেছে, আদালত অঙ্গনে প্রতিটি ধাপে একটি নির্ধারিত সীমা বেঁধে দিয়েছে কর্মচারী ও আদালত-পুলিশ। ওই সীমার নিচে বকশিশ দেওয়া যায় না। কম দিলে পরবর্তী সময়ে ওই আইনজীবী অন্য কোনো মামলা নিয়ে গেলে তাকে সংশ্লিষ্ট কর্মচারী বা পুলিশ সহযোগিতা করেন না। এক কথায় আদালত-পুলিশ ও কর্মচারীদের হাতে অনেকটা জিম্মি আইনজীবীরা।

আইনজীবী খালিদ হোসেনের অভিযোগ, টাকা ছাড়া আদালত থেকে মামলার কোনো কপি নেওয়া যায় না। এজন্য সংশ্লিষ্ট শাখায় গেলে প্রথমেই খরচাপাতি চাওয়া হয়। খরচাপাতি তাদের মন মতো হলে মামলার নথি বের করে দেন। অন্যথায় ‘পরে আসেন’ বলে আর কথাই বলতে চান না। এখানে বকশিশ দেওয়া নিয়মে পরিণত হয়েছে। অবিলম্বে এ বকশিশ-বাণিজ্যের অবসান হওয়া প্রয়োজন।

 

নিউজটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © gtbnews24.com
Web Site Designed, Developed & Hosted By ALL IT BD 01722461335