শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ০৫:১৯ অপরাহ্ন

হিন্দু সংস্কৃতির জোয়ার এবং বাঙালি মুসলিমের সাংস্কৃতিক সংকট

ফিরোজ মাহবুব কামাল

পূজার সংস্কৃতি বর্ষবরণে

বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গণে বইছে এক নতুন জোয়ার। সেটি প্রতিবছর বর্ষবরণের নামে। এমনটি আগে কখনোই দেখা যায়নি। এটিকে বলা হচ্ছে সার্বজনিন বাঙালি সংস্কৃতি। কোন কিছুকে সার্বজনিন বলার অর্থ, সেটি কোন বিশেষ ধর্মের বা গোষ্ঠির নয়, সেটি সবার। ফলে বর্ষবরণের নামে যা কিছু হচ্ছে -সেটিকে হিন্দু ও মুসলিম উভয়ের সংস্কৃতি রূপে চালিয়ে দেয়া হচ্ছে। আসলে কি সেটি তাই? ঢাক-ঢোল পিটিয়ে উৎসব পালনের যে সাংস্কৃতিক আচার এতো কাল হিন্দুদের পূজা মন্ডপগুলোতে দেখা যেত, এখন সেটি আর মন্দিরে সীমিত নয়, সেটিকে নামিয়ে আনা হয়েছে ঢাকার রাজপথেও। নানা রংয়ের নানা জীব-জন্তুর মূর্তি মাথায় নিয়ে যারা মিছিলে নামে তারাও কোন মন্দিরের হিন্দু পুরোহিত  বা হিন্দু পূজারী নয়। তারা নিজেদের পরিচয় দেয় মুসলিম রূপে। এ চিত্রটি এখন আর শুধু ঢাকা শহরের নয়, সরকারি খরচে সেটিই সারা বাংলাদেশ জুড়ে হচ্ছে। কথা হলো, এতে কি কোন মুসলিম খুশি হতে পারে? যাদের মনে সামান্যতম ঈমান অবশিষ্ট আছে তাদের অন্তরে তো এ নিয়ে বেদনাসিক্ত ক্রন্দন উঠতে বাধ্য। কারণ, এ তো কোন সুস্থ সংস্কৃতি নয়। নির্দোষ কোন উৎসবও নয়। এটি তো মহান আল্লাহতায়ালার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের উৎসব। এটি তো সিরাতাল মুস্তাকীম ছেড়ে জাহান্নামের পথে চলা অসংখ্য মানুষের ঢল। এটি তো পৌত্তলিকদের পূজা মন্ডপ রাজপথে নামানোর মহা-উৎসব। এ উৎসব তো শয়তানের বিজয়ের। এবং সেটি মুসলিমদের রাজস্বের অর্থে। আরো পরিতাপের বিষয়, ইসলামের সংস্কৃতি ও অনুশাসনের বিরুদ্বে এরূপ উদ্ধত শয়তানী বিদ্রোহের পাহারাদারে পরিণত হয়েছে দেশের পুলিশ ও প্রশাসন।

 

প্রশ্ন হলো, যে দেশের অধিকাংশ জনগণ হলো মুসলিম, সে দেশে কি কখনো এরূপ পূজামন্ডপ মাথায় নিয়ে মিছিল হয়? বিশ্বের অন্য কোন মুসলিম দেশে কি সেটি হয়? এ কাজ তো মুরতাদদের। এতে আনন্দ বাড়ে একমাত্র পৌত্তলিক কাফিরদের। জাহান্নামের পথে ছুটে চলা এরূপ অসংখ্য মিছিলে লক্ষ লক্ষ সতীর্থ দেখে পৌত্তলিকদের মনে আনন্দের প্রচণ্ড হিল্লোল উঠবে -সেটিই তো স্বাভাবিক। সে আনন্দেরই প্রকাশ ঘটেছে ২০১৮ সালের ১৫ এপ্রিল কলকাতার আনন্দ বাজার পত্রিকায়। এটি যে হিন্দুর পূজা মন্ডপ নিয়ে মিছিল -তা নিয়ে কোন পৌত্তলিকের সন্দেহ হওয়ার কথা নয়। সন্দেহ হয়নি আনন্দবাজার পত্রিকারও। তাই পত্রিকাটির রিপোর্ট: “কার সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে! কখনও মনে হচ্ছিল কলকাতার কলেজ স্কোয়ার বা একডালিয়ার পুজো মণ্ডপ। কখনও বা শান্তিনিকেতনের বসন্ত উৎসবের চেহারা। তা সে রমনার বটমূলের বৃন্দগানই হোক কিংবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের রাজপথে মঙ্গল শোভাযাত্রা। পুজো, বসন্ত উৎসবের মিলমিশে একাকার ঢাকার নববর্ষের সকাল।”

 

আনন্দ বাজার পত্রিকা রাজপথের একজন অতি উৎসাহীর উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছে,‘‘এটাই এখন আমাদের জাতীয় উৎসব। যেখানেই থাকি ঠিক চলে আসি।’’ প্রশ্ন হলো, এমন পূজার মন্ডপ নিয়ে মিছিল বাঙালি মুসলিমের জাতীয় উৎসব হয় কি করে? কোনটি জাতীয় উৎসব এবং কোনটি নয় -সেটি কে নির্ধারণ করবে? সে ফয়সালা দিবে কি ইসলামবিরোধী এ বিদ্রোহীগণ?  এর পিছনে সরকারের বিনিয়োগ কতখানি সে বর্ণনাও দিয়েছে আনন্দবাজার পত্রিকা। লিখেছে, “হেলিকপ্টার থেকে ফুল ছড়িয়ে শুরু হয়ে গিয়েছে মঙ্গল শোভাযাত্রা। পুলিশ ও স্বেচ্ছাসেবকেরা দড়ির ব্যারিকেড দিয়েও উৎসাহী জনতাকে ঠেকাতে পারছেন না। অষ্টমীর রাতে কলকাতায় যেমন হয়। শোভাযাত্রায় মন্ত্রী-সান্ত্রি সবাই ছিলেন। শোভাযাত্রা ঘিরে থিকথিক করছিল পুলিশ। শুক্রবার রাতে দেখছিলাম রাস্তায় ছেলেমেয়েরা ভিড় করে আলপনা দিচ্ছেন। গাড়ি ঘুরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। যেমনটা এখন পুজোর সময়ে কোনও কোনও রাস্তায় হয়।” এ বিজয় নিশ্চিত হিন্দু সংস্কৃতির। তাতেই আনন্দের হিল্লোল বইছে আনন্দবাজার পত্রিকার রিপোর্টে।

 

পুরা আয়োজন যে ছিল পূজার, সেটি অনেক বাঙালি মুসলিমের নজরে না পড়লেও আনন্দবাজারের হিন্দু সাংবাদিকের নজরে ঠিকই ধরা পড়েছে। তাই তিনি লিখেছেন,“শুধু পুজো নয়, কলকাতার সরস্বতী পুজো, ভ্যালেন্টাইন্স ডের মেজাজও যেন ধরা পড়ল বাংলাদেশের এই নববর্ষে! জাতি-ধর্মের বেড়া ডিঙিয়ে এ যেন সর্বজনীন উৎসব।’’ প্রশ্ন হলো, হিন্দুর পূজা কি কখনো ধর্মের বেড়া ডিঙিয়ে ইসলামের চৌহদ্দিতে প্রবেশ করতে পারে? হিন্দুর পূজা কি মুসলিম সন্তানের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়? অথচ সে চেষ্টাই হচ্ছে জনগণের রাজস্বের অর্থে। সরকারের এজেন্ডা, হিন্দুর সে পূজাকেই বাংলাদেশে সার্বজনীন করা। বাংলাদেশের সরকার যে সে এজেন্ডা নিয়ে বহু কিছু করেছে এবং বহু দূর অগ্রসর হয়েছে, তাতেই আনন্দবাজারের মহা-আনন্দ। সে আনন্দটি মূলত ভারত সরকারেরও। সে ভারতের হিন্দুত্ববাদী হিন্দুদেরও। বাংলাদেশে তো ভারত একটি হিন্দুত্বতোষণের সরকারকেই যুগ যুগ ক্ষমতায় রাখতে চায়। সম্প্রতি আনন্দবাজার একটি নিবন্ধ ছেপেছে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের দূরাবস্থা নিয়ে। কিন্তু সে প্রবন্ধে এ কথাও লিখেছে, বর্তমান সরকার যতই স্বৈরাচারী হোক এর বিকল্প নাই। কারণ, বিরোধী শিবিরে রয়েছে সাম্প্রদায়িক শক্তি। এভাবে আনন্দবাজার পত্রিকাটি ভারত সরকারের মতই নির্লজ্জ ভাবে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে নৃশংস এক ফ্যাসিবাদী সরকারকে। এই হলো তাদের গণতন্ত্র প্রেম। তাদের কথা, গণতন্ত্র কবরে যাক, কবরে যাক নাগরিকদের মৌলিক মানবিক অধিকার, কিন্তু বেঁচে থাক এবং বলবান হোক হিন্দুত্বের সংস্কৃতি।

 

স্ট্রাটেজী: ইসলাম প্রতিরোধের

আনন্দবাজার একই দিনে আরেকটি রিপোর্টে ছেপেছে, সেটি মৌলবাদকে পথে নেমে মোকাবিলা বাংলাদেশে শিরোনামে। তাতে শেখ হাসিনার প্রশংসায় পত্রিকাটি অতি গদগদ। মৌলবাদ চিত্রিত হয়েছে ইসলাম নিয়ে বাঁচার সংস্কৃতি ও তা নিয়ে রাজনীতি। যারা ইসলামের প্রতি সে অঙ্গীকার নিয়ে বাঁচতে চায় তারা চিত্রিত হচ্ছে “অন্ধকার অপশক্তি” রূপে।  তাই তাদের কাছে প্রতিটি ইসলামী দলই হলো অপশক্তি –সেটি যেমন জামায়াতে ইসলামী, তেমনি হেফাজতে ইসলাম। একই অপশক্তির শিবিরে শামিল করা হয়েছে বি.এন.পি’কেও। ইসলামী শক্তির মোকাবেলায় নববর্ষের মতো একটি অনুষ্ঠানকেই হাতিয়ার হিসেবে বেছে নেয়ায় পত্রিকাটি প্রচণ্ড খুশি। লক্ষ্য এখানে বাঙালি মুসলিমদের হিন্দু বানাতে না পারলেও হিন্দুত্বের সংস্কৃতিতে দীক্ষা দেয়া -যাকে বলা হয় সাংস্কৃতিক কনভার্শন। লক্ষ্য, মুসলিম সন্তানদের ইসলাম থেকে দূরে সরানো। তাই তারা নেমেছে সাংস্কৃতিক প্রোগ্রামের ব্যানারে। ইসলাম থেকে দূরে সরানোর প্রজেক্টের সফলতা দেখে আনন্দের জোয়ার ছুটেছে আনন্দবাজারের উক্ত রিপোর্ট। ইসলামের বিশ্বব্যাপী জাগরণের প্রতিরোধে এরূপ উৎসব মূলত আন্তর্জাতিক সোসাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অংশ। ইসলাম বিরোধী এই আন্তর্জাতীক কোয়ালিশন শুধু যে স্ট্রাটেজীক পরিকল্পনা দিচ্ছে তা নয়, সে স্ট্রাটেজীর বাস্তবায়নে বিশ্বের তাবদ কাফির শক্তি শত শত কোটি টাকার অর্থও দিচ্ছে। সরকারি অর্থের পাশাপাশি এ বিদেশী অর্থে বিপুল ভাবে বেড়েছে মিছিলের সংখ্যা ও জৌলুস। মিছিলে মিছিলে ছেয়ে গেছে সমগ্র দেশ।

কথা হলো, আল্লাহর স্মরণকে ভূলিয়ে দেয়ার এর চেয়ে সফল হাতিয়ার আর কি হতে পারে? শয়তান একাজটি নর-নারীদের শুধু মন্দিরের মুর্তির সামনে হাজির করে করেনা, রাজপথের মিছিলে নানা প্রকার মুর্তি নামিয়ে এনেও করে। নানা উৎসবের নামে ঢাকার রাস্তায় তো সেটিই হয়। শেখ হাসিনার সরকার সেসব উৎসবকেই প্রবলতর করছে। এজন্য তার স্লোগান “ধর্ম যার যারা, উৎসব সবার।” এ স্লোগানের ব্যানারে হিন্দুত্বের উৎসবকে বাঙালি মুসলিমদের উৎসবে পরিণত করার ষড়যন্ত্র হচ্ছে। তার এরূপ কাজে একমাত্র শয়তান ও তার অনুসারীগণই খুশি হতে পারে। এতো মহান আল্লাহর স্মরণ ভূলিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্র। অথচ আল্লাহর স্মরণ থেকে এরূপ বিস্মৃত  হওয়ার ভয়ানক শাস্তিটি হলো: তখন শয়তানকে সঙ্গি রূপে বসানো হয় সকল অবাধ্য ব্যক্তিদের ঘাড়ে। যার প্রতিশ্রুতি এসেছে সুরা যুখরুফের ৩৬ নম্বর আয়াতে। শয়তান যাতে ঘাড়ে না চেপে বসে এজন্যই মুসলিমদের সর্বদা মহান আল্লাহতায়ালার স্মরণ বা জিকিরে থাকতে হয়।

ইসলাম থেকে দূরে সরানোর শয়তানী মিশনে শুধু হিন্দুত্ববাদীরা নয়, সে অভিন্ন মিশনে নেমেছে যেমন কাফেরদের অধিকৃত জাতিসংঘ, তেমনি ইউনেস্কো।

নিউজটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © gtbnews24.com
Web Site Designed, Developed & Hosted By ALL IT BD 01722461335