শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ০৭:৫৯ পূর্বাহ্ন

ঢাকা মেডিকেলে করোনার সঙ্গে অন্য চিকিৎসাও চলছে

জিটিবি নিউজঃ করোনা মোকাবিলায় বড় ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। দেশের সবচেয়ে বড় এই হাসপাতাল সাধারণ রোগীর চিকিৎসা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি করোনা চিকিৎসা শুরু করেছে। হাসপাতাল ক্যাম্পাসকে দুই ভাগে পৃথক করে চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছে তারা।

ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ খান আবুল কালাম আজাদ গতকাল শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘অতীতে জাতীয় যেকোনো দুর্যোগে ঢাকা মেডিকেল দেশবাসীর পাশে ছিল। এই মহামারির সময়ে সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে আমরা পেছনে থাকব না।’

ঢাকা মেডিকেল দেশের সবচেয়ে বড় হাসপাতাল। ২ হাজার ৬০০ শয্যার হাসপাতালে রোগী ভর্তি থাকেন প্রায় চার হাজার। প্রতিদিন বহির্বিভাগ চিকিৎসা নেন সাড়ে তিন থেকে চার হাজার মানুষ। জরুরি বিভাগ ৩৬৫ দিন ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে। দরিদ্র মানুষের চিকিৎসার সবচেয়ে বড় ভরসার জায়গা ঢাকা মেডিকেল। সাধারণ রোগের চিকিৎসার পাশাপাশি এখানে বিনা মূল্যে বিশেষায়িত সেবাও পাওয়া যায়। সারা দেশের সবচেয়ে জটিল রোগীদের বড় অংশ এই হাসপাতালেই চিকিৎসা নিতে আসে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসিরউদ্দিন বলেন, ‘আমরাই কোভিড–১৯ রোগীর চিকিৎসায় নেতৃত্ব দেব। সিদ্ধান্তের কারণে আমাদের শুরু করতে কিছুটা বিলম্ব হয়েছে, কিন্তু এখন যুদ্ধে নামার প্রস্তুতি নিয়ে কাজ হচ্ছে। ঝুঁকি আছে জানি, তবে চ্যালেঞ্জটা নিয়েছি।’

ঢাকা মেডিকেলকে করোনা চিকিৎসায় যুক্ত করা হবে কি না, সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে দীর্ঘ সময় নিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। জনবহুল এই হাসপাতালে কোভিড–১৯ চিকিৎসা শুরু হলে সাধারণ রোগীদের চিকিৎসাসেবার কী হবে, সংক্রমণ প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে কি না—এসব বিষয় সামনে চলে আসে। তবে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা গত মাসের মাঝামাঝি প্রথম আলোকে বলেছিলেন, একসঙ্গে বহু করোনা রোগীর চাপ সামাল দিতে হলে ঢাকা মেডিকেলের মতো প্রতিষ্ঠান দরকার। তা ছাড়া যেসব রোগীর করোনার সঙ্গে অন্যান্য রোগ আছে তাঁদের চিকিৎসায় ঢাকা মেডিকেলই উপযুক্ত স্থান।

তবে ইতিমধ্যে এই প্রতিষ্ঠানের ৩০ জন চিকিৎসক, ৮০ জন নার্স ও ২০ জন কর্মচারী করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন বলে কর্তৃপক্ষ প্রথম আলোকে জানিয়েছে।

যেভাবে কাজটি হচ্ছে

ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগের উল্টো দিকে বার্ন ইউনিটে করোনা রোগী ভর্তি করা হচ্ছে ২ মে থেকে। গতকাল রোগী ছিল ১৭১ জন। বার্ন ইউনিটের এই ভবনে যেসব রোগী ছিলেন তাঁদের চানখাঁরপুলের শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের নতুন ভবনে স্থানান্তর করা হয়েছে। গতকাল দুপুর ১২টার দিকে বার্ন ইউনিটে গিয়ে দেখা যায় ব্যানারে লেখা—‘ডেডিকেটেড কোভিড (কোভিড–১৯) হাসপাতাল’। ভেতরে করোনা পরীক্ষার জন্য মানুষ লাইন ধরে দাঁড়িয়ে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্য তিন ফুট ব্যবধানে থাকার বিষয় অনেকেই মানছেন না।

হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসিরউদ্দিন বলেন, ‘পুরোনো বার্ন ইউনিট এবং হাসপাতাল–১ এই দুই জায়গায় কোভিড–১৯ রোগীর চিকিৎসা হবে। আর পুরোনো ভবনের পুরোটাই কোভিড–১৯ নয়—এমন রোগীদের চিকিৎসা হবে।’ তিনি বলেন, সংক্রমণ প্রতিরোধের জন্য নতুন ও পুরোনো ভবনে যাতায়াতের সব রাস্তা বন্ধ করা হবে।

সেবা নিয়ে কয়েকজন করোনা রোগীর অভিযোগের বিষয়ে পরিচালক বলেন, ‘ভুলত্রুটি আছে। এ ব্যাপারে শিখছি। সেগুলো শোধরানোর চেষ্টা চলছে।

কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কোভিড–১৯ রোগীর জন্য ৯০০ শয্যা থাকবে। বার্ন ইউনিটে ৩০০ শয্যা ও হাসপাতাল–২–এ ৬০০ শয্যা। আর পুরোনো ভবনে সাধারণ রোগীর (নন–কোভিড) জন্য থাকবে ১ হাজার ৭০০ শয্যা।

হাসপাতালের পরিচালক জানালেন, এখন বহির্বিভাগে এবং বার্ন ইউনিটে রোগী শনাক্ত করা হচ্ছে। করোনা শনাক্ত হলে তাঁদের ভর্তি করা হচ্ছে। সন্দেহভাজন করোনায় আক্রান্তদের আইসোলেশনে (বিচ্ছিন্নকরণ) রাখা হচ্ছে। আর অন্য রোগীদের সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডে ভর্তি করা হচ্ছে। এখন মূলত যাঁদের জটিল বা জরুরি অস্ত্রোপচার দরকার তাঁদের ভর্তি করা হচ্ছে। জরুরি প্রসূতিসেবা বা দুর্ঘটনার রোগীরা সেবা পাচ্ছেন।

আগুনে পোড়া, বিস্ফোরণে বা বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে আহত রোগীরা শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি হতে পারছেন। ইনস্টিটিউটের সহকারী পরিচালক ও হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক হোসাইন ইমাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের সেবা স্বাভাবিক আছে। প্রতিদিন ৪০ থেকে ৫০ জন নানা ধরনের পোড়া রোগী আসছে। এর মধ্যে ১০ থেকে ১২ জন করে ভর্তি হচ্ছে।’ তিনি জানান, গতকাল ২২৪ জন রোগী ভর্তি ছিলেন। এর মধ্যে এক দিনে নতুন ভর্তি হয়েছেন ১০ জন।

কেন ঢাকা মেডিকেল

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, করোনায় আক্রান্ত ৮০ শতাংশ রোগীর লক্ষণ থাকে মৃদু ও মাঝারি। ১৫ শতাংশের উপসর্গ তীব্রভাবে দেখা দেয়। বাকি ৫ শতাংশের পরিস্থিতি থাকে তীব্র ও জটিল। মূলত জটিল ৫ শতাংশের চিকিৎসার কথা বিবেচনা করে ঢাকা মেডিকেল কলেজকে করোনা চিকিৎসায় যুক্ত করা হয়েছে বলে জানা গেছে।

হাসপাতালের পরিচালক জানান, ‘হাসপাতাল–২–এ হৃদ্‌রোগ, ক্যানসার, কিডনি রোগের বিশেষায়িত চিকিৎসা দেওয়া হয়। এসব রোগের চিকিৎসার সব ধরনের উপকরণ ও আয়োজন সেখানে আছে। এসব রোগে ভোগা ব্যক্তি করোনায় আক্রান্ত হলে আমরা স্বাচ্ছন্দ্যে তাঁদের চিকিৎসা করতে পারব।’

একজন সহযোগী অধ্যাপককে কোভিড–১৯ চিকিৎসার সমন্বয়কারীর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বলে অধ্যক্ষের কার্যালয় থেকে জানানো হয়েছে। তিনি চিকিৎসক, নার্স, ওয়ার্ড বয়ের কাজের সমন্বয় করবেন, পিপিই–মাস্ক সবাই পাচ্ছেন কি না, তা তদারকি করবেন, প্রয়োজনীয় অক্সিজেন সরবরাহ আছে কি না, তা দেখবেন এবং প্রতিদিনের পরিস্থিতির একটি প্রতিবেদন কর্তৃপক্ষকে দেবেন।

কলেজের অধ্যক্ষ খান আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘আমরা নতুন চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলেছি, তাঁদের সাহস জুগিয়েছি, তাঁদের উৎসাহিত করেছি। জ্যেষ্ঠ চিকিৎসকেরা যাতে নতুন চিকিৎসকের সঙ্গে থাকেন, সেটা নিশ্চিত করা হচ্ছে। এটা আমাদের ঐতিহ্য।’

গতকাল করোনা রোগীদের চিকিৎসার পালা সেরে সবে আবাসস্থলে ফিরেছেন মেডিসিন বিভাগের সহকারী রেজিস্ট্রার শুভ্র সৈকত বিশ্বাস। মুঠোফোনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঢাকা মেডিকেলের ঐতিহ্য হচ্ছে রোগীর শয্যার পাশে থেকে সেবা দেওয়া। কোভিড–১৯ রোগীর ক্ষেত্রেও আমরা তা অব্যাহত রেখেছি। সব সাবধানতা মেনে রোগীর শরীরে হাত দিচ্ছি, রোগী ধরে ট্রলিতে তুলছি।’ তিনি আরও বলেন, প্রতিদিন ওয়ার্ড রাউন্ড দেওয়ার সময় হাসপাতালের জ্যেষ্ঠ চিকিৎসকেরা উপস্থিত থাকছেন।

ঢাকা মেডিকেলের উদ্যোগের ব্যাপারে কোভিড–১৯ বিষয়ে সরকার গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির আহ্বায়ক ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের সভাপতি অধ্যাপক মোহাম্মদ সহিদুল্লা প্রথম আলোকে বলেন, ‘এত হতাশার মধ্যে এটা অনেক বড় খবর। ঢাকা মেডিকেল যেসব উদ্যোগ নিয়েছে, তা বাস্তবায়িত হলে করোনা চিকিৎসায় অনেক পরিবর্তন দেখা যাবে বলে আশা করি। আমরা ঢাকা মেডিকেলকে উদাহরণ হিসেবে সব জায়গায় তুলে ধরার চেষ্টা করব।’

নিউজটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © gtbnews24.com
Web Site Designed, Developed & Hosted By ALL IT BD 01722461335