শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৩:৫২ অপরাহ্ন

১১৫৮ কোটির প্রকল্প, অর্ধেক সময় পেরিয়ে বরাদ্দ এসেছে ৮০ কোটি

নিজস্ব প্রতিবেদক: চট্টগ্রামে প্রায় ১৬ হাজার হেক্টর জমিকে চাষাবাদের আওতায় আনাসহ ২৫ কিলোমিটার বাঁধ কাম সড়ক নির্মাণে ১১৫৮ কোটি টাকার প্রকল্প নিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। ৪২ মাস মেয়াদের ‘চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া উপজেলার বন্যা নিয়ন্ত্রণ, নিষ্কাশন ও সেচ’ প্রকল্পটির সময় ২৩ মাস পেরিয়ে গেলেও প্রকল্পে সরকারি বরাদ্দ মিলেছে মাত্র ৮০ কোটি টাকা। একই সঙ্গে প্রকল্পের কাজও হয়েছে মাত্র ১০ শতাংশ। মেয়াদের অর্ধেকের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও মাত্র ৯৪ কোটি টাকার কার্যাদেশ দিতে পেরেছে বাস্তবায়নকারী সংস্থা পানি উন্নয়ন বোর্ড।

অভিযোগ রয়েছে, প্রকল্পের জন্য প্রস্তাবিত জমি অধিগ্রহণ না করেই শুরু হয়েছে প্রকল্পের কাজ। প্রকল্পে মাটি কিনে এনে বাঁধ নির্মাণ করার কথা থাকলেও মানছেন না প্রভাবশালী ঠিকাদাররা। প্রকল্পে বাঁধ নির্মাণের জন্য মাটি কেনার জন্য বরাদ্দ থাকলেও জমি মালিকদের অন্ধকারে রেখে প্রকল্প লাগোয়া তাদের জমির মাটি কেটে নির্মাণ করা হচ্ছে বাঁধ।

অন্যদিকে পাউবো কর্মকর্তারা বলছেন, বাঁধ নির্মাণের জন্য শুষ্ক মৌসুমের প্রয়োজন হয়। এ মৌসুমে আর ৮-১০ দিন কাজ করতে পারবেন। বর্ষা শুরু হলে প্রকল্পের কাজ করা সম্ভব হবে না। তাই ঠিকাদাররা দ্রুত কাজ করতে গিয়ে ‘সামান্য’ ত্রুটি বিচ্যুতি হচ্ছে।

চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার ১৫টি ইউনিয়ন ও পৌরসভার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া শিকলবাহা থেকে চানখালী পর্যন্ত ২৬টি খালের একপাশে এ বাঁধ নির্মাণ এবং ১১টি খালে ৩০ কিলোমিটারের বেশি পুনরায় খননের মাধ্যমে পটিয়া উপজেলাকে বন্যার ক্ষতি থেকে নিরাপদ করার লক্ষ্যে এ প্রকল্পটি নেওয়া হয়। প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে শুষ্ক মৌসুমে প্রায় ৩২শ হেক্টর জমি সেচ সুবিধা পাবে। আবার আকস্মিক বন্যা ও মৌসুমি বন্যা থেকে প্রকল্প এলাকার ১৩ হাজার ২শ হেক্টর জমির ফসল রক্ষা পাবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পটিয়া উপজেলার আশিয়া, কাশিয়াইশ, হাবিলাসদ্বীপ, দক্ষিণ ভূর্ষি, ধলঘাট, বড়লিয়া, জঙ্গলখাইন, ভাটিখাইন, কুসুমপুরা, জিরি, হাইদগাঁও, ছনহরা, কচুয়াই, কেলিশহর ও পটিয়া পৌরসভা জোয়ার ভাটাজনিত জলাবদ্ধতা ও লবণাক্ততা সমস্যায় জর্জরিত। এসব ইউনিয়নের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া খালগুলো ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণে বর্ষাকালে পানি নিষ্কাশন বাধাগ্রস্ত হয়ে সৃষ্ট বন্যায় ব্যাপক ফসলহানি হয়। আবার শুষ্ক মৌসুমে ভূ-পৃষ্ঠস্থ পানি সংকটে কৃষিকাজ ব্যাহত হয়। প্রস্তাবিত প্রকল্পটির মাধ্যমে শিকলবাহা, মুরালী, বোয়ালখালী খালের বামতীর ও চানখালী খালের ডান তীরে বাঁধ নির্মাণ, পানি নিয়ন্ত্রণ ও সেচ কাঠামো নির্মাণ হলে জলাবদ্ধতা ও লবণাক্ততার হাত থেকে বসতবাড়ি, কৃষি জমি ও সরকারি-বেসরকারি নানান স্থাপনা রক্ষা পাবে।

পাউবো সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সালে প্রকল্পটি নেওয়ার প্রস্তাব করা হয়। প্রকল্প প্রস্তাবনা সর্বশেষ তৃতীয় দফায় সংশোধন করে ১ হাজার ১৫৮ কোটি ৩৬ লাখ টাকার প্রকল্পটি অনুমোদন দেয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। প্রকল্পটিতে বাঁধ নির্মাণে প্রায় ৫৯ হেক্টর ভূমি অধিগ্রহণের জন্য ৫৬৩ কোটি ৯৪ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। প্রকল্পের ভৌত কাজের মধ্যে ২৬টি ছোট-বড় খালে নতুন রেগুলেটর, ১১টি খালের মধ্যে প্রায় ৩০ কিলোমিটার পুনরায় খনন, প্রায় সাড়ে ২৫ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ, ৪.১০ কিলোমিটার ফ্লাডওয়াল নির্মাণ করার কাজ চলছে।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বাঁধ নির্মাণে প্রকল্প ব্যয়ের অর্ধেকের বেশি বরাদ্দ রাখা হলেও এখনো কোনো জমি অধিগ্রহণ করা হয়নি। উপরন্তু স্থানীয়ভাবে মৌজা দর বেড়ে যাওয়ায় জমি অধিগ্রহণে নতুন করে হিসাব কষতে হচ্ছে প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের। এরমধ্যে প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়ায় স্থানীয় লোকজনের অভিযোগের কমতি নেই। অনেকে ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসকের কাছে একাধিক অভিযোগও দিয়েছেন। আবার কতিপয় প্রতারক চক্র তাদের জমি না থাকার পরও ঠিকাদার ও প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থাকে চাপে রেখে অনৈতিকভাবে অর্থ আদায়ের লক্ষ্যে মিথ্যা তথ্য দিয়ে আদালতে যাচ্ছেন, জেলা প্রশাসককে অভিযোগ দিচ্ছেন। পরবর্তী সময়ে তদন্তে অনেক অভিযোগের সত্যতা মিলছে না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বেলখাইন এলাকার এক প্রতারক পানি উন্নয়ন বোর্ডের এক প্রকৌশলীর মাধ্যমে ঠিকাদারের কাছ থেকে ১০ লাখ টাকা নিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ওই প্রকৌশলী  বলেন, নানা কায়দায় সুযোগ না পেয়ে ঠিকাদারের কাছ থেকে ১০ লাখ টাকা নিয়ে দেওয়ার জন্য প্রস্তাব দিয়েছিলেন এক ব্যক্তি। আমরা সরেজমিনে গিয়ে দেখেছি, ওই ব্যক্তির নিজের কোনো জমি বাঁধ নির্মাণের জায়গার মধ্যে পড়েনি। শুধু মানসিক চাপে রেখে মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে তিনি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার কৌশল করছিলেন। পরে আমরা আইনের আশ্রয় নেওয়ার কথা বললে ওই ব্যক্তি সরে যান।

মোট ৪৫টি প্যাকেজের মাধ্যমে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এরমধ্যে ২০টি প্যাকেজের কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে। ৬টি বাঁধ নির্মাণ, ৪টি প্যাকেজে খাল পুনঃখনন এবং দুটি প্যাকেজে নদীতীর সংরক্ষণ কাজসহ ১২টি প্যাকেজের কাজ শুরু হয়েছে। কাজ চলমান ১২ প্যাকেজের প্রাক্কলিত ব্যয় ১০৩ কোটি ১৩ লাখ ২৬ হাজার টাকা হলেও ঠিকাদারের সঙ্গে চুক্তির মূল্য নির্ধারিত হয়েছে ৯৪ কোটি ৪ লাখ ৭৬ হাজার টাকা।

এসব নিয়ে চট্টগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী (ডিভিশন-১) শওকত ইবনে শাহীদ  বলেন, চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার চারদিকে বেশ কয়েকটি খাল রয়েছে। বন্যায় জলাবদ্ধতা, শুষ্ক মৌসুমে জোয়ারের সময় লবণাক্ততা, আবার কোথাও পানি সংকটের কারণে চাষাবাদ ব্যাহত হচ্ছে। একটি সমন্বিত প্রকল্পের মাধ্যমে বন্যা নিয়ন্ত্রণসহ শুষ্ক মৌসুমে সেচ সুবিধা দেওয়ার জন্য পুরো উপজেলাকে ঘিরে প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছে। প্রকল্পটি হলে বর্ষাকালে রেগুলেটরের মাধ্যমে অতিরিক্ত পানি প্রবেশ রোধ করা হবে, তেমনি খাল খননের মাধ্যমে শুষ্ক মৌসুমে চাষাবাদের জন্য পর্যাপ্ত পানিসেচের সুযোগ তৈরি হবে।

তিনি বলেন, পুরো প্রকল্পটিতে ১১৫৮ কোটি টাকা ব্যয় নির্ধারণ করা হলেও অর্ধেকের বেশি বরাদ্দ রয়েছে ভূমি অধিগ্রহণে। প্রকল্প এলাকার ১৪ মৌজায় প্রায় ৫৯ হেক্টর জমি অধিগ্রহণের কথা রয়েছে। কিন্তু জমির দাম বেড়ে যাওয়ায় পুরো জমি হয়তো অধিগ্রহণ সম্ভব হবে না। জমি অধিগ্রহণের জন্য সংশোধিত ৫টি প্রস্তাব জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রকল্পে কাজ শুরু হলেও বাঁধ নির্মাণের সময় কারো ব্যক্তি মালিকানার জমি পড়লে, সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ক্ষতিপূরণ পাবেন বলে জানান তিনি।

এ প্রকৌশলী বলেন, প্রকল্পের ৪৫ প্যাকেজের মধ্যে ১২ প্যাকেজের কাজ শুরু হয়েছে। সবগুলো কাজই ঠিকাদার প্রাক্কলিত ব্যয় থেকে ১০ শতাংশ কমে দরপত্র কোট করেছেন। সর্বনিম্ন দর প্রস্তাবকারী ঠিকাদাররাই কাজ পেয়েছেন। বাঁধ নির্মাণ কাজের জন্য মাটি সংগ্রহ থেকে শুরু করে পরিবহন, সবকিছু প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয়ের সঙ্গে উল্লেখ রয়েছে। সেজন্য কোনো ব্যক্তি মালিকের অনুমতি ব্যতিরেকে তাদের জমি থেকে বাঁধ নির্মাণের জন্য মাটি নেওয়ার সুযোগ নেই ঠিকাদারের। প্রয়োজনে তারা জমি মালিকের কাছ থেকে মাটি কিনে নেবেন। আমরা পুরো বাঁধের জন্য ঘনমিটার হিসেবে ঠিকাদারকে বিল পরিশোধ করবো।

তিনি বলেন, পুরো প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে যোগাযোগ অবকাঠামোসহ পানীয় সেচ ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এতে সারা বছর তিন মৌসুমেই ফসল উৎপাদন নিশ্চিত হবে। পাশাপাশি বন্যা নিয়ন্ত্রণ কাজের কারণে মিঠা পানির মাছের চাষ বৃদ্ধি পাবে বলে ধারণা করছেন তিনি। এই প্রকল্পে সাড়ে ১০ শতাংশ অগ্রগতি হয়েছে এবং এ পর্যন্ত ৮০ কোটি টাকা বরাদ্দ পেয়েছেন বলে জানান তিনি।

নিউজটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © gtbnews24.com
Web Site Designed, Developed & Hosted By ALL IT BD 01722461335