বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ০৩:৫৮ অপরাহ্ন

টিউবওয়েলে উঠছে না পানি, সংকট চরমে

নিজস্ব প্রতিবেদক: জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে কক্সবাজারে ক্রমেই নিচে নামছে সুপেয় পানির স্তর। লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় সংকট দেখা দিয়েছে পানযোগ্য পানির। শুষ্ক মৌসুম শুরু না হতেই কক্সবাজারের উপকূল-সমতল সব জায়গায় সুপেয় পানির সংকট প্রকট হচ্ছে। জেলা শহরসহ ৯ উপজেলার ৭২ ইউনিয়নের বেশিরভাগ এলাকায় নিচের দিকে নামছে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর।

জেলার সরকারি প্রায় ৩১ হাজার নলকূপের সোয়া এক হাজার অকেজো হয়ে পড়েছে। পানি উঠছে না আরও প্রায় হাজারখানেক নলকূপে। ভোগান্তি বেড়েছে উখিয়া-টেকনাফের আশ্রয় ক্যাম্পেও।

অনাবৃষ্টি ও বাড়তি তাপমাত্রা এ ভোগান্তির কারণ বলে মনে করছেন কক্সবাজার জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান। ভূ-পৃষ্ঠীয় পানি বা সারফেস ওয়াটারের ব্যবস্থা করা সম্ভব না হলে আগামীতে এ সংকট আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা তার।

কক্সবাজার পৌরসভা ও জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের তথ্যমতে, কক্সবাজার শহরের বিভিন্ন এলাকায় অসংখ্য অগভীর নলকূপ অকেজো হয়ে পড়েছে। কক্সবাজারে সুপেয় পানির স্তর প্রতিবছর ১০ থেকে ১১ ফুট নিচে নামছে। ১০ বছর আগেও শহরের টেকপাড়ায় ১২০ থেকে ১৫০ ফুটের মধ্যে ভূ-গর্ভস্থ সুপেয় পানির স্তর পাওয়া যেতো। অথচ এখন পানির জন্য যেতে হয় ৩০০ ফুটেরও বেশি গভীরে।

গত কয়েক বছরে কক্সবাজার সাগরপাড়ের কলাতলী এলাকায় ভূ-গর্ভস্থ সুপেয় পানির স্তর ১০ থেকে ১৫ ফুট নিচে নেমেছে। ফলে অকেজো হয়ে পড়েছে সাগরপাড়ের তিন শতাধিক আবাসিক হোটেলের অসংখ্য পানির পাম্প। ভূ-গর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছে কক্সবাজার পরিবেশ অধিদপ্তর।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, অপরিকল্পিতভাবে শ্যালো মেশিন দিয়ে পানি তোলা এবং যত্রতত্র পুকুর-খাল-বিল ভরাটের কারণে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। সামনে বৃষ্টিপাত না হলে পরিস্থিতির আরও অবনতি হবে।

জানা গেছে, কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকায় সাধারণত মাটির নিচে ৩০-৩৫ ফুট গভীরে পানির স্তর স্বাভাবিক থাকে। কিন্তু বিভিন্ন এলাকায় পানির স্তর ৫০ থেকে ৬০ ফুটে নেমে গেছে। দীর্ঘদিন বৃষ্টি না হওয়ায় ওইসব এলাকায় পানির প্রাকৃতিক উৎসগুলোও ক্রমেই শূন্য হয়ে পড়ছে। এতে একদিকে গৃহস্থালির কাজে অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে। অন্যদিকে বোরো চাষে পানির সংকটের আশঙ্কা করছেন কৃষকরা।

ভুক্তভোগীরা বলছেন, গ্রীষ্মকাল শুরু না হতেই এবার পানির সংকট দেখা দিয়েছে। অধিকাংশ টিউবওয়েলে পানি উঠছে না। শহরে পানি কিনে পানের সুযোগ থাকলেও গ্রামে সুপেয় পানির জন্য নলকূপই শেষ ভরসা। গ্রামের অনেককেই পানযোগ্য এক কলসি পানি আনতে অনেকদূর পথ পাড়ি দিতে হচ্ছে। তারপরই মিলছে পানি। যারা দীর্ঘ এ পথ পাড়ি দিতে পারছেন না তাদের টাকার বিনিময়ে কিনতে হচ্ছে খাবার পানি।

বাড়িতে তিন পরিবার নিজেদের নলকূপই ব্যবহার করে আসছেন কক্সবাজার সদরের খরুলিয়া কোনারপাড়ার শাহিন রাসেল। কিন্তু দুই সপ্তাহ ধরে তাদের মোটর পানি তুলতে সক্ষম হচ্ছে না। এতে পানি নিয়ে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে বলে জানান গৃহবধূ রুমী।

একই অবস্থা তাদের আশপাশেও। অথচ তাদের বাড়ি থেকে দেড়শ গজ দূরে বয়ে চলেছে কক্সবাজারের মিঠাপানির আধার বাঁকখালী নদী। সুপেয় পানি আনতে কয়েক মাইল দূরে যেতে হচ্ছে এলাকার লোকজনকে। ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় ভুগছেন তারা।

ঈদগাঁওয়ের পশ্চিম ভাদিতলা, কলেজ গেট, পালাকাটা, নতুন মহাল, চৌফলদন্ডী, পোকখালী, গোমাতলী, জালালাবাদ, ইসলামপুর, ইসলামাবাদ, টেকনাফ, উখিয়া, পেকুয়া, চকরিয়া, মহেশখালী, রামু ও কুতুবদিয়ার প্রায় এলাকায় সুপেয় পানির সংকট দেখা দিয়েছে।

ভুক্তভোগীদের মতে, আগে ২০-৩০ মিনিট মোটর চালালেই বাড়ির ছাদের ট্যাংক পূর্ণ হয়ে যেতো। তবে ১৫-২০ দিন ধরে এক-দুই ঘণ্টা মোটর চালালেও প্রয়োজনীয় পানি মিলছে না। এভাবে চলতে গিয়ে নষ্ট হচ্ছে বৈদ্যুতিক মোটর।

কুতুবদিয়ার সমাজকর্মী হাসান মাহমুদ সুজন  বলেন, ‘উপজেলার উত্তর ধুরুং, দক্ষিণ ধুরুং, লেমশীখালী, কৈয়ারবিলসহ বড়ঘোপ ইউনিয়নের প্রায় এলাকার হস্তচালিত টিউবওয়েল থেকে পানি পাওয়া যাচ্ছে না। বিশেষ করে উত্তর ও দক্ষিণ ধুরুং এবং লেমশীখালীর বিভিন্ন এলাকায় এ সমস্যা প্রকট।’

তিনি বলেন, ‘গত বর্ষায় বেড়িবাঁধ ডিঙিয়ে প্লাবিত হয়েছিল পুরো উত্তর ধুরুং ইউনিয়ন। ফলে সেখানকার প্রতিটা বসতভিটার পুকুর লোনাপানিতে তলিয়ে যায়। কিছু পুকুরে সামান্য মিঠা পানি থাকলেও শুকিয়ে যাওয়ায় তা ব্যবহার অনুপযোগী।’

কক্সবাজার সদরের খুরুশকূল এলাকার বেলাল উদ্দিন জানান, বাঁকখালী নদীতীরের এপাশ-ওপাশের কয়েকডজন গ্রামের বিপুল পরিমাণ নলকূপে পানি উঠছে না। কিছু নলকূপে পানি মিললেও তা লবণাক্ত, পান অনুপযোগী। ফলে প্রতিদিন ৪০ থেকে ৫০ টাকা দিয়ে বোতলজাত পানি কিনে খেতে হচ্ছে।

টেকনাফের পরিবেশকর্মী জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘টেকনাফে পাথরমাটি ভেদ করে স্থাপন করা নলকূপের পানিতে মাত্রাতিরিক্ত আয়রন। ফলে লোকজনকে পাহাড়ি ছড়া, ঝরনা ও পাতকুয়ার পানির ওপর নির্ভর করতে হয়। পৌরসভার কায়ুখালীপাড়া, চৌধুরীপাড়া, বাসস্টেশন, পল্লানপাড়া, নাইট্যংপাড়ার লোকজন পাহাড়ি ঝরনার পানি সংগ্রহ করে চাহিদা মেটাচ্ছেন।’

কক্সবাজারের প্রকৃতি ও প্রাণী গবেষক আহমেদ গিয়াস বলেন, ‘অপরিকল্পিত নগরায়নে খোলা জায়গা ও জলাধার কমে যাওয়ায় ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তরে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে পানির এ সংকট দেখা দিয়েছে, যা আমাদের জন্য অশনিসংকেত। এখনই সচেতন না হলে আগামীতে সমস্যা আরও মারাত্মক আকার ধারণ করবে।’

এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘পর্যটন জোনসহ বিভিন্ন এলাকায় অপরিকল্পিতভাবে বোম-মোটর সংযুক্ত গভীর নলকূপ বসানো হচ্ছে। নিয়ম অনুযায়ী দেড় হাজার থেকে দুই হাজার ফুট দূরত্বে একেকটি গভীর নলকূপ স্থাপনের কথা। কিন্তু হোটেলমালিকরা মাত্র ৫০ ফুটের মধ্যেই একাধিক নলকূপ বসিয়েছেন। এছাড়া নির্বিচারে গাছপালা ধ্বংস ও ব্যাপকভাবে পাহাড় কাটায় বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়েছে।’

কক্সবাজার জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান  বলেন, ‘পৃথিবীতে মাত্র ২ দশমিক ৫ শতাংশ মিঠাপানি। এ মিঠাপানির ৩০ দশমিক ১ শতাংশ পানি থাকে ভূ-গর্ভে। বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির পানি মাঠ-ঘাট, রাস্তা, জলাশয় ভেদ করে মাটির নিচে জমা হয় ও সারাবছর আমাদের চাহিদা মেটায়। বালিকণা ভেদ করে মাটির নিচে জমা হয় বলে এ পানি বিশুদ্ধ।’

তিনি বলেন, দুশ্চিন্তার বিষয় হলো দেশে ক্রমাগত ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর দ্রুত নেমে যাচ্ছে। অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে অধিকাংশ এলাকা এখন কংক্রিটের শহর। ফলে মাটি ভেদ করে পানি নিচে পৌঁছাতে পারে না। বৃষ্টির পানি খাল বা নদী-নালায় চলে যাচ্ছে। এতে বর্ষাকালে সামান্য বৃষ্টিতেই বন্যা দেখা দেয়।

সংকট উত্তরণে পরামর্শ দিয়েছেন এ নির্বাহী প্রকৌশলী। তিনি বলেন, ‘বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ, পুকুর-লেক বা নদী বৃদ্ধি করে ভূ-গর্ভস্থ পানির ওপর চাপ কমাতে হবে। অতিমাত্রায় পানি তুললে এ উৎসটি আর নবায়নযোগ্য থাকে না। মেরিন ড্রাইভ সড়কের কলাতলীর দরিয়ানগর ঝরনা, হিমছড়ি ঝরনা, টেকনাফের শীলেরছড়া, দইঙ্গাকাটা পাহাড় বাহিত পানি সংরক্ষণ করে ব্যবহার উপযোগী করলে পানির সংকট কিছুটা হলেও কমিয়ে আনা সম্ভব।’

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পানিসম্পদ প্রকৌশল বিভাগের এক জরিপে বলা হয়েছে, ভূ-গর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনা না হলে প্রতি বছর ১০ মিটার করে পানির স্তর নিচে নেমে যাবে। অথচ সত্তরের দশকে যেখানে ভূ-গর্ভস্থ পানিতল ভূ-পৃষ্ঠ থেকে এক মিটারেরও কম গভীরতায় ছিল, বর্তমানে তা সর্বোচ্চ ৭০ মিটার পর্যন্ত নেমে গেছে।

সম্প্রতি প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাস্তুচ্যুত জনগণের অভিযোজনে জীবনমান উন্নয়ন শীর্ষক এক গবেষণায় উঠে এসেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রা হুমকির মুখে পড়েছে। লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় সুপেয় পানির সংকট দেখা দিয়েছে। গাছপালা ও ফসলি জমি বিলীন এবং কৃষি উৎপাদন কমে যাওয়াসহ জীববৈচিত্র্যে নানা প্রভাব পড়ছে।

 

নিউজটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © gtbnews24.com
Web Site Designed, Developed & Hosted By ALL IT BD 01722461335