বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ০৬:০৮ অপরাহ্ন

বালা তৈরির গ্রাম সখিপুর

নিজস্ব প্রতিবেদক: সাতক্ষীরা শহর থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে দেবহাটা উপজেলার উত্তর সখিপুর গ্রাম। এ গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়িতে গড়ে উঠেছে ছোট ছোট বালা (রুলি) তৈরির কারখানা। বালা তৈরি করে গ্রামের প্রায় প্রতিটি পরিবারই এখন সচ্ছল।

গ্রামের প্রায় সব বাড়িতেই পাকা দালান। বাড়ির সঙ্গে রয়েছে ছোট কারখানা। সকাল হলেই এখানকার কারিগরদের ব্যস্ততা বাড়ে। দেখা যায়, তাদের কেউ ছোট হাতুড়ি দিয়ে পিতলের পাত পিটিয়ে সাইজ করছেন। কেউ সেটি গোলাকার পাইপে পরিণত করছেন। কেউ সেটিতে গালা ভরে গোলাকার বালা তৈরি করছেন।

বাড়ি বাড়ি গিয়ে এসব বালা সংগ্রহ করেন পাইকারি ব্যবসায়ীরা। তবে এখানকার কারিগরদের ভালো সুনাম রয়েছে বালার ওপর নান্দনিক সব ডিজাইন তৈরির কারণে। সম্পূর্ণ হাতে তৈরি ডিজাইন করা এসব বালার চাহিদা রয়েছে দেশজুড়ে।

খোদাই করা নকশার এসব বালা বিক্রি করা হয় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন পাইকারি মার্কেটে। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের হিসাবে, এ গ্রামে প্রতি মাসে প্রায় ৫০ লাখ টাকার বালা বেচাকেনা হয়।

উত্তর সখিপুর গ্রামের বাসিন্দা বালা ডিজাইনার শরিফুল ইসলামের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রায় ১৫ বছর আগে সফিকুল ইসলাম নামে গ্রামের এক যুবক ঢাকায় একটি বালা তৈরির কারখানায় কাজ করতেন। সেখান থেকে গ্রামে ফিরে নিজেই বালা তৈরি শুরু করেন। এলাকার কয়েকজন বেকার যুবক ও নারীদেরও বালা তৈরির কাজ শেখান তিনি। ভালো দাম ও চাহিদা থাকায় একে একে গ্রামের সবাই এ কাজে জড়িয়ে পড়েন। বর্তমানে গ্রামের দুই শতাধিক ছোট ছোট কারখানায় প্রতিদিন গড়ে দুই থেকে তিন হাজার জোড়া বালা তৈরি হয়।

একই গ্রামের সাইফুল সরদার  বলেন, ‘আগে মাছের ব্যবসা করতাম। করোনার সময় বাড়িতে বসে না থেকে বালা তৈরির কাজ শিখেছিলাম। আমার স্ত্রীও এ কাজ করে। মহাজনের কাছ থেকে বালা এনে তাতে শুধু নকশার কাজ করি। বর্তমানে দুজন মিলে দৈনিক ৩০ থেকে ৪০ জোড়া বালায় নকশা করতে পারি। এতে দৈনিক এক থেকে দেড় হাজার টাকা আয় হয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘বাড়িতে বসেই কাজ করে সংসার চালাতে পারছি। এ এলাকার কোনো মানুষ এখন বেকার বসে থাকে না। প্রায় প্রতিটি পরিবারই এ কাজ করে সচ্ছল।’

বালা তৈরির কারিগর আসাদুল ইসলাম  বলেন, ‘আগে বালা তৈরির পর তাতে রং ও পলিশের পর বিক্রি করা হতো। তখন প্রতি জোড়ার দাম ছিল ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। তবে, বর্তমানে রং পলিশ ছাড়াই এখান থেকে তামার শিট কেটে বালা তৈরি ও নকশার কাজ করে ঢাকার পাইকারি দোকানে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা জোড়া বিক্রি করছি। তারা সেখানে রং ও পলিশ করে বেশি দামে বিক্রি করেন।’

তিনি বলেন, ‘বর্তমানে তামার শিটের দাম দ্বিগুণ হয়েছে। তবে আমাদের তৈরি করা বালার দাম বাড়েনি। এ কারণে আগের তুলনায় লাভ কিছুটা কমে গেছে।’

কথা হয় পাইকারি বালা ব্যবসায়ী শহিদুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি  বলেন, ‘তামার শিট কেটে সেটা বালার আকৃতি দিয়ে গালা, ধুনো, ইটের কণা ও সোহাগার সংমিশ্রণে তৈরি গালা দিয়ে ফাঁপা অংশ ভরাট করা হয়। এরপর হাতের নকশাসহ কয়েক দফা কাজ শেষে একেক জোড়া বালা সোনালি রং করে বাজারে বিক্রি করা হয়। দেশের বিভিন্ন এলাকায় এর প্রচুর চাহিদা রয়েছে। তবে আমরা এখান থেকে সরাসরি ঢাকার পাইকারি মার্কেটে বিক্রি করি।’

‘সাতক্ষীরা সীমান্ত এলাকা। এজন্য পণ্য ঢাকায় পাঠানোর সময় বিজিবি ও পুলিশ এটাকে ভারতীয় পণ্য মনে করে আটক করে। এতে আমাদের নানাভাবে হয়রানি হতে হয়। এজন্য বর্তমানে এখানে তৈরি করা বালা ডিজাইনের পর রং না করেই ঢাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। ফলে আমরা পণ্যের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছি,’ যোগ করেন এ পাইকারি ব্যবসায়ী।

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) সাতক্ষীরার উপব্যবস্থাপক গোলাম সাকলাইন  বলেন, সখিপুর গ্রামের মানুষ বালা তৈরির কাজ করে নিজেদের ভাগ্য বদলেছেন। এ পেশায় বর্তমানে দুই শতাধিক পরিবার সরাসরি জড়িত। এখান থেকে প্রতি মাসে প্রায় ৫০ লাখ টাকার বালা বেচাকেনা হয়। বালা তৈরির কারিগররা আগ্রহী হলে বিসিকের পক্ষ থেকে তাদের আধুনিক পণ্য উৎপাদনের প্রশিক্ষণ ও ঋণ দেওয়া হবে।

পাশাপাশি পণ্য মার্কেটিং করার সময় যাতে কেউ হয়রানির শিকার না হন সেজন্য তাদের একটি তালিকা প্রস্তুত করে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের লাইসেন্স দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।

 

নিউজটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © gtbnews24.com
Web Site Designed, Developed & Hosted By ALL IT BD 01722461335