বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ০২:১১ অপরাহ্ন

প্রতিমন্ত্রীর পদ হারিয়ে স্ত্রী-সন্তানদেরও মন ভাঙেন এমপি মুরাদ

নিজস্ব প্রতিবেদক: সময়টা ২০২১ সাল। বছরের একেবারে শেষ দিকে হঠাৎ একটি ফোনকলের অডিও রেকর্ড অন্তর্জালে ভাইরাল হয়। যেখানে এক প্রান্ত থেকে কথা বলতে শোনা যায় তৎকালীন তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসান এমপিকে। অন্য প্রান্ত থেকে ভেসে আসে এক নারীর কণ্ঠ। পরে জানা যায়, ওই নারী ঢাকাই চলচ্চিত্রের একজন জনপ্রিয় চিত্রনায়িকা। এ নিয়ে দেশজুড়ে শোরগোল পড়ে যায়। নানা মহলে শুরু হয় আলোচনা-সমালোচনা। ওঠে বিতর্কের ঝড়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে নারীর প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ, অশালীন ও অবমাননাকর বক্তব্যের জেরে প্রতিমন্ত্রীর পদ ছাড়তে এক প্রকার বাধ্য হন ডা. মুরাদ। এরপর গোপনে বিদেশে পাড়ি জমানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন তিনি।

মন্ত্রিপরিষদ থেকে পদত্যাগ করলেও আলোচনার কেন্দ্রেই ছিলেন সাবেক এ প্রতিমন্ত্রী। সে আলোচনার পালে নতুন হাওয়া লাগে ২০২২ সালের শুরুতে। নায়িকাকে কুরুচিপূর্ণ প্রস্তাব দেওয়ার কিছুদিন পরই তার বিরুদ্ধে ওঠে স্ত্রীকে মারধরের অভিযোগ। এক পর্যায়ে পুলিশের সহায়তা চেয়ে থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন ডা. মুরাদের স্ত্রী ডা. জাহানারা এহসান। তবে পুলিশি প্রতিবেদনে বিষয়টিকে একান্তই পারিবারিক কলহ তথা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কথা কাটাকাটি এবং বাগবিতণ্ডা হিসেবে দেখানো হয়। নায়িকাকাণ্ডে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিতে প্রতিমন্ত্রীর পদ হারানোর পর স্ত্রীর করা অভিযোগ মাথায় নিয়ে কঠিন সময়ই পার করছিলেন ডা. মুরাদ। জানা যায়, এর ফলে তিনি মানসিকভাবেও নাকি তখন কিছুটা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন।

জিডিতে এমপি মুরাদের বিরুদ্ধে নিজের স্ত্রী ও সন্তানদের প্রাণনাশের হুমকি এবং মারধরের যে অভিযোগ আনা হয়েছিল, তদন্তে তার কোনো প্রমাণ পায়নি পুলিশ।

২০২২ সালের ৬ জানুয়ারি সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসানের বিরুদ্ধে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগ এনে রাজধানীর ধানমন্ডি থানায় জিডি করেন তার স্ত্রী ডা. জাহানারা এহসান। একই বছরের ৮ জানুয়ারি ওই জিডির তদন্তের অনুমতি চেয়ে আদালতে পাঠান তদন্ত কর্মকর্তা ধানমন্ডি থানা পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) রাজিব হাসান। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মামুনুর রশিদ তদন্তের নির্দেশ দেন। ওই বছরের ২ জুলাই ঘটনার সত্যতা পাওয়া যায়নি মর্মে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করেন তদন্ত কর্মকর্তা।

তিবেদনে তদন্তকারী কর্মকর্তা উল্লেখ করেন, আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে জিডিটি তদন্ত শুরু করি। জিডির বাদী ডা. জাহানারা এহসান এবং বিবাদী ডা. মুরাদ হাসান সম্পর্কে স্ত্রী-স্বামী। তাদের ১৯ বছরের সংসার জীবনে এক কন্যাসন্তান রামিসা ফারিহা রাজকন্যা (১৬) এবং এক পুত্রসন্তান হাসান আবরার মাহির যুবরাজ (১১) রয়েছে। বিবাদী ডা. মুরাদ বাংলাদেশ সরকারের একজন সংসদ সদস্য এবং সাবেক প্রতিমন্ত্রী। জিডির ঘটনার কিছুদিন আগে তিনি অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু কারণে অনেকটা বাধ্য হয়ে মন্ত্রিপরিষদ থেকে পদত্যাগ করেন, যা ব্যাপকভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং গণমাধ্যমে প্রচার হয়। ফলে তিনি মানসিকভাবেও কিছুটা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন।

কথা কাটাকাটি থেকে প্রচণ্ড বাগবিতণ্ডা
তদন্ত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, নানা কারণে বাদীর মেয়ে রামিসা ফারিহা রাজকন্যার সম্প্রতি তার স্কুলের পরীক্ষার ফলাফল খারাপ হওয়ায় মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে এবং মানসিক নানা জটিলতা তৈরি হওয়ায় তাকে নিয়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হয়। জিডির ঘটনার দিন (২০২২ সালের ৬ জানুয়ারি) বাদী তার মেয়েকে নিয়ে চিকিৎসকের কাছ থেকে বাসায় ফিরে দেখেন, বিবাদী ডা. মুরাদ হাসান তার নিজ কক্ষে ঘুমাচ্ছেন। এ অবস্থায় বিবাদীর রুমের দরজা নক করেন বাদী এবং দরজা খুলতে বলেন। বিবাদী দরজা খুললে বাদী তার উদ্দেশে বলেন, ‘তুমি কি জানো তোমার মেয়ে মানসিকভাবে অসুস্থ এবং তার স্কুলের পরীক্ষায় ফলাফল খারাপ করেছে। এসব কিছুর জন্য তুমিই দায়ী। তোমার কারণে আমাদের মেয়ের এ অবস্থা।’বাদীর এরূপ কথা শুনে বিবাদী প্রতিবাদ করেন এবং তাদের মধ্যে কথা কাটাকাটি শুরু হয়, যা এক পর্যায়ে প্রচণ্ড বাগবিতণ্ডায় রূপ নেয়।

বাসায় থাকেন না এমপি মুরাদ
পুলিশের ওই তদন্ত প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, এক পর্যায়ে বাদী জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ নম্বরে কল করেন। অন্যদিকে বিবাদী তার গাড়িচালককে কল করে গাড়ি রেডি করতে বলেন। ৯৯৯-এ কল পেয়ে ধানমন্ডি মডেল থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর মুহূর্তে বিবাদী তার একটি ব্যক্তিগত লাগেজ নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে যান। পরবর্তীসময়ে বিবাদীর কক্ষে রেখে যাওয়া তিনটি লাইসেন্স করা আগ্নেয়াস্ত্র তার বড় ভাইয়ের মাধ্যমে থানার বেসরকারি অস্ত্রাগারে জমা নেওয়া হয়। ঘটনার দিন থেকে আজও (২০২২ সালের ২ জুলাই) বিবাদী ওই বাসায় বসবাস করেন না।

স্ত্রীসন্তানদের মারধরের কোনো ঘটনা ঘটেনি

সার্বিক তদন্তকালে জিডির ঘটনার বিষয়ে জানা যায়, বাদী ও বিবাদীর (স্ত্রী-স্বামীর) মধ্যে ঘটনার দিন একান্তই পারিবারিক ইস্যুতে কথা কাটাকাটি ও বাগবিতণ্ডা হয়। তবে ওইদিন বিবাদী কর্তৃক বাদী ও তার সন্তানদের হুমকি বা মারধরের জন্য উদ্যত হওয়ার ঘটনা ঘটেনি মর্মে তদন্তে প্রতীয়মান হয়। এটি মূলত একটি পারিবারিক বিষয়। যেখানে জিডিতে বর্ণিত ঘটনা তথা বাদী ও তার সন্তানদের প্রাণনাশের হুমকির ঘটনা প্রমাণের মতো সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

এ বিষয়ে তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই রাজিব হাসান  বলেন, আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে জিডির তদন্ত শুরু করি। তদন্তে জিডিতে বর্ণিত ঘটনা তথা বাদী ও তার সন্তানদের প্রাণনাশের হুমকির ঘটনা প্রমাণের মতো সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া না যাওয়ায় আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করি।

কারণেঅকারণে স্ত্রী সন্তানদের গালিগালাজ করতেন মুরাদ
ডা. জাহানারা এহসান স্বামী মুরাদ হাসানের বিরুদ্ধে যে জিডিটি করেছিলেন সেখানে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগ আনা হয়েছিল। জিডিতে জাহানারা উল্লেখ করেন, বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছি ১৯ বছর। বিবাহিত জীবনে আমাদের সংসারে এক মেয়ে ও এক ছেলে সন্তান রয়েছে। বিবাদী আমার স্বামী। তিনি বর্তমান সরকারের সংসদ সদস্য এবং সাবেক প্রতিমন্ত্রী। সম্প্রতি তিনি কারণে-অকারণে আমাকে ও সন্তানদের অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ এবং শারীরিক-মানসিকভাবে নির্যাতন করে আসছেন। হত্যার হুমকিও দিচ্ছেন। ২০২২ সালের ৬ জানুয়ারি আনুমানিক ২টা ৪৫ মিনিটের দিকে আগের মতো আমাকে ও আমার সন্তানদের গালিগালাজ করেন এবং মারধর করতে উদ্যত হন। আমি ৯৯৯ নম্বরে কল করি। পরে ধানমন্ডি থানা পুলিশ বাসার ঠিকানায় পৌঁছালে বিবাদী বাসা থেকে বের হয়ে যান। এ অবস্থায় আমি নিরাপত্তাহীনতায় আছি। বিবাদী আমার এবং আমার সন্তানদের যে কোনো সময় ক্ষতি করতে পারেন।

এর আগে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ নম্বরে ফোন করে পুলিশের সহযোগিতা চান ডা. জাহানারা এহসান। পরে তিনি এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগ দিতে থানায় যান।

মুরাদকে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগের নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী
এক নারীর সঙ্গে আপত্তিকর ও বিতর্কিত কথোপকথনের একটি অডিও কল রেকর্ড এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার দেওয়া অসৌজন্যমূলক বক্তব্য ছড়িয়ে পড়লে ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসেন তৎকালীন তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসান। ২০২১ সালের শেষ দিকের এ ঘটনা নিয়ে সব মহলে সমালোচনা শুরু হলে ডা. মুরাদকে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগের নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী।

আলোচনা-সমালোচনার একপর্যায়ে ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন ডা. মুরাদ। পদত্যাগের পর তিনি কানাডায় পাড়ি জমানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। পরে সেখান থেকে দুবাইগামী একটি ফ্লাইটে ফেরত পাঠানো হয় তাকে। দুবাইয়ে ঢুকতে না পেরে অবশেষে দেশে ফেরেন তিনি।

 

নিউজটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © gtbnews24.com
Web Site Designed, Developed & Hosted By ALL IT BD 01722461335