শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০১:৫২ অপরাহ্ন

মাউশি ঢাকা এ যেন ঘুসের হাট-বাজার!

নিজস্ব প্রতিবেদক: মিরপুরের দারুস সালাম রোডে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) ঢাকা আঞ্চলিক পরিচালক ও উপ-পরিচালকের কার্যালয়। ঢাকা জেলা শিক্ষা অফিসারের দপ্তরও এখানে। ‘এমপিওভুক্তি সামনে রেখে উপ-পরিচালকের কার্যালয়ে ঘুসের হাট বসে’- এমন অভিযোগ দীর্ঘদিনের। বৃহস্পতিবার (২৩ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে সেবাপ্রত্যাশী বেশে কার্যালয়ে গেলে বেরিয়ে আসে এর সত্যতা।

উপ-পরিচালকের কার্যালয়ে ঢোকার আগেই সিঁড়ির বাম পাশ থেকে বেরিয়ে এলেন এক নারী। জানতে চাইলেন আগমনের কারণ। গোপালগঞ্জ জেলার সদরের একজন স্কুলশিক্ষিকার আট বছর পূর্ণ হওয়ায় উচ্চতর গ্রেডের এমপিও আবেদন নিষ্পত্তি করার কাজের কথা বলা হলে পাঁচ হাজার টাকা ঘুস চান। দর কষাকষির পর রাজি হন তিন হাজার টাকায়। টাকা দিতে বলেন কাগজে মুড়িয়ে।

এরপর বেশ কিছুক্ষণ সেখানে অবস্থান করলে আরও অনেক মানুষের কাছ থেকে টাকা আদায় করতে দেখা যায়। ঘুস লেনদেনের বেশকিছু অডিও-ভিডিও রেকর্ড রয়েছে জাগো নিউজের কাছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, ভবনটির তৃতীয় তলায় সিঁড়ির বাম পাশে পর্দা ঝুলানো একটি রুম। কেউ উপ-পরিচালকের কার্যালয়ের চৌহদ্দিতে ঢুকলে রাবেয়া সুলতানা নামে একজন এগিয়ে আসেন। কথাবার্তার এক পর্যায়ে কাউকে নিয়ে যান পর্দা ঘেরা রুমে, কাউকে ছাদে। উদ্দেশ্য দর কষাকষি করে ঘুস আদায়। এমনকি তিনতলার খোলা বারান্দায়ও টাকা নেন তিনি। সিঁড়ির ডান দিকে ভেতরে উপ-পরিচালকের দপ্তর। উচ্চপর্যায়ের রেফারেন্স ছাড়া সেই পর্যন্ত পৌঁছানো সম্ভব হয় না কারোরই। কেউ যদি যাওয়ার চেষ্টা করেন সেখানে তিন-চারজন কর্মচারীর জেরার মুখে পড়তে হয়।

জানা যায়, শুধু ঢাকা নয়, মাউশির নয়টি আঞ্চলিক কার্যালয়েই একইভাবে ঘুস লেনদেনের অভিযোগ আছে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নিযুক্ত নির্দিষ্ট ‘কালেক্টর’ আছেন। তারা টাকা তুলে পৌঁছে দেন কর্তাব্যক্তির কাছে। ঢাকা অঞ্চলে এই বেপরোয়া ঘুস লেনদেনের অভিযোগে সালমা বেগম নামে সম্প্রতি এক কর্মচারীকে ঢাকার বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুননেছা মুজিব মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বদলি করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে ফরিদপুরের এক ইবতেদায়ি মাদরাসায় চারজন প্রধান শিক্ষক আর দুজনকে দাখিল মাদরাসার শিক্ষকের সমান গ্রেডের বেতন পাস করানোর অভিযোগ ওঠে। অথচ এ ধরনের একটি প্রতিষ্ঠানে প্রধান শিক্ষক থাকেন একজন। আর দাখিল মাদরাসার শিক্ষকের গ্রেডে বেতন পাওয়ার সুযোগ নেই।

শুধু তাই নয়, রাজধানীর শ্যামপুরে অবস্থিত বাংলাদেশ ব্যাংক উচ্চ বিদ্যালয়ের ছয় শিক্ষকের বিধিবহির্ভূত

জাগো নিউজের অনুসন্ধানে জানা যায়, ছদ্মবেশী এই প্রতিবেদকের কাছ থেকে ঘুস নেওয়া রাবেয়া সুলতানা ওই দপ্তরের উচ্চমান সহকারী। তিনি বিগত ১২ বছর ধরে একই কর্মস্থলে আছেন। ঢাকা অঞ্চলের আওতাধীন দেশের ১১টি জেলার শিক্ষক-কর্মচারীরা এ অফিসে আসেন তাদের এমপিওভুক্তি, উচ্চতর স্কেল পরিবর্তন, বকেয়া বেতন আদায়, নাম ও জন্মতারিখ সংশোধনসহ নানা কাজে। শিক্ষক-কর্মচারীদের কাজের ধরন বুঝে নির্ধারিত অর্থের ঘুস নিয়ে কাজ করা হয়। আবার মোটা অংকের অর্থ দিয়ে অবৈধ কাজ করা হয় বৈধ।

সূত্র জানায়, শিক্ষক এপিওভুক্তিতে সব কাগজপত্র ঠিক থাকলে ১০ হাজার টাকা। কাগজ ঠিক না থাকলে ৫০ হাজার টাকা নেওয়া হয়। কর্মচারীর এমপিওভুক্তির ক্ষেত্রে পাঁচ হাজার থেকে ২০ হাজার, উচ্চতর স্কেল পেতে তিন থেকে পাঁচ হাজার, শিক্ষক-কর্মচারীর বকেয়া বেতন পেতে পাঁচ হাজার থেকে ১৫ হাজার এবং নাম ও জন্মতারিখ সংশোধনের ক্ষেত্রে পাঁচ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা নেওয়া হচ্ছে।

প্রতি বিজোড় মাসে এমপিওভুক্তির সভা হয় মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরে। সেসব আবেদন অনুমোদন হওয়ার পর সেগুলো ছাড়পত্র দিতে জেলাভিত্তিক নিজ নিজ অঞ্চলে পাঠানো হয়। এসব আবেদন ছাড়পত্র পেতে মাসের ১-১২ তারিখ পর্যন্ত চলে মোটা অংকের লেনদেন।

সূত্র জানায়, চলতি সার্কেলে প্রায় তিন হাজার এমপিওভুক্তির আবেদন জমা পড়েছে। বছরে মোট ছয় সার্কেলে এমন কমবেশি আবেদন জমা হয়। এর মধ্যে অর্ধেক আবেদনই ঘুস ছাড়া নিষ্পত্তি হয় না।

বৃহস্পতিবার (২৩ ফেব্রুয়ারি) নারায়ণগঞ্জ পাগলা হাইস্কুলের সিনিয়র দুজন শিক্ষক আসেন তাদের স্কুলের ১৪ জনের এমপিওভুক্তির কাজে। এ সময় উচ্চমান সহকারী রাবেয়া সুলতানা তাদের তৃতীয়তলার একাংশের খোলা ছাদে নিয়ে যান। একজন শিক্ষক তাদের আবেদনকারীদের নাম, আবেদনের দিন, বিষয়সহ কিছু তথ্য একটি ছোট কাগজে লিখে রাবেয়ার হাতে তুলে দেন। এরপর তাদের মধ্যে দর কষাকষি শুরু হয়। এক পর্যায়ে রাবেয়ার হাতে ৫শ টাকার বেশ কিছু নোট তুলে দিতে দেখা যায়। আগামী সপ্তাহে কাজ হয়ে যাবে বলে আশ্বস্ত করে তাদের চলে যেতে বলেন।

এ দুজন জেলা শিক্ষা অফিস থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় তাদের মধ্যে মশিউর রহমান নামে একজন শিক্ষকের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, টাকা ছাড়া এ অফিসে কোনো কাজ হয় না। আপনি সঠিক ব্যক্তির কাছে গেছেন। ‘আমি তো গোপালগঞ্জের মানুষ’- এমন কথা শোনালে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলে দিলেও তারা (ঢাকা শিক্ষা অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারী) টাকা ছাড়া কাজ করবে না। কাজ করাতে চাইলে যা চেয়েছে দিয়ে যান। নইলে নানান ত্রুটি ধরবে।

এক সপ্তাহ ধরে মাউশির ঢাকা অঞ্চলের উপ-পরিচালকের অফিসে ঘুরে জানা যায়, প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে অফিস সেবাপ্রত্যাশীদের কাছে কাজের ধরন অনুযায়ী ঘুস আদায় করা হয়। যারা আবেদনের সঙ্গে টাকা দেন তাদের কাজ হয়। টাকা দেওয়া না হলে আবেদন টেবিলে ফেলে রাখা হয়। সেবাপ্রত্যশীদের তৃতীয় তলায় প্রবেশমুখে কয়েকটি চেয়ারে বসিয়ে রাখা হয়। একজন একজন করে ডেকে কাজ অনুযায়ী নেওয়া হয় টাকা। কাউকে উপ-পরিচালকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে দেওয়া হয় না।

অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, রাবেয়া ঢাকা অঞ্চল উপ-পরিচালকের অফিসে উচ্চমান সহকারী হিসেবে এক যুগ ধরে রয়েছেন। বর্তমানে তিনি উপ-পরিচালক এ এম আব্দুল খালেকের পিএ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তার সঙ্গে মোতালেব নামে একজন অফিস সহকারী টাকা লেনদেনে সহায়তা করেন। দিন শেষে এ অর্থ উপ-পরিচালক এএসএম আব্দুল খালেককে একটি অংশ দিয়ে বাকিটা এ সিন্ডিকেটের সদস্যরা ভাগাভাগি করে নেন।

রোববার (২৬ ফেব্রুয়ারি) রাতে সাংবাদিক পরিচয়ে এমন অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে রাবেয়া সুলতানা প্রথমে অভিযোগ অস্বীকার করেন। পরে  বলেন, অনেকে বিভিন্ন বিষয়ে জানতে চাইলে তাদের সহযোগিতা করা হয়। তাদের কেউ কেউ টাকা দিয়ে যায়। সবার কাছ থেকে টাকা নেওয়া হয় না।

প্রতিবেদক নিজেই তাকে সেবাপ্রত্যাশী বেশে ঘুস দিয়েছেন উল্লেখ করলে রাবেয়া বলেন, প্রতিষ্ঠান কীভাবে চলবে তা উপ-পরিচালক ঠিক করে দেন। তিনি যেভাবে বলেন সেভাবে আমাদের চলতে হয়।

এসময় তিনি প্রতিবেদন না করার জন্য অনুরোধ জানান। এজন্য তিনি বারবার দেখা করতে বলেন এবং উল্টো অর্থের প্রলোভন দেখান। এ সংক্রান্ত তথ্য-প্রমাণাদি রয়েছে জাগো নিউজের কাছে।

গত এক সপ্তাহে মাউশি ঘুরে দেখা যায়, উচ্চমান সহকারী রাবেয়া দুপুর ২টার পর অফিস থেকে উধাও হয়ে যান। এ সময় তিনি নির্ধারিত স্থানে গিয়ে উপ-পরিচালকের ভাগের টাকা বুঝিয়ে দিয়ে আসেন।

উপ-পরিচালক আব্দুল খালেক ২০১৮ সালে ময়মনসিংহ অঞ্চলে একই পদে দায়িত্বে ছিলেন। এসময় এমপিও খাতে গোয়েন্দা সংস্থার একটি তদন্তে ৮৬ জনের তালিকা করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হয়। সেই তালিকায় খালেকের নাম উঠে আসে। এরপর রহস্যজনকভাবে তাকে খুলনা অঞ্চলের উপ-পরিচালকের দায়িত্বে বসানো হয়। ২০২৩ সালের ২৪ জানুয়ারি তাকে ঢাকা অঞ্চলের উপ-পরিচালক হিসেবে পদায়ন করা হয়।

এসব বিষয়ে উপ-পরিচালক আব্দুল খালেকের কাছে জানতে চাইলে তিনি  বলেন, আমি নতুন এসেছি। কে কী করছে, কার কাছে কে টাকা নিচ্ছে, সেটি জানা নেই। খোঁজ নেওয়া হবে।

প্রতিদিন সেবাপ্রত্যাশীদের কাছ থেকে আদায় করা অর্থ আদায় করা হচ্ছে এমন প্রমাণ আছে- এ কথার জবাবে তিনি বলেন, যারা টাকা তুলছে তাদের গিয়ে ধরেন। আমাকে বলে কোনো লাভ নেই। আপনাদের জন্য কী করতে পারি সেটা বলেন।

অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, এই উপ-পরিচালক ময়মনসিংহ থাকাকালে তার স্কুল শিক্ষিকা স্ত্রীকে নিজের দপ্তরে হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার পদে বদলি করিয়ে নেন। এরপর স্বামী-স্ত্রী মিলে ওই অফিসে রামরাজত্ব কায়েম করেন। ওই দপ্তরের তৎকালীন পরিচালক অধ্যাপক আ. মোতালেব এ বিষয়ে মাউশির প্রধান কার্যালয়ে লিখিত অভিযোগ করেছিলেন। এরপরই তাকে বদলি করে দেওয়া হয়।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মাউশি মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ  বলেন, নয়টি আঞ্চলিক কার্যালয়ের মাধ্যমে বর্তমানে এমপিও সংক্রান্ত বিভিন্ন কাজ সম্পন্ন করা হচ্ছে। আগে ঢাকায় প্রধান কার্যালয়ে এই কাজ হতো। তখন সারাদেশ থেকে রাজধানীতে আসা-যাওয়ার খরচ ও ভোগান্তি হতো। এছাড়া এমপিও ছাড় নিয়ে নানা ধরনের ছিল অভিযোগ। যেসব থেকে মুক্তি দিতে অনলাইনে এমপিওভুক্তির কাজ শুরু করা হয়। আর এটা নিষ্পত্তির চূড়ান্ত এখতিয়ার দেওয়া হয় আঞ্চলিক উপ-পরিচালক ও পরিচালককে।

‘কিন্তু বিভিন্ন অঞ্চলের বিরুদ্ধে এ নিয়ে অর্থ লেনদেন আর হয়রানির অভিযোগ আসছে। প্রমাণের অভাবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে চূড়ান্ত ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না। তবে কারও বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে বদলিসহ অন্য ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এ ব্যাপারে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। সম্প্রতি ঢাকা অঞ্চলের এক কর্মচারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়ার পর তাকে বদলি করে দেওয়া হয়েছে।’

 

নিউজটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © gtbnews24.com
Web Site Designed, Developed & Hosted By ALL IT BD 01722461335