বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১১:৪৮ অপরাহ্ন

ক্রেতা সংকটে শেয়ারবাজার, নিঃস্ব হচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা

নিজস্ব প্রতিবেদক: চরম ক্রেতা সংকট দেখা দিয়েছে দেশের শেয়ারবাজারে। প্রতিদিন ক্রেতাশূন্য অবস্থায় পড়ে থাকছে অর্ধেকের বেশি প্রতিষ্ঠান। এতে ঘটছে টানা দরপতন। সেই সঙ্গে চলছে লেনদেন খরা। শেয়ারবাজারের এমন করুণ দশা দেখে রাস্তার নেমে প্রতিবাদ জানাতে বাধ্য হয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপিও দিয়েছেন তারা।

কয়েক মাস ধরেই শেয়ারবাজারে বিরাজ করছে ক্রেতা সংকট। তবে সম্প্রতি সেই অবস্থা প্রকট হয়ে উঠেছে। এতে ধারাবাহিকভাবে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দাম কমার পাশাপাশি কমেছে মূল্যসূচক। আর লেনদেন কমতে কমতে ঠেকেছে তলানিতে।

গত কয়েক কার্যদিবসের মতো রোববারও (২৬ ফেব্রুয়ারি) শেয়ারবাজারে চরম ক্রেতা সংকট ছিল। এদিন লেনদেনের একপর্যায়ে প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) ২২৩ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের ক্রেতাশূন্য হয়ে পড়ে। লেনদেনের শেষ পর্যায়েও এসব প্রতিষ্ঠানের ক্রেতার ঘর শূন্যই থাকে।

ক্রেতাশূন্য হয়ে পড়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ফ্লোর প্রাইসে (সর্বনিম্ন দাম) আটকে রয়েছে ১১৯টি। ফ্লোর প্রাইসে এসব প্রতিষ্ঠানের বিপুল পরিমাণ শেয়ার ও ইউনিট বিক্রির আদেশ আসে। অন্যদিকে শূন্য পড়ে থাকে ক্রয় আদেশের পর।

আর ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ১০৪টির শেয়ার ও ইউনিট ক্রেতাশূন্য হয়ে পড়ে। দিনের সর্বনিম্ন দামে এসব প্রতিষ্ঠানের বিপুল পরিমাণ শেয়ার ও ইউনিট বিক্রির আদেশ আসে এবং শূন্য হয়ে পড়ে ক্রয় আদেশের ঘর।

এটি শুধু রোববারের চিত্র নয়। শেয়ারবাজারে ক্রেতা সংকট অবস্থা এখন নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিদিনই তালিকাভুক্ত অর্ধেকের বেশি প্রতিষ্ঠানের ক্রয় আদেশের ঘর শূন্য থাকছে। ফলে যেসব বিনিয়োগকারীর কাছে এসব প্রতিষ্ঠানের শেয়ার আছে তারা তা বিক্রির চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছেন।

বিনিয়োগকারীদের আস্থা সংকটের কারণে শেয়ারবাজারে এমন ক্রেতা সংকট ও লেনদেন খরা দেখা দিয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলেছেন, দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি এক ধরনের চাপের মধ্যে রয়েছে। রিজার্ভ কমে যাচ্ছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি কম হওয়ার পূর্বাভাস দিচ্ছে। সবকিছু মিলে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এক ধরনের অনাস্থা সৃষ্টি হয়েছে। যে কারণে শেয়ারবাজারে এ মন্দাভাব দেখা যাচ্ছে।

তারা আরও বলছেন, শেয়ারবাজারের এমন পরিস্থিতিতে বিনিয়োগকারীদের ধৈর্য ধারণ করতে হবে। অহেতুক বিক্রির চাপ না বাড়িয়ে শেয়ার ধরে রাখার মানসিকতা থাকতে হবে। বিনোদকারীরা বিক্রির চাপ কমালে বাজার ঘুরে দাঁড়াতে পারে।

এদিকে শেয়ারবাজারে টানা দরপতন ও লেনদেন খরা দেখা দেওয়ায় মতিঝিলের রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ জানিয়েছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। ১২ দফা দাবি জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছেন তারা। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের পক্ষে ‘বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদ’ এ স্মারকলিপি দিয়েছে।

পুঁজিবাজার গভীর ষড়যন্ত্রের শিকার উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনিয়ম ও দুর্নীতিমুক্ত স্মার্ট পুঁজিবাজার গঠনের দাবি জানানো হয়েছে স্মারকলিপিতে। সেই সঙ্গে অপ্রদর্শিত আয় বিনাশর্তে ৫ শতাংশ কর দিয়ে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়ার দাবি জানানো হয়েছে।

এছাড়া স্বল্পসুদে বিনিয়োগকারীদের ঋণ দেওয়ার জন্য ১০ হাজার কোটি টাকার বিশেষ তহবিল গঠনের দাবি জানানো হয়েছে। পাশাপাশি লভ্যাংশের ওপর সম্পূর্ণভাবে ট্যাক্স প্রত্যাহার করা, তালিকাভুক্ত কোম্পানি এবং অ-তালিকাভুক্ত কোম্পানির করহারের পার্থক্য ১৫ শতাংশ করার দাবি জানানো হয়েছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক  বলেন, ‘শেয়ারবাজারের বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের সাধারণ বিনিয়োগকারীরা প্রতিনিয়ত পুঁজি হারাচ্ছেন। একটু একটু করে পুঁজি হারিয়ে তারা নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছেন। এর প্রতিবাদে আমরা ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের আগের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছি। সেই সঙ্গে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের রক্ষায় নিরুপায় হয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছ স্মারকলিপি দিয়েছি।’

তিনি বলেন, ‘কয়েক মাস ধরেই শেয়ারবাজারে টানা দরপতন চলছে। দর পতনের জন্য একেক সময় একেক ইস্যু সামনে আনা হচ্ছে। কিন্তু আমরা মনে করি শেয়ারবাজারে এখন যে দরপতন হচ্ছে এটা যুক্তিসঙ্গত না। সম্প্রতি রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ছে। আইএমএফ থেকে ঋণ সহায়তাও পেয়েছি। তাই আমরা মনে করি ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে শেয়ারবাজারে দরপতন ঘটানো হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রীই আমাদের সাধারণ বিনিয়োগকারীদের রক্ষা করতে পারেন। সেজন্য প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছি।’

এদিকে শেয়ারবাজারে টানা দরপতন দেখা দিলে গত বছরের ২৮ জুলাই প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দামে ফ্লোর প্রাইস বেধে দেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। এরপর লেনদেন খরা দেখা দিলে মূল্যসূচকে কম প্রভাব রাখা ১৬৯টি প্রতিষ্ঠানের ফ্লোর প্রাইস গত ডিসেম্বরে তুলে নেওয়া হয়। তবে দাম কমার সর্বনিম্ন সীমা বেধে দেওয়া হয় এক শতাংশ।

এতে কিছুদিন দর পতনের পর ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়া বেশকিছু প্রতিষ্ঠানের শেয়ার দাম বাড়তে দেখা যায়। সেই সঙ্গে বাড়ে লেনদেনের গতি। তবে এখন আবার এসব প্রতিষ্ঠানের শেয়ার দাম কমতে দেখা যাচ্ছে এবং প্রতিদিন দিনের সর্বনিম্ন দামে বিপুল শেয়ার বিক্রির আদেশ আসছে।

মিজানুর রশিদ নামের এক বিনিয়োগকারী বলেন, ‘আমার কাছে আটটি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিট আছে। এর মধ্যে পাঁচটির দাম কয়েক মাস ধরেই ফ্লোর প্রাইসে আটকে আছে। প্রতিদিন ফ্লোর প্রাইসে এগুলো বিক্রির চেষ্টা করি, কিন্তু ক্রেতা না থাকায় বিক্রি হয় না। আর ফ্লোর প্রাইসের বাইরে থাকা তিনটি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার দাম প্রতিদিন প্রায় এক শতাংশ করে কমছে। এভাবে প্রতিদিন একটু একটু করে বিনিয়োগ করা পুঁজি হারাচ্ছি।’

তিনি বলেন, ‘আমার মতো হাজারো বিনিয়োগকারী শেয়ারবাজারের বর্তমান পরিস্থিতিতে হতাশায় নিমজ্জিত হয়েছেন। অনেকে শেয়ারবাজার ছাড়ার পরিকল্পনা করছেন। কিন্তু বাজার ভালো করতে সংশ্লিষ্টদের দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যাচ্ছে না। অথচ যখন শেয়ার দাম বাড়ে তখন কত ধরনের কোয়ারিজ (প্রশ্ন) দেওয়া হয়। এখন টানা দরপতন হচ্ছে এটা যেন কেউ দেখছে না। এভাবে চলতে থাকলে একসময় শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারী সংকট দেখা দেবে।’

জাকির হোসেন নামের আর বিনিয়োগকারী বলেন, ‘যারা কারসাজির সঙ্গে জড়িত তারাই বর্তমান শেয়ারবাজার থেকে মুনাফা করছেন। সাধারণ বিনিয়োগকারী এ বাজারে মুনাফা করতে পারছেন না, বরং লোকসান করছেন। এমনকি সাধারণ বিনিয়োগকারীরা পুঁজিবাজার থেকে বিনিয়োগ বের করতে পারছেন না। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা আটকে রয়েছেন।’

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের এক সদস্য বলেন, ‘মাত্রাতিরিক্ত বিক্রির চাপে শেয়ারবাজারে ক্রেতা সংকট দেখা দিয়েছে। এক্ষেত্রে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের যেমন ভূমিকা রয়েছে, তেমনি বড় বিনিয়োগকারীদেরও ভূমিকা রয়েছে। সাধারণ বিনিয়োগকারীরা যাতে শেয়ার বিক্রি করতে না পারেন এজন্য কিছু প্রতিষ্ঠানের শেয়ার প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ বিক্রির আদেশ দিচ্ছেন বড় বিনিয়োগকারীদের একটি অংশ। আবার কিছু ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী বিনিয়োগ তুলে নেওয়ার জন্য দিনের সর্বনিম্ন দামে বিক্রির আদেশ দিচ্ছেন। সব মিলে বিপুল বিক্রির আদেশ আসছে। এতে ক্রেতা সংকট দেখা যাচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘শেয়ারবাজারের এ অবস্থার মূল কারণ বাজারের ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমে গেছে। এ আস্থা ফিরিয়ে আনাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ। এখন তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলো যদি ভালো পারফরম্যান্স করে এবং বিনিয়োগকারীদের ভালো লভ্যাংশ দেয় তাহলে আস্থা বাড়তে পারে। আর বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়লে বিক্রির চাপ কমবে এবং বাজারে গতি ফিরে আসবে।’

শেয়ারবাজারের এ চিত্র সম্পর্কে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম  বলেন, ‘বিনিয়োগকারীদের মধ্যে হতাশা আছে। কেননা সামষ্টিক অর্থনীতির গতি সন্তোষজনক না। রিজার্ভ কমে যাচ্ছে। প্রবৃদ্ধির হার নিয়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা যে পূর্বাভাস দিচ্ছে, তা সরকারের বাজেটের টার্গেট থেকে কম। যে কারণে হতাশায় ভুগছেন বিনিয়োগকারীরা।’

তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি বিনিয়োগকারীদের শেয়ার ধরে রাখা উচিত। অর্থাৎ বিক্রির চাপ কমানো উচিত। বিক্রির চাপ কমলে সূচক বাড়বে। আর পড়ন্ত বাজারে বিক্রি করা সঠিক সিদ্ধান্ত না।’

বর্তমান পরিস্থিতিতে শেয়ারবাজারে গতি ফেরাতে নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষ থেকে নতুন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম  বলেন, ‘শেয়ারবাজারে লেনদেনের গতি বাড়ানোর জন্য আমরা প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ বাড়ানোর ক্ষেত্রে মোটিভেট (উৎসাহ) করছি।’

 

নিউজটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © gtbnews24.com
Web Site Designed, Developed & Hosted By ALL IT BD 01722461335