বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১:১২ অপরাহ্ন
ডেস্ক রিপোর্ট: উচ্চ আদালতের এক আদেশের পর পুরান ঢাকার হাজারীবাগ থেকে সাভারের হেমায়েতপুরে চামড়া শিল্প স্থানান্তর শুরু হয়। এতে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসা ট্যানারিশ্রমিকরা পড়েছেন বিপাকে। তাদের কেউ কেউ হাজারীবাগ ছেড়ে হেমায়েতপুরেও চলে গেছেন।
যদিও নানা কারণে এখনও কয়েক হাজার শ্রমিক হাজারীবাগ থেকে হেমায়েতপুরে গিয়ে কাজ করেন। এতো বড় প্রকল্পে শ্রমিকদের আবাসন সুবিধার কথা থাকলেও এখনো কোনো আবাসন ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। আবাসন সুবিধা না পাওয়ায় শ্রমিকদের আয়ের অধিকাংশই চলে যাচ্ছে যাতায়াত ও দুপুরে বিসিক এলাকায় হোটেলের খাবার খরচে।
শ্রমিকদের থাকার জায়গা খুবই সীমিত। তাই অনেক শ্রমিক এখনো হাজারীবাগ থেকেই যাতায়াত করেন। এতে আসা যাওয়া এবং দুপুরের খাওয়া খরচে অনেক টাকা চলে যায়। শ্রমিকদের আবাসন না থাকায় তাদের প্রতিদিন গড়ে ৪ ঘণ্টা যাতায়াতে ব্যয় হচ্ছে। নষ্ট হচ্ছে কর্মঘণ্টা।
ট্যানারিগুলো এখনো পুরোপুরি চালু না হওয়া ও সারা বছর কাজ না থাকায় আয় কমে যাচ্ছে শ্রমিকদের। এতে অনেকে চাকরি ছেড়ে অন্য পেশায় যোগ দিচ্ছেন বলে জানান শ্রমিকরা।
সম্প্রতি সাভারের হেমায়েতপুরের বিসিক চামড়া শিল্পনগরীতে সরেজমিন গিয়ে বিভিন্ন ট্যানারিতে কাজ করা শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে এমনটাই জানা গেছে।
২০০৩ সালে সাভারের হেমায়েতপুরে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) চামড়া শিল্প নগরী প্রকল্প হাতে নেয়। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি-এডিপি’র আওতায় ১৭৫ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখে প্রকল্পটির কাজ শুরু হয়। এরপর দ্বিতীয় দফায় ব্যয় বাড়ানো হয় প্রকল্পটিতে। ২০১৭ সালে তৃতীয়বারের মতো সংশোধনী এনে ব্যয় বাড়িয়ে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) সভায় নতুন করে অনুমোদন দেওয়া হয়। এতে নতুন করে এ প্রকল্পের ব্যয় গিয়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ৭৮ কোটি ৭১ লাখ টাকা। ১৯৪ দশমিক ৪০ একর জমির ওপরে স্থাপিত সাভার চামড়া শিল্প নগরীতে মোট প্লটের সংখ্যা ২০৫টি।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) চামড়া শিল্প নগরীর তথ্য মতে, বিসিক চামড়া শিল্প নগরীতে ১৬২টি শিল্প ইউনিটকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে স্থাপনা নির্মাণ ও উৎপাদন কাজ চলছে ১৩৯টি শিল্প ইউনিটের।
শুরু থেকেই আমরা শ্রমিকদের আবাসনসহ নানা সমস্যা সমাধানের দাবি করে আসছি। কিন্তু এখনো কোনোটাই বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না। ট্যানারিগুলো এখনও পুরোপুরি চালু না হওয়ায় কাজও সারা বছর থাকে না। আয় কমে গেছে অনেকের। ফলে অনেকে এই পেশা ছেড়ে অন্য কাজে চলে যাচ্ছেন।
শিল্প ইউনিটে মাসিক বেতন, চুক্তিভিত্তিক ও দৈনিক হাজিরাভিত্তিসহ সবমিলিয়ে বিসিক চামড়া শিল্প নগরীতে কাজ করে ১৫ হাজারের বেশি শ্রমিক। ১ হাজার ৭৮ কোটি ৭১ লাখ টাকা ব্যয়ের এই প্রকল্পটিতে শ্রমিকদের আবাসন, চিকিৎসা ও যাতায়াত ব্যবস্থার কথা থাকলেও তিনটির কোনোটিই এখনো নিশ্চিত করা হয়নি। শ্রকিদের জন্য এখনো কোনো আবাসন ব্যবস্থা গড়ে উঠেনি। ফলে অধিকাংশ শ্রমিককেই থাকতে হচ্ছে প্রকল্প এলাকার বাইরে।
এছাড়া আবাসন সুবিধা না থাকায় এখনো ট্যানারিগুলোতে প্রায় ২ হাজার শ্রমিক হাজারীবাগ থেকে সাভারের হেমায়েতপুরে এসে প্রতিদিন কাজ করেন। এসব শ্রমিকের অধিকাংশের বেতন ৮ হাজার থেকে ১২ হাজার টাকা। পরিবার নিয়ে থাকেন পুরান ঢাকার হাজারীবাগে।
সেখানে তাদের ছেলে-মেয়েরা পড়াশোনা করে এবং হেমায়েতপুর শিল্পনগরী এলাকায় কোনো আবাসন সুবিধা না থাকায় এখনো প্রতিদিন হাজারীবাগ থেকেই আসতে হয় তাদের। ফলে যাতায়াত সুবিধার জন্য তারা নিজেরাই ১০টি বাস চালু করেছেন। এ বাসগুলো প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময় পরপর হাজারীবাগ থেকে সাভারের হেমায়েতপুর বিসিক চামড়া শিল্পনগরী যাতায়াত করে। এতে প্রতিদিনই একজন শ্রমিককে বাস ভাড়া দিতে হয় ৭০ টাকা। কেউ এই বাস ধরতে না পারলে খরচ দ্বিগুণ হয়ে যায়। তখন সিএনজিতে আসা-যাওয়া করতে হয় শ্রমিকদের। এতে খরচ হয় ১৪০ টাকা।
শ্রমিকদের খরচ বেড়ে যায় দুপুরের খাবার খেতে গিয়েও। বিসিক চামড়া শিল্প নগরীর বিশাল এলাকায় বিভিন্ন স্থানে ট্যানারিগুলো তৈরি হওয়ায় শিল্পনগরী এলাকায় শ্রমিকদের অটোরিকশায় যেতে হয় হোটেলগুলোতে। এতে প্রতিদিন হোটেলে খাবার খেতে যাওয়া-আসায়ই খরচ হয় ২০ টাকা।
এছাড়া হাজারীবাগে থাকাকালে দুপুরে যেখানে বাসায় গিয়ে খাবার খেতেন শ্রমিকরা সেখানে এখন ট্যানারি শিল্পনগরীতে দুপুরে হোটেলের খাবার খেতে হয়। এতে তাদের খরচ হয় ৬০ থেকে ১০০ টাকা।
শিল্পনগরী এলাকায় একটি হোটেলে খাবার খাওয়ার সময় কথা হয় আরিফ হাওলাদার নামের এক শ্রমিকের সঙ্গে। তিনি বলেন, প্রতিদিন হাজারীবাগ থেকে এখানে কাজ করতে আসি। আসা-যাওয়ায় অনেক টাকা খরচ হয়ে যায়। দুপুরে খেতে হয় হোটেলে। হাজারীবাগে থাকতে দুপুরে বাসায় গিয়ে খেয়ে আসতাম। কিন্তু এখানে সে সুযোগ নেই।
ফজলুল করিম নামের আরেক শ্রমিক বলেন, মাসে যা আয় করি তার অনেক টাকাই আসা-যাওয়া এবং দুপুরের খাওয়ায় খরচ হয়ে যায়। পরিবারকে হেমায়েতপুরে নিয়ে আসা কঠিন। তারা এখানে থাকতে পারবে না। আমাদের থাকার জন্য কোনো ব্যবস্থাও নেই।
ট্যানারি ওয়ার্কার্স ইউনিয়ের সদস্য ও কালাম ব্রাদার্স ট্যানারির কর্মচারী কামাল হোসেন বলেন, শ্রমিকদের থাকার জায়গা খুবই সীমিত। তাই অনেক শ্রমিক এখনো হাজারীবাগ থেকেই যাতায়াত করেন। এতে আসা যাওয়া এবং দুপুরের খাওয়ায় অনেক টাকা চলে যায়। প্রতিদিন এতো টাকা খরচ হওয়ায় এখন শিল্প এলাকার বাইরে বাসা নিয়ে থাকি।
শ্রমিকদের আবাসন না থাকায় তাদের প্রতিদিন গড়ে চার ঘণ্টা যাতায়াতে ব্যয় হচ্ছে। নষ্ট হচ্ছে কর্মঘণ্টা। বারবার আবাসনসহ শ্রমিকদের নানা সমস্যার কথা তুলে ধরলেও এখনো কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না বলে জানান শ্রমিক সংগঠনের নেতারা।
ট্যানারি ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মালেক বলেন, শুরু থেকেই আমরা শ্রমিকদের আবাসনসহ নানা সমস্যা সমাধানের দাবি করে আসছি। কিন্তু এখনো কোনোটাই বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না। ট্যানারিগুলো এখনও পুরোপুরি চালু না হওয়ায় কাজও সারা বছর থাকে না। আয় কমে গেছে অনেকের। ফলে অনেকে এই পেশা ছেড়ে অন্য কাজে চলে যাচ্ছেন।
২০১৭ সালে রাজধানীর হাজারীবাগ থেকে সরিয়ে সাভারের হেমায়েতপুরে নিয়ে যাওয়া হয় ট্যানারি শিল্প। ১৬২টি ট্যানারি শিল্পকে বিসিক প্লট বরাদ্দ দিলেও এখনো অনেকগুলোই চালু হয়নি। তবে যেসব ট্যানারি হাজারীবাগ থেকে হেমায়েতপুরে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে তার অনেক শ্রমিক এখনো হাজারীবাগ থেকে হেমায়েতপুরে আসা-যাওয়া করে কাজ করছেন। এতে নানা ধরনের সমস্যায় পড়ছেন দীর্ঘদিন ধরে ট্যানারি শিল্পে কাজ করা এসব শ্রমিক।