শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ০৩:০৯ পূর্বাহ্ন

কোটি কোটি ট্যাহার কী অয়, কোহানে যায়?

নিজস্ব প্রতিবেদক: ‘নদীডা যদি বাইন্ধে দিত তাইলে তো ভিটে ছাড়া হওয়া লাগত না, বাড়ি ছাড়া হওয়া লাগত না। ভিটেডা গাঙে যাতো না। সরকার যদি ভালো করে বাইন্ধে দেয় তাইলে কি আমাগরে এত খারাপ আবস্থা (দুর্ভোগ) হওয়া লাগলনি? আর গাঙ ভাগুনির ট্যাহা আসে, এটা টেহাও পাওয়া যায় না। কোটি কোটি ট্যাহা আসে, কোটি কোটি ট্যাহার কী অয়, কোহানে যায়?’

যমুনার ভাঙনে ঘরবাড়ি হারিয়ে এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন পাবনার বেড়া উপজেলার নতুন ভারেঙ্গা ইউনিয়নের পূর্ব শ্রী কণ্ঠদিয়ার পঞ্চাশোর্ধ্ব গৃহবধূ সূর্য খাতুন। তার মতো ৫ শতাধিক পরিবার এরইমধ্যে ঘরবাড়ি হারিয়েছেন। যমুনার গর্ভে গেছে চরের তিন-চারশ বিঘা জমি। হুমকির মুখে প্রাথমিক ও নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়সহ বিদ্যুৎ ব্যবস্থা।

আগবাগসোহা, পূর্ব শ্রী কণ্ঠদিয়ার ও চর শাফুল্লার বাসিন্দারা নদীভাঙন রোধে দ্রুত কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন। আর পানি উন্নয়ন বোর্ডের স্থানীয় কর্মকর্তারা জানিয়েছেন এ চরগুলোকে রক্ষায় এরই মধ্যে প্রকল্প করে সরকারের উচ্চমহলে পাঠানো হয়েছে। বরাদ্দ এলেই ভাঙন রোধে কাজ শুরু করা হবে।

যমুনার ভাঙনের মুখে বাড়িঘর সরিয়ে নিয়েছেন, এখন গাছ- গাছালি কেটে বিক্রি দিচ্ছেন আব্দুস সামাদ ব্যাপারি (৬২)।

সামাদ ব্যাপারি  জানান, তার যাওয়ার আর কোনো জায়গা নেই। তিনি ঘর-বাড়ি ভেঙে আরেকজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। তার গৃহপালিত গরু-বাছুর নিয়েও বিপাকে পড়েছেন। খুব তাড়াতাড়ি তিনি এ গ্রাম ছেড়ে চলে যাবেন।

তার মতো আরো অনেকেই বাড়ি ঘর সরিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি গাছপালা কেটে বিক্রি দিচ্ছেন।

আগবাগসোহা, পূর্ব শ্রী কণ্ঠদিয়ার ও চর শাফুল্লা চরের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এর আগের বছরগুলোতে ১২-১৩শ’ পরিবার তাদের ভিটেমাটি, আবাদি জমি হারিয়েছেন। ভাঙনরোধে দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে শতবর্ষী এ চরগুলো বিলীন হয়ে যাবে বলে তাদের আশঙ্কা।

সরেজমিনে দেখা যায়, নগরবাড়ী ঘাট থেকে যমুনার বুক পাড়ি দিয়ে গহীন এসব চরে পৌঁছাতে হয়। এসব চর এলাকা কয়েকটি জেলা দ্বারা পরিবেষ্টিত। সেগুলো হলো- মানিকগঞ্জ, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ এবং রাজবাড়ী। চরগুলোতে বেড়া উপজেলার অন্তত ৫টি ইউনিয়নের সীমানা পড়েছে। ইউনিয়নের চেয়ারম্যানরা ভোটের আগে ছাড়া এসব চরে পা ফেলেন না বলে অভিযোগ চরবাসীর। ভোটের আগে চরবাসীর নানা আশ্বাস দেওয়া হলেও কোনো আশ্বাসই আর পূরণ করা হয় না।

চরের বাসিন্দা আব্দুস সোবহান মাতুব্বর (৬২) জানান, গ্রামের মসজিদটি বাধ্য হয়ে সরিয়ে নিতে হয়েছে। নদী পারাপারে অপেক্ষায় থাকা লোকজনের জন্য একটা যাত্রী ছাউনি করা হয়েছিল সে জায়গাটিও এবার ভেঙে গেল। বহু লোকজন আজ গৃহহারা। তারা এখন খুব বিপদে আছেন।

শিক্ষক আমিনুল ইসলাম জানান, চর সাফুল্লা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি ভেঙে গেছে। গত বছর পর্যন্ত আগবাগ সোহা, পূর্ব শ্রী কণ্ঠদিয়ার ও চর শাফুল্লা এলাকার প্রায় ১২শ থেকে ১৩শ বাড়িঘর ভেঙে নদীতে বিলীন হয়েছে। নদীতে ভেঙে গেছে কমিউনিটি ক্লিনিক।

তিনি জানান, দুই বছরের নদীভাঙনে মৌলভীপাড়া জামে মসজিদ, আগবাগসোহা জামে মসজিদ, চর শাফুল্লা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ছাড়াও চার শতাধিক বাড়িঘর নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এখনও ৮ শতাধিক বাড়িঘর ভাঙনের হুমকির মুখে রয়েছে। ভাঙন রোধে এখনই একটি বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা দরকার।

বেড়া উপজলার নতুন ভারেঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের ওয়ার্ড মেম্বার ও চরের বাসিন্দা বাবু সর্দার (৪৮) জানান, তিনটি শতবর্ষী চরের গ্রামগুলো চরম ভাঙনের মুখে। এবারও ভাঙনের শিকার হওয়া মানুষজন বিভিন্ন স্বজনদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন।

তিনি বলেন, যাদের বাড়ি-ঘর এখনো অক্ষত আছে তারা অন্যদের আশ্রয় দিয়েছেন। ভাঙন রোধ করা গেলে এ মানুষগুলো চরেই আশ্রয় নিয়ে থাকতে পারবেন। কিন্তু চর ভেঙে গেলে তারা মোথা গোঁজার ঠাঁই পাবেন না।

তিনি জানান, প্রতিদিন ২০-২৫টি করে বাড়ি নদীগর্ভে চলে যাচ্ছে। তার কাছে প্রতিদিন লোকজন আসে কিছু একটা করতে। কিন্তু তিনি তো কিছু করতে পারছেন না।

পানি উন্নয়ন বোর্ড বেড়ার নির্বাহী প্রকৌশলী সুধাংশু কুমার সরকার জানান, তিনি এরই মধ্যে ভাঙন কবলিত এসব চর এলাকা সরেজমিন পরিদর্শন করেছেন। তার অফিসের প্রকৌশলী ও সার্ভেয়াররা কাজ শুরু করছেন। এসব চর এলাকা ভাঙনের কবল থেকে রক্ষার জন্য একটি প্রকল্প ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষর কাছে পাঠানো হয়েছে। বরাদ্দ এলেই ভাঙন রোধে কাজ শুর করা হবে। এছাড়া জরুরি ভিত্তিতে বালির বস্তা ফেলে ভাঙন রোধ করা যায় কিনা তা খতিয়ে দেখা হবে।

নিউজটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © gtbnews24.com
Web Site Designed, Developed & Hosted By ALL IT BD 01722461335