শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৭:৪১ অপরাহ্ন

লকডাউনে মানসিক সংকট জমতে দেবেন না

জিটিবি নিউজঃ লকডাউনের ফলে মানসিক সংকট তৈরি হচ্ছে। একই সঙ্গে চারদিকে খারাপ খবর শোনা যাচ্ছে। ভবিষ্যৎ কী হবে, সে নিয়েও দুশ্চিন্তা। একটি মানুষ দিনের পর দিন অন্তরীণ থাকাটা মোটেও স্বাস্থ্যকর নয়, শারীরিক-মানসিক কোনো দিক দিয়েই নয়। এর মধ্যে আছে অর্থনৈতিক সংকট, আছে নিজের বা আপনজনের অসুস্থতা। এসব দুশ্চিন্তা, বেদনা, মানুষের মনকে অসুস্থ করে তুলতেই পারে। অন্যদিকে, শরীর ও মন সুস্থ না রাখলে এই রোগটি, কোভিড-১৯ কে প্রতিরোধ করা কঠিন হবে। এর কোনো প্রতিষেধক বা ওষুধ এখনো নেই। কাজেই নিজের রোগ প্রতিরোধক্ষমতাকে বাড়িয়ে তোলাই বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ। আর মানসিক অবস্থার সঙ্গে শারীরিক স্বাস্থ্য অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।

লকডাউন এবং বিশ্বব্যাপী নভেল করোনাভাইরাসের আক্রমণে যে হতাশা, ভয়, অথবা ক্ষোভ, পরিশেষে যে নিরুপায়, অনভিপ্রেত দিনযাপন, সবার ক্ষেত্রেই সেটা ঘটছে। পৃথিবীজুড়ে অসংখ্য মানুষের। এর প্রভাব শিশু এবং বয়োজ্যেষ্ঠদের ওপর আরও বেশি পড়ছে।

এ থেকে সচেতনভাবে বেরিয়ে আসতে হবে। বেরিয়ে আসা সম্ভব। প্রণিধানযোগ্য কয়েকটি পদক্ষেপ বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিয়ে থাকেন, নিচে তা তুলে ধরা হলো:

অন্যের সঙ্গে যুক্ত থাকা
বাইরে বের হতে না পারলেও বন্ধু ও নিকটজনদের সঙ্গে যুক্ত থাকুন। প্রতিবেশীর সঙ্গে ফোনের মাধ্যমে, ই–মেইলের মাধ্যমে যুক্ত থাকুন। যাঁদের সঙ্গে কথা বলে আপনার মন ভালো হয়, ভার লাঘব হয়, তাঁদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত কথা বলুন।

আবার যাঁদের মানসিক সাহায্য দরকার, প্রতিদিন তাঁদের ফোন দিয়ে আশা জাগিয়ে তুলুন, উৎফুল্ল রাখুন। এটা নিজের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ভালো।

এখন বিভিন্ন অ্যাপসের মাধ্যমে মানুষ গ্রুপ কার্যক্রম করছে। যেমন আপনি ফেসবুকে গ্রুপ ভিডিও চ্যাটে ডিনার পার্টি করতে পারেন। সেখানে আগে থেকেই একই ম্যানুর ব্যবস্থা করতে পারেন, তাহলে মনে হবে সবাই একসঙ্গে খাওয়া হচ্ছে। আপনি দূরে থেকেও ভার্চ্যুয়ালি অনেকের সঙ্গে গল্পগুজব, কোনো ধরনের খেলা—এসব কার্যক্রমে যুক্ত হতে পারেন। কোনো একটা উপলক্ষে অনুষ্ঠানের মতো করে অনেকে সেজেগুজেও গ্রুপ ভিডিও চ্যাট করা যায়, করছে।

অত্যধিক স্মার্টফোন, ফেসবুক ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকা
প্রথম পরামর্শটি পরিমিত ও সুস্থ যোগাযোগ। কিন্তু এসব বেশি হয়ে গেলে সেটা হিতে বিপরীত হয়ে যায়। আজকের যুগে একজন মানুষ ঘুম থেকে ওঠার পর থেকে শুরু করে আবার ঘুমাতে যাওয়া পর্যন্ত, জাগ্রত সময়ের এমন কোনো মুহূর্ত নেই যে ফোন ও সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘোরাফেরা করছে না। লকডাউনের কারণে এ একেবারে বিরতিহীনভাবে চলতে পারে। এটা করা যাবে না। তাতে অবসাদ, ক্লেশ শুধু বেড়েই চলবে। দিনের একটা সময় সম্পূর্ণ স্মার্টফোন ও সোশ্যাল মিডিয়ামুক্ত রাখতে হবে। ফোন দূরে রাখুন, কম্পিউটারে গেলেও কোনো সোশ্যাল মিডিয়া নয়। এটা জরুরি।

রুটিন মেনে চলা
এখন তো কোনো রুটিন নেই। সকালে কাজে বা স্কুল-কলেজে যেতে হলে রুটিন থাকে। প্রাত্যহিক কার্যকলাপে তা সময় বেঁধে দেয়। রুটিন না থাকলে হয়তো ঘুম ঠিকমতো হচ্ছে না, খাওয়ার সময় ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে। বিশৃঙ্খলা মনের জন্য, শরীরের জন্য ভালো নয়। নিজেই নিজের রুটিন করুন। লিখে রাখুন, ফ্রিজে ঝুলিয়ে দিন। অন্য কারও সঙ্গে জোট বেঁধে সবাই সেই রুটিন মেনে চলতে একে অন্যকে উদ্বুদ্ধ করুন।

এই লাগামহীন যথেচ্ছ জেগে থাকা, যথেচ্ছ কথা বলা, যথেচ্ছ সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘোরাফেরা, এসব শরীর-মন দুটোরই ক্ষতির কারণ হবে। আগেও ক্ষতি করত, লকডাউনের পর আরও বেশি করবে।

বাসায় শিশু–কিশোরদের জন্য রুটিন বিষয়টা আরও জরুরি। তাদের করোনা–পূর্ব আর দশটা সাধারণ কর্মমুখর দিনের মতো রুটিনেই রাখুন। নিজেও সেভাবে আহার-নিদ্রা, রান্না-বাড়া, ক্লিনিং, টিভি দেখা, বই পড়া, বিষয়গুলো পরিকল্পনা মাফিক, সময় বরাদ্দ করে করুন। শিশুরা বড়দের দেখে শেখে।

এই অবসরে কাজের কিছু করুন। বই পড়ুন। নতুন কিছু শিখুন, সার্টিফিকেট নিন। অনলাইন কোর্স আছে, সেখান থেকে কিছু শিখুন। তাতে মানসিক চাপ কমবে, মন ভালো থাকবে। সঙ্গে সঙ্গে আত্মোন্নয়নও হচ্ছে।

সুষম খাদ্য ও ব্যায়াম
এ দুটোর কোনো বিকল্প নেই। এ সময় লাগাম ছেড়ে দিলে যা হবে, আহার বেশি নিদ্রা কম। হওয়া উচিত উল্টো, আহার কম নিদ্রা বেশি। পূর্ণবয়স্ক মানুষের ৭ থেকে ৯ ঘণ্টা ঘুমানো উচিত। ঘুম কম হলে শরীরে রোগ প্রতিরোধক্ষমতাও কমে যাবে। যেটা এই করোনাকালে কিছুতেই করা যাবে না।

মোট খাওয়ার পরিমাণের মোট ক্যালরির হিসাব রাখুন। নিজের ওজন নিন। অনেক সময় বিপদের মধ্যে বেশি করে খাওয়াটাকেই একটা বিকল্প রাস্তা মনে হতে পারে। তাতে আরও বেশি ক্ষতি হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়াতে বলছেন, এর জন্য সুষম খাদ্য খেতে হবে। ফলমূল বেশি খেতে হবে। সুষম খাদ্যের তথ্যের অনেক সূত্র আছে। এখানে আপনার ইচ্ছাই প্রধান সহায়ক, আর অনিচ্ছাই প্রধান অন্তরায়।

ব্যায়াম করাটা একান্ত জরুরি। এই লকডাউনে আগের চেয়েও বেশি জরুরি। ব্যায়াম করলে মস্তিষ্কে ডোপামিন এবং এন্ডোরফিন নিঃসরিত হয়। এ দুটো মানুষকে উৎফুল্ল রাখতে, আনন্দে রাখতে সাহায্য করে। শরীর ও মনের জন্য অতি উত্তম। ব্যায়াম, সে যা কিছু হতে পারে, বুকডন, ওঠবস, যোগব্যায়াম। জায়গা থাকলে হাঁটা বা দৌড়ানো, ভার উত্তোলন। বাসায় বসে কি করা যায় না? হাত পা নাড়াতে হবে, পেশিকে সামান্য হলেও ব্যবহার করতে হবে, না হলে খিল ধরে যাবে। আর মনের মধ্যে জমবে হতাশা ও অবসাদ। এর কোনো বিকল্প নেই। আপনি যদি প্রাক করোনা যুগে কোনো ব্যায়াম না-ও করে থাকেন, ক্যালরি হিসেবে করে না-ও খেয়ে থাকেন, এখন করুন, এখনই দরকার বেশি। তারপর এই ভালো অভ্যাসটা বজায় রাখুন।

সৃজনশীল কাজে নিয়োজিত হওয়া
সৃজনশীল কাজে মানুষ বাহবা দেবে, সে জন্য নয়। বিটোফেনের মতো নতুন সুর সৃষ্টি, বা শেকসপিয়ারের মতো কালজয়ী নাটক লেখাই শুধু সৃজনশীল নয়। বিজ্ঞানীরা বলছেন, হস্তশিল্প, নতুন রান্না, সেলাই, উলের কাজ, নিজের মনে আঁকাআঁকি, সবই সৃজনশীল কাজ।

‘জার্নাল অব পজিটিভ সাইকোলজি’ শিশুদের নিয়ে একটি পরীক্ষা চালায়, তাতে দেখা গেছে শিশুরা যখন আঁকাআঁকি, সেলাই, উলের কাজ, অথবা স্ক্র্যাপবুকিং করছে, তখন তারা অনেক উৎফুল্ল থাকে। তারা কাজটি আবার করতে চায়। তাদের মধ্যে উৎসাহ–উদ্দীপনার সঞ্চার হয়। এর বৈজ্ঞানিক ভিত্তিও রয়েছে। এই পরীক্ষা শেষে টামলিন কনার বলেন, ‘এই ফলাফল থেকে আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে সুস্থ মানসিক বিকাশের জন্য প্রতিদিন কিছু সৃজনশীল কাজ করা কত জরুরি।’

তবে সৃজনশীলতায় কিছুই বাদ যাবে না। আপনি গান শিখতে পারেন, বাড়ির দেয়াল রং করতে পারেন, বাগান করতে পারেন। লিখতে পারেন, আবৃত্তি করতে পারেন, ভিডিও বানাতে পারেন, যা কিছুতে আপনার আগ্রহ, যা কিছুতে আপনার সামান্যতম প্রতিভা আছে।

সেই ব্যায়ামের মতোই, এই কাজগুলো ডোপামিন নামক নিউরো ট্রান্সমিটার নিঃসরণ করে। ডোপামিন ভালো লাগায়, কাজটাকে বারবার করতে উদ্বুদ্ধ করে। মন উৎফুল্ল রাখে। খাদ্য গ্রহণেও ডোপামিন নিঃসরিত হয়। তাই বারবার খেতে ইচ্ছে করে। সেটা আদিকাল থেকে। সেটা ভালো নয়। খারাপ কাজেও এই ডোপামিন এসে বদভ্যাস তৈরি করে। কাজেই সচেনতভাবে ভালো কাজে সেটাকে নিয়োজিত করুন, শরীর-মন ভালো থাকবে।

অন্যের সেবা-যত্ন করা
অনেক মনীষী বলেছেন, পরার্থে জীবনের মতো সফল জীবন আর হয় না। স্বার্থপরতায় গ্লানি জন্মায়, জীবনের উদ্দেশ্য থাকে না। ছোট-বড় যেকোনো পরিসরে সেবা করা, সাহায্য করা মানুষকে উদ্দীপ্ত করে। মন ভালো রাখে। অনাবিল আনন্দ দেয়। নিজের বাসায় যাঁরা আছেন, যাঁদের সময় দেওয়া দরকার, সাহায্য দরকার, তাঁদের সেবা করুন। দূর থেকে দরিদ্র মানুষের, অসুস্থ মানুষের জন্য করুন। পারলে বড় পরিসরে করুন। না পারলে একটি পরিবারকে হলেও সাহায্য করুন। এতে মন ভালো হবে, একটা ‘Purpose’ তৈরি হবে। এই মুহূর্তে পৃথিবীতে মায়া-মমতা, দয়া-দাক্ষিণ্য, সেবা-যত্ন, ভীষণ জরুরি হয়ে পড়েছে। সেদিকে চোখ ফেরালে নিজের সমস্যা অনেক ক্ষুদ্র, অনেক ম্রিয়মাণ হয়ে যাবে।

খারাপ সংবাদ থেকে বিরতি নেওয়া
সব সময় এই করোনাভাইরাসের সংবাদ, একই আলোচনায় না থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন কিছু করুন। হাসির নাটক দেখুন। কিছুটা সময় কোনো টিভি নিউজ নয়, কোনো সংবাপত্র নয়, কোনো ফেসবুকের ভাইরাল গুজব নয়, একটা প্রেমের উপন্যাসের মধ্যে ডুব দিন, ক্যারম বোর্ড নিয়ে বাড়ির সবাই মিলে ‘কলাগাছ’ খেলুন। ভিন্ন কিছু আলোচনা করুন। বিরামহীন নেগেটিভ সংবাদ মনকে বিষিয়ে তুলতে পারে। এর থেকে সচেতনভাবে বিরতি নিন।

মেডিটেশন
মেডিটেশনের ওপর এখন প্রাচ্যে-পাশ্চাত্যে হেনো দেশ নেই, যেখানে জোর দেওয়া হচ্ছে না। মনকে আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে শিখিনি, তাই সে যা ইচ্ছা করে, আমরা তা–ই করি। মেডিটেশনে মনের নিয়ন্ত্রণ হয়। শান্ত-স্থিত হয়। এর উপকারিতা সর্বজন স্বীকৃত। মেডিটেশন করুন। কীভাবে করতে হয় তার প্রচুর ভিডিও ইউটিউবে পাওয়া যাবে। অনেক ফ্রি মেডিটেশন ক্লাসও অনলাইনে এখন চলছে। এই করোনাকালে মেডিটেশন অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে।

এটা এমন একটা দুর্যোগ যে মন ভেঙে পড়া স্বাভাবিক। কাজেই, দিন আসে দিন যায়, তেমন যেন না হয়। উদ্যোগ নিন, জীবনযাত্রা পরিবর্তন করুন, মনকে সারিয়ে তুলুন। যেভাবে ঘন ঘন বিশ সেকেন্ড হাত ধোয়ার অভ্যাস করেছেন, সেভাবে এটাও করুন। আপনা-আপনি কিছু হয় না।

এ ক্ষেত্রে এবং সব ক্ষেত্রেই আপনার ইচ্ছাই প্রধান সহায়ক, আপনার অনিচ্ছাই প্রধান অন্তরায়।

নিউজটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © gtbnews24.com
Web Site Designed, Developed & Hosted By ALL IT BD 01722461335