শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৪:৫৫ অপরাহ্ন

শ্রদ্ধাঞ্জলি একজন কৌতূহলী অধ্যাপকের জীবনাবসান

জিটিবি নিউজঃ অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর মৃত্যুর পর প্রচার ও সামাজিক মাধ্যমে তাঁর তিরোধানে যে ব্যাপক শোক ও প্রশস্তি লক্ষ করেছি, তা আমাকে অভিভূত করেছে। এটা কি তিনি শিক্ষক ছিলেন বলে? আমার তা মনে হয় না। নিবন্ধের শেষে এ প্রশ্নের জবাব দিতে চেষ্টা করব। কারণ, শিক্ষা–সংশ্লিষ্ট ছাড়াও অনেকেই তাঁর মৃত্যুকে অপূরণীয় ক্ষতি বলে বর্ণনা করেছেন। যেমন আমার সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের কথাই ধরুন না।

তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ যমুনা মাল্টিপারপাস ব্রিজ অথরিটির (জেএমবিএ) নির্বাহী পরিচালক এ জেড এম শামশুল আলমের দপ্তরে। পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে মতবিরোধের কথা সবাই জানেন। কিন্তু যমুনা সেতু নিয়েও মতান্তর হয়েছিল ১৯৯১ সালে। তবে তা দুর্নীতি নিয়ে নয়। বিশ্বব্যাংক সে সময় জানায় যে তাদের প্রণীত অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ অনুযায়ী যমুনা সেতুর আইআরআর (ইন্টারনেল রেট অব রিটার্ন) কম, তাই তাদের পক্ষে এ প্রকল্পের অর্থায়ন করা সম্ভব নয়। যেহেতু বিশ্বব্যাংক ছিল মূল দাতা, তাই তারা অর্থায়ন না করলে বাকিরা এডিবি ও জাপান ও অর্থায়ন করবে না। অর্থাৎ যমুনা সেতু হবে না।

যা হোক, সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশক্রমে ড. জাহিদ ও ড. খুরশীদ (যথাক্রমে এডিবি থেকে মুখ্য অর্থনীতিবিদ ও বিশ্বব্যাংক থেকে ঊর্ধ্বতন বেসরকারি খাত বিশেষজ্ঞ হিসেবে অবসরপ্রাপ্ত) ও আমি বিষয়টি নিয়ে আলোচনার জন্য জেএমবির নির্বাহী পরিচালক এ জেড এম শামশুল আলমের দপ্তরে মিলিত হই। সেখানে অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন যমুনা ব্রিজের কারিগরি পরামর্শদাতা দলের প্রধান হিসেবে। তিনি আমাদের পেয়ে খুব আনন্দিত হন। বললেন, সরকারের পক্ষে কোনো বিশেষজ্ঞ অর্থনীতিবিদ না থাকায় তিনি এত দিন অর্থনৈতিক সম্ভাব্যতার বিষয়টিও দেখছিলেন। এখন তিনি ভারমুক্ত হলেন। জাহিদ, খুরশীদ ও আমি মিলে বিশ্বব্যাংকের অর্থনৈতিক সম্ভাব্যতা প্রতিবেদনের পুনর্মূল্যায়ন করে দেখাই যে যমুনা সেতু প্রকল্পের আইআরআর বিশ্বব্যাংক নির্ধারিত হার্ডল রেটের চেয়ে বেশি। অতএব প্রকল্পটি তাদের বিবেচনায়ও অর্থায়নযোগ্য।

ইতিমধ্যে জেএমবির নতুন প্রধান হিসেবে আসেন আজিমুদ্দিন আহমদ। তাঁর নেতৃত্বে ড. চৌধুরী ও আমি ওয়াশিংটনে যাই, বিশ্বব্যাংককে বোঝানোর জন্য যে তাদের প্রতিবেদনে যমুনা সেতুর অর্থনৈতিক সম্ভাব্যতা অবমূল্যায়িত হয়েছে। আমি সরকারের পক্ষে আমাদের তিনজনের করা অর্থনৈতিক পুনর্মূল্যায়ন প্রতিবেদন উপস্থাপন করি। ড. চৌধুরী কারিগরি মূল্যায়ন বিষয়ে বিশ্বব্যাংক কর্মকর্তাদের প্রশ্নের জবাব দেন। আমদের মিশন সফল হয়। বিশ্বব্যাংক এক সপ্তাহের মধ্যেই যমুনা সেতুর অর্থায়ন বিষয়ে তাদের সম্মতি জ্ঞাপন করে।

এরপর আমি শিক্ষকতা করতে সিঙ্গাপুর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যাই এবং ফিরে এসে পুনরায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে যোগ দিই। ড. চৌধুরীর সঙ্গে আমার যোগাযোগ পুনঃস্থাপিত হয় আমি ১৯৯৮ সালে ইডকলের প্রধান নির্বাহী হিসেবে যোগদানের পর। তিনি ছিলেন ইডকলের পরামর্শদাতা প্রতিষ্ঠান নির্বাচক কমিটির প্রধান। একবার তাঁর কমিটির করা মূল্যায়ন বিষয়ে বিশ্বব্যাংক আমাদের পুনঃ বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার পরামর্শ দেয়। তিনি বিশ্বব্যাংকের পুনঃ বিজ্ঞপ্তির পরামর্শে খুব বিরক্ত হন। আমাকে বলেন একই কাজ আমরা বারবার করব নাকি? আমি স্যারকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করি। বিশ্বব্যাংককে ই–মেইলে লিখি, যে পরামর্শদাতা প্রতিষ্ঠান নিয়োগ পুনঃ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হলে নির্বাচক কমিটির প্রধান পদত্যাগ করতে পারেন। আরও লিখি যে ড. চৌধুরী একজন অত্যন্ত ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তি। তাঁর পদত্যাগ পুরো নির্বাচনপ্রক্রিয়াকেই প্রশ্নবিদ্ধ করবে। এতে কাজ হয়। বিশ্বব্যাংক তাদের পুনঃ বিজ্ঞপ্তির পরামর্শ থেকে সরে আসে। আমরা একটা সমঝোতায় উপনীত হই। তাঁর পেশাদারি সুনাম সে যাত্রায় আমাদের রক্ষা করে।

এরপর আবার তাঁর সঙ্গে পরামর্শ করি ইডকলের সৌরবিদ্যুৎ কর্মসূচি নিয়ে। বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে এ বিষয়ে চুক্তির একটা শর্ত ছিল একটি কারিগরি কমিটি করতে হবে। আমি সিদ্ধান্ত নিই, সরকারের বাইরের কাউকে আমি এ কমিটির প্রধান করব। তাই আমি স্যারকে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সৌরবিদ্যুৎ সম্পর্কে জানেন এবং দৃঢ়চেতা একজন অধ্যাপকের নাম সুপারিশ করতে বলি। তিনি অধ্যাপক রিজওয়ান খানের (পরবর্তীকালে ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির উপাচার্য) নাম প্রস্তাব করেন। আমি ড. খানের সঙ্গে আলোচনা করে তাঁকে ইডকলের কারিগরি কমিটির প্রধান হওয়ার প্রস্তাব দিই। তিনি তা গ্রহণ করেন এবং সাফল্যের সঙ্গে এ দায়িত্ব পালন করেন।

এর মধ্যে স্যার ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়েছেন। একদিন মোবাইলে ফোন। আপনি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা কোর্স পড়ান না। আমি বলি কোন কোর্স? তিনি বললেন, আপনি সিঙ্গাপুর ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে কী পড়াতেন? আমি বলি পাবলিক ফাইন্যান্স ও ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিকস। তিনি শুনে বললেন, আপনি এনবিআরেও কাজ করেছেন। তাহলে পাবলিক ফাইন্যান্স পড়ান। ছাত্রছাত্রীরা থিওরি এবং প্র্যাকটিস দুটিই জানবে।

এরপর আর দাপ্তরিক কাজে তাঁর সঙ্গে আর কথা হয়নি। তবে আমাদের ব্যক্তিগত যোগাযোগ থেকে যায়। ২০১১ সালের ১ আগস্ট মাসে আমার আম্মা মারা যান। তাঁকে নিয়ে আমি দ্য ডেইলি স্টারের সাহিত্য পাতায় একটি নিবন্ধ লিখি। কয়েক দিন পরেই স্যারের ই–মেইল, ‘প্রিয় ড. ফাওজুল কবির, আমি এটা জেনে ব্যথিত হয়েছি যে আপনার মা ১ আগস্ট তারিখে মারা গেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। আমি এ সম্পর্কে জেনেছি আপনার সুলিখিত ও মর্মস্পর্শী ডায়িং পিসফুলি (শান্তির মৃত্যু) নিবন্ধ থেকে। গত বছর ৭ আগস্ট আমি আমার মাকে হারিয়েছি। আপনার নিবন্ধ আমাকে আমার মায়ের মুখচ্ছবি মনে করিয়ে দিয়েছে। আমার মা ও শান্তির মৃত্যু লাভ করেছিলেন।’

এ ধরনের যোগাযোগ অব্যাহত থাকে শেষ অবধি। সর্বশেষ যোগাযোগ হয় খুদে বার্তায়, মার্চ মাসের ৬ তারিখে। এবারও আমার একটা লেখা ‘তিন সচিব ও একজন সাংসদ’ নিয়ে। ‘আজকের প্রথম আলোয় প্রকাশিত সুলিখিত প্রবন্ধের জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আপনি যাদের কথা লিখেছেন, আমি তাদের চারজনকেই চিনতাম। জনাব এস বি চৌধুরীর সঙ্গে আমার কাজ করার সৌভাগ্য হয় যখন আমরা ১৯৯৬ সালে কেয়ারটেকার সরকারে ছিলাম। দুর্ভাগ্যবশত প্রথম আলো তাঁদের পোর্ট্রেট স্কেচের নিচের নাম ভুল জায়গায় দিয়েছে।’ লেখাটি কেবল তিনি পড়েননি, এর ভুল পর্যন্ত তাঁর নজর এড়ায়নি।

যে প্রশ্ন নিয়ে নিবন্ধ নিয়ে শুরু করেছিলাম, এবার তাতে আসি। তাঁর এ অসাধারণ লোকপ্রিয়তার কারণ কী? তাঁর সংস্পর্শে আসা প্রত্যেক মানুষই ছিল তাঁর অধ্যয়নের বিষয়। তা সেই ব্যক্তি যে বয়স বা যে পেশার, সহপাঠী, ছাত্র, শিক্ষক, খেলোয়াড়, সাংবাদিক, আমলা—যে পরিচয়েরই বা হোক না কেন। অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী বড় কাঠামো প্রকৌশলী ছিলেন, না কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ ছিলেন, সে বিষয়ে বিতর্ক থেকেই যাবে। কিন্তু তিনি যাঁদের সংস্পর্শে আসতেন, তাঁদের সম্পর্কে তাঁর কৌতূহল সম্পর্কে কোনো বিতর্ক থাকতে পারে না। এ জন্যই দূরের মানুষকে তিনি সহজে কাছের করে নিতে পারতেন। এ জন্যই যাঁরাই তাঁর সংস্পর্শে এসেছেন, তাঁরা তাঁর তিরোধানে স্বজন হারানোর বেদনা অনুভব করছেন। আমি তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করি।

নিউজটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © gtbnews24.com
Web Site Designed, Developed & Hosted By ALL IT BD 01722461335