বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১১:২৮ অপরাহ্ন

কারা হবেন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের নেতা?

জিটিবি নিউজ টুয়েন্টিফোর : ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর সংহতি, সম্প্রীতি ও উন্নয়নে কেন্দ্রিকতা ও প্রাতিষ্ঠানিক নেতৃত্ব গুরুত্বপূর্ণ। রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনার মাটিতে পা রেখেই সেখানে মসজিদ গড়ে তোলেন। যারা মসজিদে নববী থেকে দূরে মদিনার উপকণ্ঠে বসবাস করত, তাদের জন্য তিনি পৃথক মসজিদ নির্মাণ ও ধর্মীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনার অনুমতি দেন, যেন তাদের মধ্যে ধর্মীয় নেতৃত্ব গড়ে ওঠে এবং দ্বিনের কাজে পরস্পরকে সহযোগিতা করতে পারে। তখন ধর্মীয় শিক্ষা, দ্বিনি দাওয়াত, রাষ্ট্রীয় পরামর্শ, কূটনৈতিক দলের সঙ্গে সাক্ষাৎ থেকে যুদ্ধের সিদ্ধান্ত—সব কিছু মসজিদেই হতো। বস্তুত রাসুলুল্লাহ (সা.) একটি মসজিদভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। রাসুলের যুগের মসজিদ ছিল বর্তমান যুগের ধর্মীয় প্রতিনিধিত্বকারী প্রায় সব প্রতিষ্ঠানের সমার্থক।

মুসলমানের ধর্মীয় জীবনের গতিপথ নির্ণয়ে ইসলামী প্রতিষ্ঠান ও তাদের পরিচালকদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। ইসলাম এসব প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ও নেতৃত্ব নির্ধারণে কিছু মাপকাঠি নির্ধারণ করে দিয়েছে। শরিয়তের আলোকে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বের প্রথম ও প্রধান শর্ত ঈমান। অবিশ্বাসী কোনো ব্যক্তি ইসলামী প্রতিষ্ঠানের প্রধান হওয়ার যোগ্য নন। এমনকি ধর্মীয় জীবনের অনুগামী নন এমন ব্যক্তিও নেতৃত্বের দাবি করতে পারেন না।

ইসলামী সমাজব্যবস্থায় ধর্মীয় ও সামাজিক নেতৃত্বের ধারণাটি পৃথক নয়। মুসলিম সমাজের যেকোনো পর্যায়ের নেতৃত্ব তাঁরাই দেবেন, যাঁরা ব্যক্তি ও সামাজিক জীবনে ধর্মের প্রতিনিধিত্ব করেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তাদেরকেই আল্লাহ সৎপথে পরিচালিত করেছেন। সুতরাং তুমি তাদের পথের অনুসরণ করো।…’ (সুরা : আনআম, আয়াত : ৯০)

আবদুশ শাফি মুহম্মাদ আবুল আইনাইন সৎপথপ্রাপ্ত মানুষের ২১টি বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেছেন, যার মধ্যে রয়েছে ঈমান, আল্লাহভীতি, ইসলামী জ্ঞান, উত্তম চরিত্র, মানুষের কল্যাণ প্রত্যাশা, ব্যক্তিত্ববোধ, দয়া, গাম্ভীর্য ইত্যাদি। (আল কিয়াদাতুল ইদারিয়্যা ফিল ইসলাম, পৃষ্ঠা ১৪২) ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে এসব গুণ অপরিহার্য। বরং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসংশ্লিষ্ট সবার মধ্যে ঈমান, আল্লাহভীতি, সততা ও নিষ্ঠার মতো গুণ থাকা কাম্য। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আল্লাহ যেসব গৃহকে মর্যাদায় উন্নীত করার এবং সেগুলোতে তাঁর নাম উচ্চারণ করার আদেশ দিয়েছেন, সেখানে সকাল-সন্ধ্যায় তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে সেই সব লোক, যাদের ব্যবসা-বাণিজ্য ও ক্রয়-বিক্রয় আল্লাহর স্মরণ থেকে, নামাজ কায়েম করা থেকে এবং জাকাত প্রদান করা থেকে বিরত রাখে না।’ (সুরা : নুর,          আয়াত : ৩৬-৩৭)

বর্তমানে মাদরাসা-মসজিদসহ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে সার্বিক পরিচালনায় সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠা বিশেষ গুরুত্ব পায়, যা ইসলামী মূল্যবোধ ও চেতনার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। ইসলামী রীতি ও মূলনীতি হলো, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে সর্বসাধারণের অংশগ্রহণ থাকবে, তা পরিচালনায় তাদের মতামতও নেওয়া হবে। তবে তার নীতি নির্ধারণ করবেন আল্লাহভীরু ও ধর্মীয় গুণসম্পন্ন ব্যক্তিরা। আর্থিক অবদানের ভিত্তিতে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব নির্ধারণ গ্রহণযোগ্য নয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরা কি হাজিদের পানি পান করানো এবং মসজিদুল হারাম আবাদ করাকে সেই ব্যক্তির কাজের সমপর্যায়ের মনে করো, যে আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করে এবং আল্লাহর পথে লড়াই করে? তারা কখনোই আল্লাহর কাছে সমমর্যাদার হতে পারে না। আল্লাহ জালিমদের সঠিক পথ দেখান না। (সুরা : তওবা, আয়াত : ১৯)

সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করা আরো বেশি নিন্দনীয়। মক্কার কুরাইশরা মসজিদুল হারামের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে গর্ব বোধ করত এবং সেখানে মানুষের প্রবেশাধিকার ও ধর্মীয় কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করত। আল্লাহ তাআলা তাদের এই প্রবণতার নিন্দা করে বলেন, ‘তাদের কী-ই বা বলার আছে যে আল্লাহ তাদের শাস্তি দেবেন না, যখন তারা মানুষদের মসজিদুল হারাম থেকে বাধা দেয়? অথচ তারা এর তত্ত্বাবধায়ক নয়; আল্লাহভীরুরাই এর তত্ত্বাবধায়ক। কিন্তু তাদের বেশির ভাগ বিষয়টি জানে না।’ (সুরা : আনফাল, আয়াত : ৩৪)

এই আয়াতে আল্লাহ তাদের অতীত অবদান ও ঐতিহ্যের ওপরে আল্লাহভীতিকে প্রাধান্য দিয়েছেন। সুতরাং মসজিদের তত্ত্বাবধায়ক হবেন মুসলিম সমাজের আল্লাহভীরু ও ধর্মীয় বিবেচনায় অগ্রগামী ব্যক্তিরা। সুরা তওবার ১৭ নম্বর আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার প্রেক্ষাপট থেকে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, “আমার পিতা আব্বাস (রা.) ইসলাম গ্রহণের আগে বদর যুদ্ধে বন্দি হন। মুসলমানরা তাঁর মতো বুদ্ধিমান লোককে কুফর ও শিরকের ওপর অবিচল থাকার দরুন ভর্ত্সনা করে। তখন তিনি বলেন, ‘তোমাদের কি জানা নেই, আমরাই তো বাইতুল্লাহ ও মসজিদে হারামকে আবাদ করে রেখেছি। আমরাই তো হাজিদের জন্য পানির ব্যবস্থা করি। তাই আমরা এর মুতাওয়াল্লি।’ এই দাবির পরিপ্রেক্ষিতে কোরআনের এই আয়াত অবতীর্ণ হয়।” (আল বাহরুল মুহিত : ৫/১৮)

তবে ধর্মীয় জীবনে পিছিয়ে, কিন্তু ধর্মীয় চেতনা লালন করেন—এমন ব্যক্তিদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় অংশগ্রহণেরও একটি রূপরেখা ইসলাম দিয়েছে। তা হলো মসজিদ আবাদ তথা এর কার্যক্রম গতিশীল করতে সহায়তা করা। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তারাই তো আল্লাহর মসজিদ আবাদ করবে, যারা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করে, নামাজ কায়েম করে, জাকাত আদায় করে আর আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ভয় করে না। আশা করা যায়, তারাই হবে সঠিক পথপ্রাপ্ত মানুষদের অন্তর্ভুক্ত। (সুরা : তওবা, আয়াত : ১৮)

আলোচ্য আয়াতের ব্যাখ্যায় মসজিদ আবাদ প্রসঙ্গে আল্লামা ইবনে কাসির (রহ.) বলেন, ‘মসজিদ আবাদের অর্থ কেবল তার চাকচিক্য ও বাহ্যিক সৌন্দর্যবর্ধনই নয়, বরং মসজিদ আবাদ করার অর্থ তাতে আল্লাহর আলোচনা করা, আল্লাহর বিধান বাস্তবায়ন করা এবং মসজিদকে সব ধরনের শিরক ও পাপ-পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত রাখা।’ (ইবনে কাসির : ১/২৭০)

তদুপরি আল্লাহ যাঁদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করেছেন এবং এর যেকোনো ধরনের দায়িত্ব যাঁদের কাঁধে রয়েছে তাঁরা আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-এর নিম্নোক্ত বক্তব্য থেকে নির্দেশনা নিতে পারেন, যেখানে মুসলিম সমাজের নেতার মনোভাব কেমন হবে এবং তাঁর ক্ষমতার পরিধি কতটুকু তা স্পষ্ট হয়েছে।  তিনি বলেন, ‘আমি তোমাদের শাসক নিয়োজিত হয়েছি। অথচ আমি তোমাদের থেকে উত্তম নই। আমি যদি ভালো করি তবে আমাকে সাহায্য করবে। আমি ভুল করলে শুধরে দেবে। সত্য হলো আমানত রক্ষা করা আর মিথ্যা হলো খেয়ানত (বিশ্বাস নষ্ট) করা।…  আমি যতক্ষণ আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্য করব, ততক্ষণ আমার আনুগত্য করবে। যদি আমি আল্লাহর অবাধ্য হই তবে আমার আনুগত্য (নেতৃত্ব) তোমাদের জন্য আবশ্যক নয়।’ (আকরাম রুসলান দিনারিয়্যা, আল হুকমু ওয়াল ইদারা ফিল ইসলাম, পৃষ্ঠা ৮২-৮৩)

নিউজটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © gtbnews24.com
Web Site Designed, Developed & Hosted By ALL IT BD 01722461335