বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২:২৯ পূর্বাহ্ন

বিনা চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যুতেও মন গলছে না হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের

দীর্ঘদিন ধরে শ্বাসকষ্টে ভুগছেন কক্সবাজার শহরের পেশকারপাড়ার জামাল হোসেনের স্ত্রী নূরজাহান বেগম (৫৫)। এতদিন গরম পড়লেও শুক্রবার থেকে ঝড়ো হাওয়ায় থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। ফলে শ্বাসকষ্টটা বাড়ে নূরজাহানের। নিয়মিত পথ্যে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় রোববার সকাল ১০টায় কক্সবাজার সদর হাসপাতালে আনা হয় তাকে। কিন্তু সব বিভাগ খোলা থাকলেও পর্যাপ্ত চিকিৎসার অভাবে স্বজনদের সামনেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন নূরজাহান বেগম।

কক্সবাজার সদর হাসপাতালের অচলাবস্থার কারণে মায়ের করুণ মৃত্যুর বর্ণনা এভাবেই দিচ্ছিলেন হতভাগা মুহাম্মদ বাবু। তার চোখ-মুখেও চিকিৎসক ও হাসপাতাল সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ঝরছিল।

শুধু বাবু নন, শুক্রবার থেকে রোববার সকাল পর্যন্ত এভাবে চিকিৎসা না পেয়ে আরও ছয়জনের করুণ মৃত্যু দেখে নীরবে কেঁদে হাসপাতাল ত্যাগ করেছে তাদের স্বজনরা। শতাধিক অসুস্থ রোগীকে স্বজনরা পার্শ্ববর্তী বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে চিকিৎসা অব্যাহত রেখেছে। অনেকে নিয়ে গেছেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজসহ বিভিন্ন হাসপাতালে। এমনটা দাবি সংশ্লিষ্ট সূত্রের।

শনিবার রাতে হাসপাতালে আনা চারজন রোগীর মধ্যে তিনজন মারা যান বলে দাবি করেছেন আফজল নামের এক রোগীর অভিভাবক মো. ফয়সাল।

কুতুপালং ১৩ নং ব্লকের বাসিন্দা মিয়ানমারের আকিয়াব জেলার বুচিধং থানা ফাতিয়া গ্রামের এজাহার হোসেন (৫০) স্ত্রীকে এনে পাঁচদিন ধরে ভর্তি আছেন। শুক্রবার থেকে নার্সরা সেবা দিলেও কোনো চিকিৎসকের দেখা পাননি তারা।

Coxsbazar

বুধবার অপারেশনের মাধ্যমে কক্সবাজার শহরের দক্ষিণ ডিগকুল এলাকার লায়লা বেগমের বাচ্চা হয়। তিনি প্রসূতি বিভাগে থাকলেও পর্যাপ্ত সেবা পাচ্ছেন না। স্বামী মিস্ত্রির কাজ করেন। বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সামর্থ্য নেই। ভালোমতো ড্রেসিং না হলে তার ক্ষতের কি হবে এনিয়ে চিন্তায় সময় পার করছেন তিনি।

একই ধরনের দুর্ভোগে পড়েছেন জন্ডিস আক্রান্ত স্ত্রীকে নিয়ে বৃহস্পতিবার সকালে ভর্তি হওয়া সদরের ঈদগাঁওর ইসলামপুর নাপিতখালীর শাহজাহান মিয়া ও হাঁপানিতে আক্রান্ত স্ত্রীর স্বামী আবুল হোসেন, রক্তশূন্যতা নিয়ে ভর্তি উনচিপ্রাং টেকনাফ মির কাশেম ও বিজিবি ক্যাম্প এলাকার হাতভাঙ্গা ছেনুয়ারা বেগম। তাদের চমেক হাসপাতালে রেফার্ড করা হলেও অর্থের অভাবে না পারছেন যেতে, না পাচ্ছেন সেবা।

ড্রেসিং প্রয়োজন এমন রোগীরা চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের নগদ টাকা দিয়ে প্রয়োজন সারছেন। শ্বাসকষ্ট ও জ্বর নিয়ে শনিবার সকালে ভর্তি হন বড় মহেশখালী ডেবাইঙ্গা পাড়ার নুরুল আমিন। সারাদিন কোনো সেবা না দিয়ে রাতে তাকে রেফার্ড করে দেয়া হয়। দরিদ্র হওয়ায় অন্য কোথাও যেতে না পেরে বাড়িতেই ফিরে গেছেন তিনি।

ঠান্ডাজনিত সমস্যা নিয়ে নাছিমা এক বছর এক মাস বয়সী শিশু ও রিনা আক্তার পাঁচ মাসের শিশুকে নিয়ে আসেন। কিন্তু সেবা না পেয়ে ফিরে গেছেন তারা। কিন্তু সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক (আরএমও) শাহীন আবদুর রহমান বলেন, সদর হাসপাতালের সব বিভাগ খোলা। যথাসাধ্য চিকিৎসা সেবাও দেয়া হচ্ছে।

Coxsbazar

তবে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে হাসপাতাল এলাকায় গিয়ে তার প্রথম কথাটির সত্যতা পাওয়া গেলেও সেবা দেয়ার কথাটি মিথ্যাই প্রমাণিত হয়েছে। শিশু ও গাইনি বিভাগে কিছু নার্সের দেখা মিললেও কোথাও ইন্টার্ন বা কোনো চিকিৎসকদের দেখা মিলেনি। একটু একটু পর পর হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য আসছে মুমূর্ষু রোগীরা। জেলার দূর-দূরান্ত থেকে আসা এসব রোগী চিকিৎসা না পেয়ে ফিরে যেতে বাধ্য হচ্ছেন।

সদর হাসপাতালের উত্তর গেটের বেসরকারি ডিজিটাল হাসপাতাল প্রা. লি.’র সুপারভাইজার মোক্তার জাগো নিউজকে জানান, সদর হাসপাতালে সেবাবঞ্চিত হয়ে আমাদের হাসপাতালে রোগীর চাপ বেড়েছে। আমরা অনেক রোগীকে ভর্তি করতে পারছি না।

এদিকে গত ৪ এপ্রিল শহরের সমিতি পাড়ার আনোয়ার হোসেন নামের এক মৎস্য ব্যবসায়ীর মৃত্যুর পর তার স্বজনদের সঙ্গে অপ্রীতিকর ঘটনার সমাধান না হওয়ায় চিকিৎসক-নার্স ও কর্মচারীরা তাদের অবস্থানে অনঢ়। ফলে বন্ধ রয়েছে হাসপাতালের চিকিৎসা সেবা। কিছু রোগী ও চিকিৎসক এবং নার্স-কর্মচারীর সঙ্গে সংগঠিত ঘটনার জেরে জেলার পূর্ণাঙ্গ একটি সরকারি হাসপাতাল পুরো কক্সবাজারের লাখো মানুষকে ন্যায্য অধিকার চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত করছে। হাসপাতালের দরজায় এসে বিনা চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যুও মন গলাতে পারছে না চিকিৎসক-নার্সদের।

চলমান পরিস্থিতি নিয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে জেলার সাধারণ মানুষ। হাসপাতালে থাকা কোনো চিকিৎসককে প্রাইভেট চেম্বারেও রোগী দেখতে না দিতে জড়ো হচ্ছে তারা। হাসপাতালের চিকিৎসা সেবা বন্ধ রাখায় দায়ী চিকিৎসক-নার্স ও কর্মচারীদের কঠোর শাস্তিরও দাবি জানান ভুক্তভোগীরা।

Coxsbazar

জেলা ছাত্রলীগের সাবেক নেতা আবদুল মোনাফ সিকদার জানান, তার এক আত্মীয় রোববার সদর হাসপাতালে গিয়েও বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন। ৪ এপ্রিল সংগঠিত ঘটনায় দুপক্ষেরই অপরাধ থাকতে পারে। সেটার সমাধান বসে করা যায়। এভাবে পুরো হাসপাতালের চিকিৎসা সেবা বন্ধ করে দেয়া অতি বাড়াবাড়ি ছাড়া কিছু নয়। স্পর্শকাতর পেশাকে পুঁজি করে ‘দাবি’ আদায় চরম ঘৃণ্য কাজ। দু’দিনে বিনা চিকিৎসায় মারা যাওয়া রোগীর স্বজনসহ জনতা ক্ষেপে গেলে তা সামাল দেয়া কারও পক্ষে সম্ভব হবে না বলে মন্তব্য করেন তিনি।

কক্সবাজার সদর হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক ডা. বিধান পাল দাবি করেছেন, হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা সচল রয়েছে। কিন্তু তার বাস্তবতা নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি কোনো কথা বলতে চাননি।

বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেনের সরকারি মুঠোফোনে বেশ কয়েকবার কল করা হয়। তিনি ফোন রিসিভ না করায় পাঠানো হয় ক্ষুদে বার্তা। তারও জবাব আসেনি।

কক্সবাজারের সিভিল সার্জন ডা. মো. আবদুল মতিন বলেন, চলমান সংকট নিরসনে আমরা সকলে কাজ করছি। স্বাস্থ্য বিভাগের চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিচালক হাসান শাহরিয়ার কবির হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দুপুর থেকে এ-সংক্রান্ত বৈঠক করছেন। সুন্দর সমাধান নিয়ে এটি শেষ হবে বলে মনে করছেন তিনি।

নিউজটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © gtbnews24.com
Web Site Designed, Developed & Hosted By ALL IT BD 01722461335